ঢাকা রোববার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪ , ২৭ আশ্বিন ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash

শিক্ষক হেনস্তা ও অপমানের নেপথ্যে

মতামত

মো. আবু তাহের মিয়া

প্রকাশিত: ০০:১০, ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সর্বশেষ

শিক্ষক হেনস্তা ও অপমানের নেপথ্যে

একটা খারাপ সিস্টেম ভালো মানুষকে প্রতিবার পরাজিত করে। ওয়েলিয়াম এডওয়ার্ডস ডেমিং এর কথাটি যেনো শিক্ষকদের বেলায় প্রযোজ্য। শিক্ষকদের নির্যাতন ও অপমানের আর কী বাকি রইলো। শিক্ষক যাদের শিক্ষা দেন তাদের হাতে নির্যাতন ও হেনস্তা হচ্ছেন। শিক্ষাগুরু শিষ্যের কাছেই নির্যাতিত হচ্ছেন কেনো? কোন সিস্টেমে আমাদের তা জানা দরকার।

শিক্ষকদের বলা হয়ে থাকে মানুষ গড়ার কারিগর। জাতি গড়ার কারিগর। কিন্তু এই কারিগরদের রাষ্ট্রে চরম অবহেলা করা হয়ে থাকে। নেই সামাজিক মর্যাদা, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। মর্যাদা সে তো বিরাট বড় প্রশ্ন। এখন শিক্ষকেরা ডাল-ভাতের নিশ্চয়তাটুকুই আশা করতে পারেন না। আর সম্মান! প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। শিক্ষকদের সর্বোচ্চ সম্মান দেয়। পাশের রাষ্ট্রগুলো বিশেষ করে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান বা মালয়েশিয়ায় শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা অনেক ওপরে। কোনো সন্দেহ ছাড়াই আমরা এখন বলতে পারি শিক্ষককে মর্যাদা করা কোনো নৈতিক দায়িত্ব নয়। এটা যে কোনো দেশের শিক্ষার মানের জন্য জরুরি। যেসব সমাজে শিক্ষকের মর্যাদা বেশি, সেখানে শিক্ষার্থীরা ভালো শিক্ষা পায়।

শিক্ষা হলো ব্যক্তির বিকাশের জীবনব্যাপী চলমান প্রক্রিয়া। যেহেতু শিক্ষা গতিশীল তাই বলা যায় সভ্যতাকে অগ্রগতির দিকে নিয়ে যাওয়া।

অনগ্রসর সমাজকে অগ্রসর করে শিক্ষা। সমাজের বৈষম্যকে সমতা রক্ষায় কাজ করে শিক্ষা। আর যদি বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থায় হয়, সে সমাজ পিছিয়ে পরে। শিক্ষা ব্যবস্থায় গ্রাম-শহর, ধনী-দরিদ্র, কারিগরি-মাদরাসা, বাংলা-ইংরেজি বা সরকারি-বেসরকারি, নানান মাপকাঠি ও বিভিন্ন প্রেক্ষিতে বিভিন্ন শিক্ষা। বৈষম্যমূলক শিক্ষা কখনই কাম্য নয়, যা সমাজে, রাষ্ট্রে প্রভাব ফেলে এমনকি নিজের ওপর বর্তায়। বৈষম্যহীন শিক্ষা সংবিধানের অঙ্গীকার। আমরা একই ধারার শিক্ষাক্রম বা একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে পারিনি। শিক্ষাব্যবস্থা যে কত ধারায় উপ-ধারায় বিভক্ত সেটা কেউ বলতে পারবেন না। বিভিন্ন মতামতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের ও ভিন্ন ভিন্ন ধারার শিক্ষা। শিক্ষকেরাও সেই সঙ্গে বিভিন্ন পথ মতে গড়ে উঠেছেন নানা ধরনের মতাদর্শ। তাই তো শিক্ষকদের মধ্যেও একে অপরের সঙ্গে মিল নেই।

শিক্ষাগুরুর মর্যাদা বলে চিৎকার চেচামেচি করলেই কি শিক্ষকের মর্যাদা বাড়বে? শিক্ষা খাতে ভয়াবহ দুর্নীতি। মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পর্যন্ত এ দুর্নীতির বিস্তার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতিরিক্ত অর্থ আদায় এবং কোচিং, অবৈধ বই ও গাইড বাণিজ্য তো রয়েছেই। সবমিলে শিক্ষায় বেড়েছে দুর্নীতি। সরাসরি এসব ক্ষেত্রের দুর্নীতির শিকার হচ্ছেন অভিভাবক, শিক্ষক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা। দুর্নীতির কারণে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যয় বাড়ছে। বিঘ্নিত হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন ও শিক্ষা কার্যক্রম। সরকারের বিভিন্ন ধরনের ব্যয়ও বাড়ছে।

বেসরকরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়ের বিভিন্ন উৎস রয়েছে, যা থেকে বছরে কোটি কোটি টাকা অর্জিত হয়। এসব আয়ের খাত অনুযায়ী সঠিক বণ্টন ও লিপিবদ্ধকরণের ওপর প্রতিষ্ঠানের সফলতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত হয়। যেসব উৎস থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো আয় করে থাকে তা হলো প্রতিবছর ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি ফি। ভর্তিকালীন ছাত্রছাত্রীদের দেয়া অনুদান। বিভিন্ন উৎস থেকে সংগৃহীত জাকাত, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন খাতে অর্থ আদায়-যেমন ছাত্রকল্যাণ তহবিল, শিক্ষক কল্যাণ তহবিল, সহশিক্ষা কার্যক্রম, বিনোদন ইত্যাদি। প্রতিষ্ঠানে আসা রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিবর্গের দেয়া অনুদানও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়ের উৎস। প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন স্থায়ী সম্পদ-যেমন দোকান ভাড়া, মাছ বিক্রয়, জমি-জিরাতের ফসল বিক্রয় ইত্যাদি থেকে প্রচুর অর্থ আয় হয়ে থাকে।

