ঢাকা শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ২৯ ভাদ্র ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

nogod
nogod
bkash
bkash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
nogod
nogod
bkash
bkash

যে বেদনা চিরদিন বয়ে বেড়াতে হবে

মতামত

তোফায়েল আহমেদ

প্রকাশিত: ০০:০০, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩

সর্বশেষ

যে বেদনা চিরদিন বয়ে বেড়াতে হবে

১৯৭৫-এর ১২ সেপ্টেম্বর আমাকে ময়মনসিংহ কারাগারের কনডেম সেলে (যেখানে ফাঁসির আসামিদের রাখা হয়) নিলে মনে হয়েছিলো স্বর্গে এসেছি। এটা আমার জন্য বেহেস্ত। যেখানে ফাঁসির আসামিকে রাখা হয় সেখানে সূর্যের আলো-বাতাস প্রবেশ করে না। ১৫ আগস্টের বিভীষিকাময় দিনটির শুরু থেকেই আমার ওপর যে অমানুষিক নির্যাতন হয়েছিলো, তাতে আমি না পারি হাঁটতে, না পারি দাঁড়াতে। আমার অবস্থা ছিলো এতোটাই করুণ।

১৫ আগস্ট থেকেই খুনিচক্র আমাকে গৃহবন্দী করে। গৃহবন্দী অবস্থায় ঘাতকের দল আমার ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালায়। ১৭ আগস্ট মেজর শাহরিয়ার এবং ক্যাপ্টেন মাজেদ (উভয়ের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে) বাসা থেকে টেনেহিঁচড়ে আমাকে রেডিও স্টেশনে নেয়। আমার মা তখন বেহুঁশ। সেখানে আমার উপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। ১৮ আগস্ট ব্রিগেডিয়ার শাফায়েত জামিল (প্রয়াত) এবং ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন (তখন মেজর ছিলেন), আমার বাসায় দেখা করতে আসেন এবং গোপন কিছু কথা বলেন। তারা চলে যাওয়ার পর আমার ওপর খুনিচক্রের নির্যাতন বেড়ে যায়। শাফায়েত জামিল এবং সাখাওয়াত হোসেন তাদের বইতে সেসব উল্লেখ করেছেন। ২৩ আগস্ট ডিআইজি এবং স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান ইএ চৌধুরী আমাকে এবং জিল্লুর রহমানকে (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) বঙ্গভবনে খুনি মোশতাকের কাছে নিয়ে যান। খুনি মোশতাক সরকারকে সমর্থনের জন্য আমাদের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে বিভিন্ন প্রস্তাব দেয়। আমরা সেসব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি। খুনি মোশতাক তার সরকারের সপক্ষে সম্মতি আদায়ে ব্যর্থ হয়ে আমাদের বাসভবনে ফিরিয়ে গৃহবন্দী করে রাখে। ৬ সেপ্টেম্বর আমাকে, জিল্লুর ভাই, রাজ্জাক ভাই (প্রয়াত) এবং আবিদুর রহমান (‘দ্য পিপল’ পত্রিকার সম্পাদক)-এই চারজনকে গ্রেপ্তার করে ৩০ সেনাসদস্যের প্রহরায় পুলিশ কন্ট্রোল রুমে আটকে রেখে প্রতিদিন আমার ওপর নির্যাতন চালায়। এক রাতে আমি এবং রাজ্জাক ভাই ঘুমে। জিল্লুর রহমান ও আবিদুর রহমান অন্য কক্ষে ছিলেন। হঠাৎ রাত ৩টার দিকে মেজর মহিউদ্দিন, মেজর হুদা, মেজর শাহরিয়ার আমাদের কক্ষে ঢুকেই চিৎকার করে বলে, ‘হু ইজ তোফায়েল’, ‘হু ইজ তোফায়েল’। রাজ্জাক ভাই জেগে আমাকে দেখিয়ে দেন। তারা আমার বুকে স্টেনগান চেপে ধরে। চোখের সামনে মৃত্যু উপস্থিত! আমি সৃষ্টিকর্তার নাম স্মরণ করে ওজু করতে চাই। ওজু করার পর খুনিরা আমার চোখ বাঁধে। আমি সহবন্দীদের কাছ থেকে বিদায় নেই এবং ভাবি আজই শেষদিন। বারান্দায় নিয়ে আমার দু’হাত পিছমোড়া করে বেঁধে অন্যত্র নিয়ে যায়। অনুমান করি এটি রেডিও স্টেশন। পরে জেনেছি স্থানটি রেডিও স্টেশনই ছিলো। সেখানে আমার হাতের বাঁধন খুলে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে নির্মম নির্যাতন ও বিভিন্ন বিষয়াদি নিয়ে লাগাতার প্রশ্ন করে ও নির্মম নির্যাতন চালায়। একপর্যায়ে তারা আমাকে রেখে নিজদের মধ্যে শলা-পরামর্শ করে, আমাকে কী করবে? পরে অনেকগুলো প্রশ্ন করে খুনিরা আমাকে হত্যার হুমকি দিয়ে বলে, ‘এই প্রশ্নগুলোর উত্তর না দিলে তোমাকে আমরা রাখবো না।’ 

