বিচার বিভাগের জন্য পূর্ণাঙ্গ সচিবালয় প্রসঙ্গে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টেই বিস্তারিত লিখেছিলেন সংসদ, সংবিধান, আইন ও বিচার বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান। বর্তমানে ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার তৎপরতায় বিষয়টি আলোচনার অন্যতম ইস্যু হয়ে উঠেছে। গতকাল প্রধান বিচারপতির দপ্তর থেকে পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে। বছর পাঁচেক পরে এসে এখনকার এই প্রেক্ষাপটেও মিজানুর রহমান খানের সেই লেখাটি সমানভাবে প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে। দৈনিক আমাদের বার্তার পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো-
বাংলাদেশ শুধু নয়, গোটা বিশ্বেই বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও কর্মস্থল নির্ধারণ তথা বিচার প্রশাসনের স্বাধীনতার সঙ্গে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নটিকে জড়িয়ে দেখা হয়।
মাসদার হোসেন মামলার মাইলফলক রায়টিতে সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন আদালতের জ্যেষ্ঠদের নিয়েই সার্ভিস কমিশন করতে বলা হয়েছে। এই জ্যেষ্ঠতা তাই সর্বত্র সংগতিপূর্ণ থাকাই প্রত্যাশিত। বিএনপির আমলে ‘আওয়ামী লীগার’ হিসেবে বিবেচিত হওয়ার কারণে যে বিচারপতিরা বাদ পড়েছিলেন, তাঁরা যখন পুনরায় কর্মস্থলে ফিরে এলেন, তখনো জ্যেষ্ঠতার প্রশ্ন উঠল। সে নিয়ে করা রিটে জ্যেষ্ঠতার নীতি বহাল থাকল। কিন্তু গত এক দশকে অধস্তন আদালত প্রশাসনে আমরা অন্তত দুটি বড় ব্যতিক্রম দেখলাম। শতাধিক বিচারককে টপকে আইন ও বিচার বিভাগের সচিব পদে একজনকে সুপ্রিম কোর্টের নিয়মতান্ত্রিক পরামর্শ ছাড়াই নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। অন্যদিকে একজন কর্মরত জেলা জজকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হলো।
এক দশক পরে পক্ষকাল আগে একটি পরিবর্তন এসেছে এবং আমরা এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানাই। এখানে বলে রাখা ভালো, আমরা আইনসচিব নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন পরে প্রশ্ন তুলছি। কারণ, এবার যে পরিবর্তনটি সূচিত হলো, তার আলোকে গোটা আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ে জ্যেষ্ঠতার নীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে।
আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অধস্তন আদালতের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কার্যকর পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। এটা টাকার অভাবে নয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর সরকার যে নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে চলছে, সেই স্থিতাবস্থা খর্ব না করাই এর উদ্দেশ্য। বিচার প্রশাসনে ‘দ্বৈত শাসন’ টিকিয়ে রাখার কারণে মামলার জট কাটছে না। এটা একমাত্র কারণ না হলেও, সব থেকে বড় কারণ বলেই প্রতীয়মান হয়। ৩০ লাখ মামলার জট ধীরে ধীরে ৫০ লাখে যাচ্ছে। এটা মোকাবিলা করার কোনো সুদূরপ্রসারী কৌশল আমরা দেখছি না। জার্মান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা জিআইজেড মামলাজট নিরসনে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে বিচার অডিটের যে ধারার সূচনা করেছিল, তা সভা–সেমিনারেই (আজও ঢাকায় হবে) আটকে আছে। আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ‘নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি’ করবেন হাইকোর্ট আর বিচারক বদলি সুপ্রিম কোর্টের ‘পরামর্শে’ করবেন রাষ্ট্রপতি, যা কার্যত প্রধানমন্ত্রী। সুতরাং এই দ্বৈত শাসন মামলাজট খুলতে এবং বিচারে গতি আনতে বাধা দিচ্ছে।
সরকার থেকে মুখে বড় করে না বললেও আকারে–ইঙ্গিতে মামলাজটের জন্য তারা বিচার বিভাগকেই দায়ী করে থাকে। নীতিগত কারণে এটা বলতে হবে যে প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ সচিবালয় চত্বরে স্বাধীন আদালতের স্বাধীন প্রশাসনের দপ্তর থাকতে পারে না। এটি বিদ্যমান সংবিধানের চেতনাবিরুদ্ধ। অবিলম্বে সচিবালয় থেকে আইন ও বিচার বিভাগের অধিকাংশ লোকবল ও শাখা-প্রশাখা সুপ্রিম কোর্টের চত্বরে সরিয়ে আনার উদ্যোগ নিলে আমরা বুঝব যে সরকার বিচার বিভাগের অধিকতর স্বায়ত্তশাসনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে সংশোধনী না এনেও এটা করা সম্ভব। আইন বা সংবিধান সমর্থন করবে, বাধা দেবে না।
১৯ বছর পরে সরকার এই প্রথম জাতিসংঘের কমিটি অ্যাগেইনস্ট টর্চার (ক্যাট)–এ গেছে। সেখানে তাঁরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা জোর গলায় বলেছেন। সরকারের দুটি ইতিবাচক উত্তর ক্যাট গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, ধন্যবাদ দিয়েছে। সরকার বলেছে, তারা দৈহিক শাস্তি নিষিদ্ধ এবং রিমান্ড ও গ্রেপ্তারে সুপ্রিম কোর্টের দেওয়া গাইডলাইন মানছে। আমরা বাস্তবে এর ব্যত্যয় দেখি। উপরন্তু সরকার ক্যাটের কাছে এই বিষয়ে যে তথ্য প্রকাশ করেনি, তা হলো ওই গাইডলাইন যাতে পালন করতে না হয়, সে জন্য সরকার আপিল বিভাগে রিভিউ দরখাস্ত করে আটকে রেখেছে। নিম্ন আদালতকে ওই গাইডলাইন মানানোর বাস্তব দায় আইন মন্ত্রণালয়ের।
ক্যাট সরকারের প্রশংসা করেছে এই বলে যে নির্যাতিত ব্যক্তি তদন্ত চেয়ে আদালতে দরখাস্ত করতে পারবেন। কিন্তু মানুষ কি নির্যাতনের প্রতিকার চেয়ে অধস্তন আদালতে যাচ্ছে? কেন যাচ্ছে না? এর ব্যাখ্যা আমরা সরকারের কাছ থেকে নাকি বিচার বিভাগের কাছ থেকে শুনব?
