
বর্তমানে একটা কঠিন সময় অতিক্রম করছি আমরা। সময়ের প্রয়োজনে আমরা বড়রা যে স্মার্টফোন ব্যবহার করছি সেই স্মার্টফোনে আসক্ত হচ্ছে আমাদের সন্তানরা। সে কী আসক্তি! নেশার মতো বুঁদ হয়ে পড়ে থাকছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কিংবা সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে রাতের পর রাত।
এই মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আমাদের বাচ্চাদেরকে স্মার্টফোন আসক্তি থেকে সরিয়ে আনা। আমরা অভিভাবকেরা বুঝে হোক বা না বুঝে, ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছি। বিশেষ করে অনূর্ধ্ব ৫-৭ বছর বয়সী শিশুদের চিন্তার জগতটাকে আমরা একেবারে গলাটিপে মেরে ফেলছি।
বাচ্চাদের জন্য যারা বিভিন্ন গেম-কন্টেন্ট তৈরি করছেন, তারা তা করছেন ব্যবসার জন্য। আমাদের বাচ্চাদের মানসিকভাবে পঙ্গু বানিয়ে তারা বিলিয়ন ডলার আয় করে নিচ্ছেন। আর এইসব কন্টেন্ট দেখে আমাদের বাচ্চারা হচ্ছে হাবাকালা!
অতি-আসক্তরা দেখবেন ঠিকমতো রেসপন্সই করতে পারছে না। আরো অনেক সমস্যা আছে। ১০ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের অবস্থা তো আরো খারাপ। করোনাকালে আমরা অভিভাবকেরা অনলাইনে ক্লাস করায় আমাদের সন্তানদের হাতে স্মার্টফোন তুলে দিতে অনেকটা বাধ্য হয়েছিলাম। তারা তখন কথা স্পষ্ট বুঝতে কষ্ট হচ্ছে এই অজুহাতে কানে হেডফোন লাগিয়ে ক্লাস করেছে। কিন্তু কতোজনের মনোযোগ সেই ক্লাসে ছিলো। অনেক শিক্ষার্থী এই সুযোগে ভার্চ্যুয়াল জগতের গলি-ঘুপচিতে ঢুকে পড়ে পড়াশোনা থেকে দূরে সরে গেছে, আসক্ত হয়ে পড়েছে মোহনীয় ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমের কদর্য জগতে। সংকুচিত হয়ে আসছে তাদের চিন্তার জগৎ, বোধ-বুদ্ধি লোপ পাচ্ছে, হয়ে যাচ্ছে উদাসীন। সময় এসেছে তাদের এই চোরাগলি থেকে বের করে আনার।
তবে উপায় কী? মাথা ব্যথা উপসমের জন্য তো আর মাথা কেটে ফেলা যাবে না। তা ছাড়া আমাদের দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় স্মার্টফোন এখন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা এক অপরিহার্য অনুসঙ্গ। কী নাই তাতে? একজন শিক্ষক, একজন চাকরিজীবী, একজন ব্যাংকার সর্বোপরি সব পেশার মানুষের এমনকি শিক্ষার্থীদেরও এখন অতি প্রয়োজনীয় উপাদান এই স্মার্টফোন। অনুসন্ধিৎসু মনের সকল প্রশ্নের উত্তর আছে এই স্মার্টফোনে। কৌতুক করে বলা যায় পৃথিবীর সবচাইতে নামিদামি শিক্ষকও এখন থাকে সবার পকেটে!
যখন দেখবেন আপনার সন্তান পরিবারের অন্য সদস্যদের কথোপকথন কিংবা বাইরের শব্দের দোহাই দিয়ে দরজা বন্ধ করে পড়তে চাইছে, ঘুমাতে চাইছে কিংবা সারারাত জেগে দিনের বেলায় ঘুমে ঢুলুঢুলু করছে। কিংবা যখন দেখবেন খেলাধুলা বা পারিবারিক আড্ডার সুন্দরতম মুহূর্তগুলোর চাইতে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকতেই বেশি পছন্দ করছে--তখনই বুঝে নিতে হবে, ভার্চ্যুয়াল জগতে তার অনেক বন্ধু তৈরি হয়েছে। সেই বন্ধুদের কথোপকথন তথা অনলাইন-চ্যাটের পারস্পরিক ভালো লাগার তুলনায় আত্মীয় আপনজন এমনকি খেলাধুলাও তার কাছে এখন গৌণ হয়ে গেছে। ঠিক তখনই আপনি নিশ্চিত হয়ে যেতে পারেন যে, আপনার সন্তান স্মার্টফোনে আসক্ত হয়ে পড়ছে।
অতিরিক্ত মোবাইল আসক্তির ক্ষতিকর দিক সমূহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন ভিডিও কনটেন্টের মাধ্যমে কিংবা গুগলে সার্চ করেও যেহেতু জানা যায় তাই এই বিষয়ে বিস্তারিত কিছু লিখছি না। আমাদের অধিকাংশ অসচেতন মায়েরা তার শিশু সন্তানকে খাওয়ানোর সময় একটু বেশি খাবে এই বিবেচনায় ফোনে কার্টুন, ভিডিয়ো দেখিয়ে দেখিয়ে খাওয়ায় কিংবা জ্বালাযন্ত্রণা থেকে বাঁচতে কিংবা নিজের স্মার্ট দুনিয়ায় বিচরণের সুযোগ হিসেবে শিশুর হাতে আরেকটি স্মার্ট ফোন দিয়ে বসিয়ে রাখতে দেখা যায়। তাতে জ্বালাযন্ত্রণাও কমে আবার নিজেও নিশ্চিন্তে-নির্বিঘ্নে ফেসবুকিং করতে পারেন। অথচ এতে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে, কী পরিমাণ প্রভাব ফেলে তা, হয় আমরা অনেকেই বুঝি না বা বুঝতে চাইও না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাবা-মা, অতিরিক্ত স্মার্টফোন আসক্তির কারণে সন্তানকে সময় দিতে পারে না, সৃষ্টি হয় দূরত্ব এবং সেই দূরত্বের কারণে সন্তান অসৎসঙ্গে জড়িয়ে যায়। এরপর সেই সন্তান শুরুতে স্মার্টফোনে আসক্ত হয়, এরপর মাদকাসক্ত--সর্বশেষ ঠিকানা হয় কিশোরগ্যাংয়ে।