এরপর আসে বিভীষিকাময় ১০ সেপ্টেম্বরের রাত। তখন রোজা। আমি শাহবাগস্থ পুলিশ কন্ট্রোল রুমে বন্দী। তারাবির নামাজ পড়ে রাজ্জাক ভাইয়ের পাশে ঘুমিয়ে ছিলাম। সেখান থেকে খুনিচক্র আমাকে তুলে নেয়। তারপর সেই একই প্রশ্ন এবং অকথ্য ভাষায় গালিগালাজসহ শারীরিক নির্যাতন। খুনিরা আমাকে টার্গেট করেছিলো। আমি সোজাসাপ্টা একটি কথাই বলেছি, ‘বঙ্গবন্ধুর ভালো কাজের সঙ্গে যেমন ছিলাম, যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে তবে তার সঙ্গেও ছিলাম। এর বেশি আমি কিছু বলতে পারবো না।’ নির্যাতনের একপর্যায়ে খুনিরা কিছুক্ষণের বিরতি দিলে অজ্ঞাতনামা একজন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে করুণ কণ্ঠে বলতে থাকেন, ‘আল্লাহ আল্লাহ করেন, ‘আল্লাহ আল্লাহ করেন।’ তার মনে হয়েছিলো মৃত্যু আমার অবধারিত। সন্ধ্যার সময় খুনি মেজর শাহরিয়ার আসে। একগাদা লিখিত প্রশ্ন আমাকে দিয়ে বলে, ‘এর উত্তর দিতে হবে।’ আমার তখন হুঁশ নেই, আধমরা। এই বেহুঁশ অবস্থায় আমাকে পুলিশ কন্ট্রোল রুমে দিয়ে যায়। অসহ্য যন্ত্রণায় আমি চিৎকার করতে থাকি। তখন রাজ্জাক ভাই, জিল্লুর ভাই আমার শুশ্রূষা করেন। কিছুক্ষণ পর সিটি এসপি সালাম সাহেব ডাক্তার নিয়ে আসেন। সন্ধ্যার দিকে আমাদের চারজনকে সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে নাম-ধাম লিপিবদ্ধ করে সেপ্টেম্বরের ১১ তারিখ আবিদুর রহমান এবং আমাকে ময়মনসিংহ এবং রাজ্জাক ভাই ও জিল্লুর ভাইকে কুমিল্লা কারাগারে প্রেরণ করে।

