ঢাকা রোববার, ১৩ অক্টোবর ২০২৪ , ২৭ আশ্বিন ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash

মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষক ও প্রশাসন বিরোধ

মতামত

ড. মুহাম্মদ আব্দুল মুমীত

প্রকাশিত: ০০:১০, ১ অক্টোবর ২০২৪

সর্বশেষ

মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষক ও প্রশাসন বিরোধ

কোনো দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় মাধ্যমিক শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তর। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এই স্তরটি আজও সেভাবে বিকাশ লাভ করতে পারেনি। বিশেষ করে শিক্ষকের মর্যাদা, প্রশাসনিক সক্ষমতা ও পেশাদারিত্বের সুবিন্যস্ত সোপান না থাকায় শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের মঝে ক্ষোভ ও হতাশা দীর্ঘ দিনের। ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে আবার সেই বিরোধের বিষয়টি সবার সামনে আসতে থাকে। সাম্প্রতিক মাউশিতে সেসিপ কর্মকর্তা, মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের মাঝে হাতাহাতির ঘটনা সবাইকে হতবাক করে। পক্ষে-বিপক্ষে মানববন্ধন আর স্মারকলিপি প্রদানের মহড়ায় উত্তাল হয়ে উঠে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর।

মাধ্যমিক সেক্টরের এই বিশৃঙ্খলা অনেক পুরানো। ক্রনিক এ সমস্যার যথাযথ সমাধান টানতে হলে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। আশির দশকে উপজেলা পরিষদ ব্যবস্থা চালু হলে উপজেলা পর্যায়ে শুধুমাত্র উপজেলা শিক্ষা অফিস নামে একটি অফিস স্থাপিত হয়। এই অফিসটি প্রাথমিকের পাশাপাশি উপজেলার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি) প্রতিনিধিত্ব করতো। সে সময় সচিবালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নামে একটি মন্ত্রণালয় ছিলো। উপজেলায় তখন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ও কাজের কলেবর ছিলো খুব কম। 

সব উপজেলায় তখন সরকারি হাইস্কুল ছিলো না। সারা দেশে সরকারি হাইস্কুলের সংখ্যা ছিলো ৩১৭টি। সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের সে সময় সম্মানজনক বেতন গ্রেড বা শ্রেণি ছিলো না; মাউশির তত্ত্বাবধানে নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে তাদেরকে চাকরিতে প্রবেশ করতে হতো। তবে প্রমোশনের মাধ্যমে স্কেল পরিবর্তন হয়ে ওপরের দিকে যাওয়ার সুযোগ ছিলো। বর্তমানে বিসিএসের মাধ্যমে নন-ক্যাডার (দ্বিতীয় শ্রেণি) হিসেবে অনেকে এ পদগুলোতে নিয়োগ নিচ্ছেন।

মাধ্যমিক পর্যায়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় ব্যবস্থাপনায় গড়ে উঠত বিধায়, সরকারের এ বিষয়ে তেমন একটা নজরদারি ছিলো না। শিক্ষক-কর্মচারিদের বেতন-ভাতার একটা অংশ সরকার দিলেও বাকিটা স্থানীয়ভাবে প্রতিষ্ঠানের আয় থেকে মিটানো হতো। স্থানীয় ব্যবস্থাপনায় ম্যানেজিং কমিটি ক্ষেত্রমতে গভর্নিং বডিই ছিলো বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল নিয়ন্ত্রক। দাপ্তরিক কাজ সে সময় তেমন একটা ছিলো না বললেই চলে।

উপজেলাতেই যেহেতু কাজের পরিধি কম ছিলো, তাই জেলা ও আঞ্চলিক পর্যায়ে কাজের আধিক্য সহজেই অনুমেয়। সংগত কারণে জেলা শিক্ষা অফিস ও উপ-পরিচালকের অফিস এতো গুরুত্বপূর্ণ অফিস হিসেবে পরিচিত ছিলো না। গুরুত্বের বিবেচনায় এই অফিসগুলোতে দায়িত্ব নিতে অনেকেই আগ্রহ দেখাতো না; অনেকটা বাধ্য হয়েই বিকল্প কোনো প্রতিনিধি না থাকায় সরকারি স্কুলের সিনিয়র শিক্ষকদেরকে ওই দায়িত্বগুলো পালন করতে হতো। 

নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়নে উপবৃত্তি কর্মসূচি চালু হলে মাধ্যমিক শিক্ষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসতে শুরু করে। উপজেলায় থানা প্রজেক্ট ম্যানেজার/অফিসারের নেতৃত্বে ‘উপজেলা উপবৃত্তি প্রকল্প কার্যালয়’ স্থাপিত হয়; বর্তমানে যা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস নামে পরিচিত এবং এই অফিসের প্রধান ‘উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার’, যারা নবম গ্রেডে অস্থায়ীভাবে চাকরিকাল শুরু করলেও বর্তমানে ষষ্ঠ গ্রেডের স্থায়ী কর্মকর্তা। 

প্রকল্প অফিসটি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে পরিণত হলে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ও কাজের পরিধি দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং সেই সঙ্গে জেলা শিক্ষা অফিসসহ আঞ্চলিক অফিসের গুরুত্বও বাড়তে থাকে। উপবৃত্তির মাধ্যমে শিক্ষার হার ও পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও গুণগত মান নিয়ে শঙ্কা দেখা দেয়। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিবিড়ভাবে পরিদর্শনের জন্য কোনো কর্মকর্তা না থাকায় শিক্ষার গুণগতমান নিশ্চিত করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই সমস্যা নিরসনে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে ‘সেসিপ’ প্রকল্পের মাধ্যমে কার্যক্রম গ্রহণ করা হয় এবং ২০০২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে অস্থায়ীভাবে নবম গ্রেডের কর্মকর্তা (UAS, RO, AI)  নিয়োগ দেন এবং পরবর্তীতে TSEO, ATSEO, AP I DTC নিয়োগ দিলে মোট জনবল হয় ১ হাজার ১৮৭, যারা ‘সেসিপ জনবল-১১৮৭’ নামে পরিচিত।

উপজেলা, জেলা ও আঞ্চলিক অফিসে কাজের পরিধি বাড়লেও জনবল না থাকায় সেবার গতি সন্তোষজনক ছিলো না। পরবর্তীতে সেসিপ প্রোগ্রামের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা ও আন্তরিকতায় সেখানে কর্মচঞ্চলতা ফিরে আসে এবং আস্তে আস্তে এ অফিসগুলো হয়ে উঠে লোভনীয়। এক সময় সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে প্রকল্প অফিস ও প্রকল্প অফিসার হিসেবে যে তাচ্ছিল্য ছিলো, সময়ের চাহিদায় সেটিই এখন তাদের অন্যতম আকাঙ্ক্ষার স্থান। একই অবস্থা জেলা শিক্ষাঅফিস ও উপ-পরিচালকের অফিসেও; কোনোমতে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলা জরাজীর্ণ ভবনের এই অফিসগুলোতে হয়েছে নতুন ভবন, অফিসারের গাড়িসহ আধুনিক সব সুযোগ সুবিধাও। তাই সবাই এখন এই পদগুলোতে আসতে চায়। মোটা দাগে বলতে গেলে এই হলো বিরোধের অন্যতম প্রেক্ষাপট। যে কারণে সরকারি স্কুলের শিক্ষকেরা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসসহ জেলা শিক্ষা অফিস ও উপ-পরিচালকের অফিসের প্রধান হিসেবে আসতে চায়। ওদিকে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসাররাও দীর্ঘ ৩০-৩১ বছরের অভিজ্ঞতা অর্জন করে জেলার পদগুলো তাদের দখলে নিতে চায়। অন্যদিকে সেসিপ প্রোগ্রামের জনবল প্রচ্ছন্নভাবে এই অফিসগুলোতে ১৫-২০ বছর একনিষ্ঠভাবে শ্রম দিয়ে তারাও পিছিয়ে নেই এই দাবি থেকে।

প্রণিধানযোগ্য বিষয় হলো, আলোচিত অফিসগুলোর গুরুত্ব যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, ঠিক সেভাবে কর্তা ব্যক্তিরা নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা বিকশিত করতে পারেননি। পারেননি বলেই গত ২০ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হিসেবে ঢালাওভাবে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনকে দায়িত্ব দেয়া হয়। বিষয়টি খুবই হতাশার এবং অফিসগুলোর সক্ষমতা প্রশ্নবিদ্ধ। এই উদাহরণই আমাদের শিক্ষা প্রশাসনের নাজুক অবস্থা বুঝার জন্য যথেষ্ট। 
শিক্ষকেরা জাতির ত্রাণকর্তা। তাই শিক্ষককে সবার ওপরে রাখতে চাই। শিক্ষক আর প্রশাসক এক নয়। সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর দুটি কর্মযজ্ঞ। ফিনল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরের দিকে তাকালে, সেখানে কোনো শিক্ষক প্রশাসক হিসেবে আসতে চায় না। কারণ, সে দেশে সর্বোচ্চ মেধাবীরা আসেন শিক্ষকতায় এবং তাদের সুযোগ সুবিধা ও সম্মান দুটোই সবার ওপরে। শিক্ষার সংস্কারে এই বিষয়টি আগে বিবেচনায় নিতে হবে। এখনো আমাদের মেধাবীরা শিক্ষক বা শিক্ষা প্রশাসনে আসতে চান না। এই অনিহা দূর করতে পারলে এবং শিক্ষকের মর্যাদার বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে শিক্ষকেরা কোনোদিনই এসব পদে কেরানিগিরি করতে আসবেন না। পাশাপাশি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের বৈষম্য নিরসনের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। 