উপরিউক্ত আয় ছাড়াও প্রতি বছর নিয়মিত ও অনিয়মিত আরো বিভিন্ন উৎস থেকে প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রচুর অর্থের সংস্থান হয়ে থাকে। ব্যক্তিমালিকানাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তাদের আয়-ব্যয়, হিসাব সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও নীতিমালা প্রায় সবই নিজস্ব চিন্তাধারা অনুযায়ী পরিচালিত। প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আয়ের যেমন বিভিন্ন উৎস রয়েছে তেমনি তাদের ব্যয়ের খাতও নিছক কম নয়।

 

বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থায় কতো শিক্ষাব্যবস্থা স্বয়ং রাষ্ট্র বলতে পারবে না। ঠিক তেমনি দেশে যে কতো শিক্ষক সংগঠন আছে কেউ বলতে পারবে না। শিক্ষক নির্যাতন ও দাবি আদায়ে এই সব সংগঠনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। শিক্ষকদের মধ্যে কতো বিভক্তি। কতো শিক্ষক সংগঠন। ভিন্নমত ভিন্ন সংগঠন। ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা। বহু মতাদর্শের কারণে গড়ে উঠছে বহু শিক্ষক সংগঠন। শিক্ষকদের দাবি আদায়ের সময় কোনো সংগঠন কে পাওয়া যায় না। শিক্ষক নির্যাতনের বিষয়ে কয়টি সংগঠন এগিয়ে আসে? নিজেদের মধে কোন্দল দলাদলি করতে করতে জীবন পার। দাবি-দাওয়া কখন আদায় করবেন। নিজেদের স্বার্থ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি। ঢাক-ঢোল পিঠিয়ে শিক্ষক সংগঠন করা হয়। বৈষম্য নিরসন করার জন্য আন্দোলন করা হবে। পরে আর জাতীয়করণসহ কোনো আন্দোলনে শিক্ষক সংগঠনদের দেখা যায় না। তেমনি শিক্ষক নির্যাতনের খবরে কোনো সংগঠনের ঘুম ভাঙে না। যেমন ঘুম ভাঙে না বৈষম্য দূর করে শিক্ষাব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করা।

কে কাকে নিয়ন্ত্রণ করছে বুঝা মুশকিল। কোচিং বাণিজ্য আজ এতোটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে তা ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামগঞ্জে। বিশ্বের কোথাও আর মূলধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এ ধরনের কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনির রমরমা ব্যবসা নেই।

এটি বিশেষ করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বিষফোড়ার আকার ধারণ করেছে। অনেকে মনে করেছিলেন, সৃজনশীল পদ্ধতির প্রচলনে কোচিং বাণিজ্য নিরুৎসাহিত হবে; কিন্তু সৃজনশীল পদ্ধতিতে কোচিং আরো জেঁকে বসেছে। বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের বেতনবৈষম্য রয়েই গেছে। এটি দূর করতে হবে যেকোনো মূল্যে। শিক্ষকদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দানের পাশাপাশি দক্ষ, মেধাবী ও সঠিক যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের শিক্ষকতার পেশায় আকৃষ্ট করতে শিক্ষকদের বেতন কাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি ও বেতনবৈষম্য দূর করার বিষয়ে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে যে কেউ স্বৈরাচার হয়ে উঠে। সর্বশেষ জলন্ত প্রমাণ শেখ হাসিনা। শিক্ষকরাও মানুষ দীর্ঘদিন এক জায়গায় থাকলে স্বেচ্ছাচারী মনোভাব গড়ে উঠেন। অপরাজনীতির সুযোগ কাজে লাগান। সরকার পরিবর্তনের কারণে জনগণের রোষানলে পড়েন। বদলি চালু থাকলে বিশেষ করে বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি চালু বা ৩-৫ বছর পর পর স্বেচ্ছায় বদলি হলে শিক্ষকরা আর এতো নির্যাতনের শিকার হতেন না। অথচ ৩০ বছরেও চালু হয়নি বেসরকারি শিক্ষকদের বদলি ব্যবস্থা। বদলি চালু করতে টাকাও লাগে না। আন্তরিকতাই যথেষ্ট। তারপরও অবহেলা শিক্ষকদের ক্ষেত্রে। অন্যান্য সব পেশায় বদলি আছে শিক্ষকদের বদলি নেই। এমনকি দারোয়ান-পিয়নদের বদলি আছে শিক্ষকদের বদলি নেই। তাই অনেক শিক্ষক হেনস্তা ও নির্যাতনের পূর্বেই শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। আর মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে চান না। শিক্ষকতা মহান পেশা। শিক্ষার্থী দ্বারা শিক্ষক নির্যাতিত হচ্ছেন। আর কীভাবে শিক্ষক নির্যাতিত হলে শিক্ষক ও শিক্ষার পরিবর্তন আসবে।

লেখক: শিক্ষক, তাড়ল উচ্চ বিদ্যালয়, সুনামগঞ্জ

জনপ্রিয়