ময়মনসিংহ কারাগারে ১২ সেপ্টেম্বর সকালে পৌঁছাই। আমার শারীরিক অবস্থা তখন খুউব খারাপ। আমাকে আর আবিদুর রহমানকে ফাঁসির আসামির কনডেম সেলে রাখে। এখানে আমি ৫ মাস সূর্যের আলো দেখিনি। এই কনডেম সেলেই ফাঁসির আসামীর মতো আমার জীবন কেটেছে। জেলাখানার নিয়ম-কানুন মেনে চলতাম। আবিদুর রহমান সাহেব আমার জেলসঙ্গী ছিলেন। তিনি কবিতা লিখতেন। আমিও ডায়েরি লেখার চেষ্টা করতাম। ঈদের দিন জেলখানায় সকলকে সেল থেকে বেরুতে দেয়, বন্দীরা খোলা অবস্থায় থাকে এবং নামাজ পড়ে। ঈদের দিন খোলা অবস্থায় থাকা কনডেম সেলের ফাঁসির আসামির মধ্য থেকে ৫ জন পালিয়ে যান। আমি আর আবিদুর রহমান ছাড়া আর সবাই স্বাধীনতা বিরোধী এবং অন্যান্য আসামি। তখনই যারা আগে কনডেম সেলে ছিলেন তাদেরকে আবার কনডেম সেলে নিয়ে এসে আমাকে ওয়ার্ডে দেয়। সেই ওয়ার্ডে আমরা অনেকেই ছিলাম। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অর্থাৎ ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর, শেরপুরের স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা আসতে থাকেন। বঙ্গবন্ধু ‘কারাগারের রোজনামচা’য় লিখেছেন,  ‘জেলখানার সম্বল, থালা-বাটি-কম্বল।’ আমাকে দিয়েছে দুটো কম্বল। একটি বিছানার, আরেকটি গায়ে দেয়ার। সেইসঙ্গে একটি থালা ও বাটি। এই ছিলো আমার জেলখানার সম্বল। তখনো আমি এমপি। এমপি পদ যায়নি, কিন্তু ডিভিশন দেয়নি। ডিভিশন দেয় অনেকদিন পর। ডিভিশন পাওয়ার পর আমি ওয়ার্ডে গেলাম। সেখানে পেলাম আবদুল হামিদ সাহেবকে (সাবেক রাষ্ট্রপতি)। তিনি গ্রেপ্তার হন ২০ মার্চ ১৯৭৬-এ। তাকে গ্রেপ্তারের পর প্রথমে আর্মি ক্যাম্প, পরে পুলিশ ক্যাম্পে শারীরিক নির্যাতন করে। ডিভিশন পাওয়ার পর আমি, আবিদুর রহমান, আব্দুল হামিদ, জাতীয় নেতা রফিক উদ্দিন ভূঁইয়া, সাবেক ধর্মমন্ত্রী ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ মতিউর রহমান (সদ্য প্রয়াত), সাবেক এমপি মোস্তাফিজুর রহমান, শেরপুরের নিজামউদ্দীন এমপি, আব্দুস সামাদসহ শেরপুরের অনেকে আমরা একসঙ্গে ছিলাম। এছাড়াও মেম্বার ওয়াদুদ, আব্দুল হামিদ, মোস্তাফিজুর রহমান চুন্নু মিয়া এমপিসহ কিশোরগঞ্জের বহুনেতা এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবের ছোটভাই সৈয়দ ওয়াহিদুল ইসলাম পট্টু ভাই, সিপিবি’র নেতা অধ্যাপক যতীন সরকার এবং ন্যাপ নেতা আব্দুল বারী (যিনি ছিলেন খুনি মোশতাকের আপন ভাগনে) আমাদের সঙ্গে ময়মনসিংহ কারাগারে বন্দী ছিলেন। নেত্রকোনার খসরু, ফজলুর রহমান, সাফায়েত, ন্যাপ নেতা অলোক ময়নাহাসহ ময়মনসিংহের বিভিন্ন স্থানের নেতা-কর্মী বন্দী ছিলেন। কারাগার ভর্তি শুধু আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী। ’৭৬-এর ৩১ আগস্ট জিয়াউর রহমানের এক আদেশে স্বাধীনতা বিরোধী যারা হত্যা, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং লুটতরাজ করেছে তাদের সকলকে ছেড়ে দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু দালাল আইনে তাদের আটকাদেশ দিয়ে বিচারের মুখোমুখি করেছিলেন। যারা কোলাবরেটের তারা কারাগারে ছিলেন ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। আমাদের নেতা-কমীদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার শুরু করলে পর্যায়ক্রমে রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীদের বেরোনোর পালা শুরু হয়। স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়া দালাল আইন বাতিল করে ৩১ ডিসেম্বর জেলখানা খালি করে দেয় এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কারাবন্দী করে।

এই ময়মনসিংহ কারাগারেই ৩ নভেম্বর জেলহত্যার সংবাদ পাই। কারাগারের জেল সুপার তখন নির্মলেন্দু রায়। বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে বন্দী তখন তিনি ডেপুটি জেলার ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অনেকবার গণভবনে দেখা করেছেন। তখন তাকে দেখেছি। নির্মলেন্দু রায় আমার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। এই জেলখানায় এক মেজর সশস্ত্র অবস্থায় প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন। নির্মলেন্দু রায় তাকে ঢুকতে দেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘আমি অস্ত্র নিয়ে কাউকে ঢুকতে দেবো না।’ যেটা ঢাকা জেলখানায় পালন করেনি। আমার ক্লাশমেট ছিলেন ওদুদ। ওদুদ তখন সাবডিভিশনাল পুলিশ অফিসার। যার ’৭৩ ব্যাচে চাকরি হয়। তিনি ৪০ জন পুলিশ নিয়ে জেলখানা ঘিরে রেখেছিলেন। যার জন্য সেই মেজর সেদিন ময়মনসিংহ কারাগারে ঢুকতে পারেননি। ইতোমধ্যে ঢাকায় কারাভ্যন্তরে নৃশংসভাবে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। জেলখানায় আক্রমণ হতে পারে ভেবে ময়মনসিংহের তৎকালীন এসপি রাতে জেলখানায় আসেন আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি যাইনি। আমাকে প্রোটেকশন দেয়ার কারণে পরবর্তীকালে নির্মলেন্দু রায়কে বদলী করে ফরিদপুর পাঠানো হয়। আর এসপিকে ময়মনসিংহ থেকে বদলী করে ওএসডি করে। এই দু’জন মানুষের নিকট আমি কৃতজ্ঞ।