তা ছাড়া সাম্প্রতিক সময়গুলোতে যৌথ পরিবার-কাঠামো ভেঙে একক পরিবার কাঠামো তৈরি হওয়ায় সঙ্গীর অভাবেও বাচ্চারা স্মার্টফোন আসক্ত হয়। এক্ষেত্রে বাবা-মা দুজনেই কর্মজীবী হলে তো কথাই নেই। অনেক পরিবারের গৃহকর্তা প্রবাসে থেকে সন্তানের প্রতি অতিরিক্ত স্নেহে কম বয়সেই তার হাতে মোবাইল তথা স্মার্টফোন তুলে দেয়। সেক্ষেত্রে প্রবাসীর স্ত্রীর অসাবধানতায় সন্তান সেই ফোনে আসক্ত হয়ে একসময় পিছিয়ে পড়ে পড়াশোনা থেকে। মৃত্যু ঘটে একটি সুন্দর সম্ভাবনার। শিক্ষক হিসেবে, শিক্ষাঙ্গনে এই চিত্র আমরা প্রায়ই দেখে থাকি।
স্মার্টফোন আসক্তিকে গবেষকরা এখন রোগ হিসেবে বিবেচনা করে এবং সেই রোগের একটি নামকরণ হয়েছে–‘নোমোফোবিয়া’ বা ‘নো-মোবাইল-ফোবিয়া’! বর্তমানে যুক্তরাজ্যে ৫৩ শতাংশ এবং ২৯ শতাংশ ভারতীয় উপমহাদেশের তরুণ-তরুণীরা এ রোগের শিকার। শহীদ বুদ্ধিজীবী আলিম চৌধুরীর মেয়ে বিশিষ্ট চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. নুজহাত চৌধুরীর একটি ভিডিয়ো বার্তা নিশ্চয়ই আমাদের চোখে পড়েছে। সেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়াসহ অন্ধত্ববরণ করার সম্ভাবনাও থেকে যাচ্ছে। শিশু বিশেষজ্ঞ অদিতি চৌধুরীরও আছে এই বিষয়ে ধারাবাহিক সচেতনতামূলক ভিডিয়োচিত্র। এইসব ভিডিয়োচিত্রকেও আমরা ধর্তব্যের মধ্যে না নিয়ে উল্টো বিনোদনের উৎস বানিয়ে নিত্যদিন দেখছি। অর্থাৎ আমরা বুঝতে পারছি ঠিকই কিন্তু উট পাখির মতো যেনো বালুতে মাথা গুঁজে বসে আছি।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, মোবাইল ফোনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতার ফলে মানুষের মনোযোগের সময়সীমা এক-তৃতীয়াংশ কমে এখন মাত্র ৮ সেকেন্ড হয়েছে। যার ফলে মানুষের কর্মদক্ষতা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। এ ছাড়া সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অন্যের সুন্দর জীবনের কাল্পনিক কন্টেন্ট বা ছবি-ভিডিয়ো দেখে আমরা অনেকে নিজেদের দুঃখী ভাবছি। সেই ভাবনা থেকে হতাশা এমনকি আত্মহত্যার পথ পর্যন্ত অনেকে বেছে নিচ্ছে। এমন অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের আগামী প্রজন্ম যে উপভোগ-শক্তিবর্জিত একটা মূঢ়, অকর্ষিত ও অবিকশিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে-তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কাজেই সার্বিক দিক বিবেচনায় সন্তানদের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিতে তাদের স্মার্টফোন আসক্তি থেকে যেমন সরিয়ে আনতে হবে তেমনি নিজেদেরও অতিব্যবহার থেকে মুক্ত থাকতে হবে।
শিক্ষার্থীদের চিন্তার জগতকে খুলে দিতে ব্যস্ত রাখতে হবে নানা সৃজনশীল কাজে। তারা পাঠ্যবই পড়ার পাশাপাশি গল্পের বই পড়বে, ছবি আঁকবে, কবিতা পড়বে, নদীর ধারে মাঠে-ঘাটে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াবে কিংবা আনন্দে গলা ছেড়ে গান গাইবে।
অভিভাবকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তাদের সন্তানদেরকেও সময় দিতে হবে বন্ধুর মতো। তবেই মিলতে পারে মুক্তি। সুন্দর হতে পারে সন্তানদের ভবিষ্যৎ।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, কাজী মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম কলেজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া