বিগত সরকার তাদের স্বৈরাচারী ভিত মজবুত করতে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে একটি নীতিমালায় মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার হিসেবে সরকারি স্কুলের শিক্ষক ৫০ শতাংশ এবং সহকারী মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার হতে ৫০ শতাংশ পদন্নোতির বিধান তৈরি করে। মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার ৯ম গ্রেডের একটি এনট্রি পদ; দেশের কোনো দপ্তরে এনট্রি পদে এভাবে শতভাগ ভাগাভাগির মাধ্যমে জনবল নিয়োগের বিধান চালু নেই। সুতরাং মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসনের সংস্কারে এ নীতিমালার সংশোধন আশু প্রয়োজন।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসাররা প্রশাসনিকভাবে বেশ দক্ষ, এই সেক্টরে তাদের সমক্ষ কোনো শিক্ষক হতে পারেন না। দীর্ঘ দিন জেলা ও আঞ্চলিক অফিসের সঙ্গে কাজের সুবাদে তাদের অভিজ্ঞতার ঝুলি অনেক সমৃদ্ধ। তাই জেলা ও অঞ্চলের অফিসগুলোতে যুক্তিসঙ্গতভাবে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারদের কাজ করার যৌক্তিকতা বেশি। এই ক্ষেত্রে শুধু বার্ধক্য বিবেচনায় শিক্ষকরা তাদের সমক্ষ হতে পারেন না। 

মাধ্যমিক শিক্ষায় সেসিপের কর্মকর্তারা সুদীর্ঘ কাজের দক্ষতায় উপজেলা/থানা, জেলা ও আঞ্চলিক শিক্ষা অফিসের অবিচ্ছেদ্য অংশীজনে পরিণত হয়েছে। অনেকের মতে, সেসিপের জনবল না থাকলে উপজেলা ও জেলা অফিসগুলোতে যথাযথ সেবা প্রদান কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসনকে গতিশীল করতে এই জনবলের অস্থিরতা দূর করে রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তরের অসমাপ্ত কাজটুকু দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করা সংস্কারের অন্যতম অগ্রগতি বলে বিশ্বাস করে শিক্ষা পরিবার। পাশাপাশি এতদসক্রান্ত বেশ কিছু মামলা রয়েছে যেগুলোরও দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।

শিক্ষা প্রশাসনের অনেক কাজ এখনো আমলারা বিশেষ করে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন করে থাকে; যা এই অফিসগুলোর দৈন্যদশাই নির্দেশ করে। সত্তরের দশকের এই প্রথা বিলোপ করা এখন সময়ের দাবি। শিক্ষা প্রশাসনের গতিশীলতা আনয়নে মেধাবী অফিসার নিয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে; সেক্ষেত্রে বিসিএস শিক্ষাকে দুটি অংশে--বিসিএস শিক্ষা (প্রশাসন) এবং বিসিএস শিক্ষা (সাধারণ)--করা গেলে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের এই বিরোধ নিরসন করা সম্ভব। বিসিএস শিক্ষা (সাধারণ) থেকে শিক্ষকতায় যারা আসবে তারা মনে প্রাণে শিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। অন্যদিকে শিক্ষা প্রশাসনে যারা আসবে তারা উপজেলা অফিসের হাত ধরে জেলা, আঞ্চলিক ও মাউশি হয়ে মন্ত্রণালয়ে কাজ করার সুযোগ পাবে। বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বর্তমান সরকারকে এ উদ্যোগে সফল হতে হবে, নতুবা শিক্ষা প্রশাসনের নির্ভরশীলতা কমানো এবং গতিশীলতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। 

পরিশেষে একটি কমিশন গঠনের মাধ্যমে শিক্ষার সার্বিক বিশৃঙ্খলার বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া উচিত। বৈষম্যহীন উদার ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে শিক্ষার সব সংস্কারে শিক্ষা পরিবার ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগের চেতনায় নিজেদের আন্তরিকতা ও সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে আসবে এটিই জাতির প্রত্যাশা।

 

লেখক: উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার

জনপ্রিয়