ময়মনসিংহ কারাগারে থাকাকালে আমার জীবনে অনেক দুঃখের ঘটনা ঘটে। হঠাৎ একদিন শুনতে পাই, মাইকে ঘোষণা করছে, শফিকুল ইসলাম মিন্টু নামে কোনো বন্দী আছে কি না? অর্থাৎ আমার এপিএস শফিকুল ইসলাম মিন্টু। আমাকে বন্দী করার পর মিন্টুকে গ্রেপ্তার করে আমার বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য প্রবল চাপ সৃষ্টি করে খুনিচক্র। সম্মত না হওয়ায় তাকে হত্যা করে। তার মৃতদেহ আর পাওয়া যায়নি। তাকে খোঁজার জন্য কারাগারে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়। ময়মনসিংহ কারাগারে বন্দী থাকাকালে ফজরের নামাজ পড়ে দিনের বেলা যখন ঘুমাই তখন আলী আহমদ সুবেদার আমাকে জাগিয়ে বলেন, ‘ওঠেন ওঠেন, আপনার সাক্ষাৎ আসছে।’ আমার স্ত্রী আনোয়ারা আহমেদ, একমাত্র মেয়ে ডা. তসলিমা আহমেদ মুন্নি এবং চাচাতো ভাই ওদুদ আমাকে দেখতে ময়মনসিংহ কারাগারে এসেছেন। সাক্ষাতের শুরুতেই জিজ্ঞাসা করি মেজো ভাইয়ের খবর কী? আমার স্ত্রী বলেন, ‘এসব কথা বাদ দিয়ে অন্য কথা আলাপ করো।’ হঠাৎ ক্লাস টু-তে পড়ুয়া আমার ছোট্ট মেয়েটি বলে, ‘আব্বা, কাকুকে তো মেরে ফেলেছে!’ আমার মেজো ভাই আলী আহমেদ। ঈদের আগের দিন বাড়ির কাছে গ্রামের হাটে বাজার করতে গিয়েছিলেন। তখন খুনি ক্যাপ্টেন মাজেদ লোক নিয়োগ করে মেজো ভাইকে বাজারের মধ্যে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। আমার মায়ের জীবন ছিলো বেদনার্ত। মেজো ভাইয়ের মৃত্যুর ৩ মাস আগে ’৭৫-এর ১১ জুলাই আমার বড় ভাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়)। বঙ্গবন্ধু তখন ধানমন্ডির বাসভবনে এসে আমার ভাইয়ের জানাজা করলেন, এয়ারপোর্টে নিজে গেলেন, হেলিকপ্টারে ভাইয়ের মৃতদেহ ভোলায় পাঠালেন। আমি ১৫ দিন ভোলাতে ছিলাম। প্রতিদিন বঙ্গবন্ধু আমাকে ফোন করতেন। তখন ফোন সুলভ ছিলো না। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ আমি যেন প্রতিদিন সকাল ১১টায় ভোলার থানায় থাকি। ঠিক ১১টার সময় প্রতিদিন বঙ্গবন্ধু ফোন করতেন। শেখ জামাল ও শেখ কামালের বিয়ের দিনও ফোন করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সবাই আছে শুধু তুই নাই। তোর কথা শুধু মনে পড়ে।’ এতোবড় মহান নেতা ছিলেন তিনি। আমার মায়ের তখন করুণ অবস্থা। আমরা ৩ ভাই। বড় ভাই ১১ জুলাই ও মেজো ভাই ৫ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন আর আমি কারাগারে। মায়ের সেই বেদনাবিধুর কষ্ট লিখে বোঝাতে পারবো না। যে সরকারি বাড়িতে ছিলাম ১৫ দিনের মধ্যেই সেই বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়। আমার স্ত্রীকে মানুষ বাড়ি ভাড়া দিতে চায়নি। আমার স্ত্রীকে বাড়ি ভাড়া দিলে তাদের ক্ষতি হবে। আমার ভাগনি-জামাই নজরুলের নামে বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেই বাড়িতে আমার স্ত্রী থাকতেন। পরিবারের সকলেই তখন সীমাহীন কষ্ট করেছে।

ময়মনসিংহে দীর্ঘদিন কারানির্যাতন ভোগের ২০ মাস পর ’৭৭-এর ২৭ এপ্রিল আমাকে ট্রেনে কুষ্টিয়া কারাগারে নিয়ে প্রথমে আইসলোশনে রাখা হয়। কুষ্টিয়া কারাগারে সহকারাবন্দী ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা সরদার আমজাদ হোসেন (প্রয়াত), শাজাহান খান (আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য) এবং বরিশালের ছাত্রলীগ নেতা ফারুক। আমার মা তার জীবিত একমাত্র ছেলেকে দেখতে বৃদ্ধাবস্থায় অসুস্থ শরীরে কুষ্টিয়া কারাগারে যেতেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে কপালে চুমু খেয়ে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বিদায় নিতেন। আমার স্ত্রী আমাকে দেখতে আসার পথে একবার সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মক আহত হন। তার মাথায় ১৪টি সেলাই লাগে। অসুস্থ স্ত্রীকে দেখতে কারা কর্তৃপক্ষ আমাকে ২ ঘণ্টার জন্য প্যারোলে মুক্তি দেন।  আমার স্ত্রী’র আবেদনের প্রেক্ষিতে আটকাদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে (যিনি মাত্র ১ টাকা ফি নিয়েছিলেন) অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক (বর্তমান আইনমন্ত্রীর পিতা) আদালতে বলেন, ‘তার আটক সম্পূর্ণ অন্যায় এবং ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের জরুরি ক্ষমতা আইনের আওতায় তার আটকাদেশের যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করার মতো কোনো তথ্য-প্রমাণ সরকারের হাতে নেই। ফলে উক্ত আটকাদেশ অবৈধ ও আইনের এখতিয়ার বহির্ভূত।’ রাজ্জাক ভাই এবং আমার একসঙ্গে রিট হয়। রাজ্জাক ভাই হাইকোর্ট থেকে মুক্তি পেলেও আমি মুক্তি পাইনি। অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের রায়ে মুক্তি পেলাম ৪ মাস পর অর্থাৎ ’৭৮-এর ১২ এপ্রিল। কুষ্টিয়া কারাগারে ১৩ মাসসহ সর্বমোট ৩৩ মাস বন্দী থাকার পর মুক্তি লাভ করি। কুষ্টিয়া কারাগারে আটকাবস্থায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত হই। কুষ্টিয়া কারাগারের ১৩ মাসে অনেক উত্থান-পতন দেখেছি। এই জেলে প্রতিরাতেই চিৎকার শুনতাম। ময়মনসিংহ ও কুষ্টিয়া কারাগারে থাকাকালে ফাঁসির আসামিদের কান্না শুনেছি।
আমি কখনো ভাবিনি যে বেঁচে থাকবো। বঙ্গবন্ধু স্নেহ-আদর-ভালোবাসায় বুকে টেনে নিয়েছেন। পৃথিবীর যেখানে গিয়েছেন, বাংলাদেশের যেখানে গিয়েছেন আমাকে সঙ্গী করেছেন। প্রতিদিন সকাল ৯টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে অফিসে যেতাম। আবার রাতে বঙ্গবন্ধুকে তার বাসভবনে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরতাম।  যেদিন ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা, সেদিন বঙ্গবন্ধুকে বাসায় পৌঁছে দিই এবং বঙ্গবন্ধু আমাকে বলেন, ‘কাল সকালে আসবি। তুই ডাকসুর ভিপি ছিলি। তুই আমার সঙ্গেই ইউনিভার্সিটিতে যাবি।’ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এটাই আমার শেষ দেখা ও কথা! পরদিনের পরিস্থিতি এমন হতে পারে তা ছিলো কল্পনাতীত!  সারাজীবন মনের গভীরে এই দুঃখ থেকে যাবে, যে মহান নেতা জাতির পিতা পরম মমতা-স্নেহ-আদর-ভালোবাসায় সিক্ত করে সর্বদা ছায়া দিয়ে নিজের সঙ্গে রেখেছেন, যার স্নেহ-আদর-ভালোবাসা আমার জীবনে পাথেয়-তার মৃত্যুতে কিছুই করতে পারিনি। বেদনার এই অবিরাম ভার আমাকে চিরদিন বয়ে বেড়াতে হবে!

লেখক: আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য এবং সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
 

জনপ্রিয়