বিচার প্রশাসনের (রায় বা আদেশ প্রসঙ্গে নয়) জবাবদিহির বিষয়ে গণমাধ্যম একটা ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু প্রশাসনিক তথ্যপ্রবাহ অবাধ করার বিষয়টি এখন পর্যন্ত যথেষ্ট আলগা করেই রাখা হয়েছে। কোর্ট প্রতিবেদকদের শক্তিশালী সংগঠন গড়ে উঠেছে। সুপ্রিম কোর্টের আঙিনায় তাঁরা মর্যাদার সঙ্গে বসতে পারছেন। কিন্তু যার অভাব প্রকট সেটা হলো, ওই সংগঠনের সঙ্গে আদালতের মুখপাত্রের কোনো সম্পর্ক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাক, তার কোনো তোড়জোড় নেই।
আইন ও বিচার বিভাগ এবং লেজিসলেটিভ ড্রাফটিং উইংয়ের দুই সচিবকে অবশ্যই একটা সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে হাজির করানো দরকার। দেশে নতুন আইন ও আদালত প্রশাসনকেন্দ্রিক বিপুল খবর তৈরি হচ্ছে, কিন্তু আদালতের সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে না। সংসদে পাস হওয়া আইনে বিস্তর অদ্ভুত বিধান (শিশু ও মাদক আইন) তৈরি হচ্ছে। আইনসচিব ও লেজিসলেটিভ ড্রাফটিং উইংয়ের সচিব দৃশ্যত সংবাদমাধ্যম এড়িয়ে চলছেন। সবকিছুর দায়, সবকিছুর কৈফিয়ত সব সময় কেন মন্ত্রী দেবেন। গত এক দশকে তাঁরা সাংবাদিকদের অনুরোধে বা তাঁদের প্রয়োজন মেটাতে একক ব্রিফিংয়ে হাজির হয়েছেন বলে জানা নেই। অথচ রুলস অব বিজনেস বলেছে, প্রত্যেক সচিব তার মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র। সচিবদের তরফে হয়তো নির্ঘাত এই ব্যাখ্যা মিলবে যে ‘ওপরের মহল’ না চাইলে কি করে তাঁরা এটা সম্ভব করবেন? এখানেই আমরা ধাঁধার উত্তর পেতে চাই। ওই ওপরের মহল কারা? মন্ত্রিপরিষদ সচিব তো নিয়মিত সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
এই ‘ওপরের মহল’ বলতে আমরা এখানে সংবিধান অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্টকেই বুঝতে চাই। কিন্তু বাস্তবে আইনসচিবের সঙ্গে আমরা হাইকোর্ট বা ফুলকোর্টের (হাইকোর্টের বিচারকেরা যখন প্রশাসন প্রশ্নে বসেন, তখন হাইকোর্টই ফুলকোর্ট) কোনো ওঠাবসা দেখি না। যদি আমরা ১১৬ অনুচ্ছেদ এবং মাসদার হোসেন মামলায় স্বীকৃত ‘ডায়ার্কি’ বা দ্বৈত শাসনও মানি, তাহলেও আমাদের এটা শোনার কথা যে ফুলকোর্টের সভায় আইনসচিবও বসছেন। কারণ, ফুলকোর্টের পরামর্শগুলো দেওয়ার সময়টাতেই আইনসচিব বিচারপতিদের উপযুক্ত তথ্য দিতে পারেন।
৭ আগস্ট আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় এক পরিপত্রে বলেছে, বিদায়ী সচিবের চুক্তির মেয়াদ ৭ আগস্ট শেষ হওয়ায় এ বিভাগের ‘জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সচিবকে’ আইনসচিবের দায়িত্ব পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত দেওয়া হলো। সুপ্রিম কোর্টকে পাশ কাটানো এই পরিপত্র মূলত সংবিধানসম্মত নয়। একটা অচল যুক্তি সৃষ্টি করা হয়েছে যে যেহেতু পূর্ণাঙ্গ সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়নি, তাই সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শের দরকার নেই। এক ব্যক্তি এক দশক এক পদে কার্যত অনিয়মিত আইনসচিব ছিলেন। মূলত তিনি উপসচিব ছিলেন, সেখান থেকে রীতি না মেনে তাঁকে সচিব হিসেবে ‘চলতি’ দায়িত্ব পালন করিয়ে নেওয়া হলো। উপসচিব থেকে আইনসচিব হওয়া ব্যক্তি অবসরে না গিয়ে স্বপদেই ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ হলে হাইকোর্ট সরকারি আদেশটি স্থগিত করেন। চেম্বার জজ সেটি স্থগিত করেন। তার আর শুনানি হয়নি।
চার যুগ্ম সচিবের মধ্যে জ্যেষ্ঠতমকে ভারপ্রাপ্ত সচিবের পদে বেছে নেওয়ার জন্য আমরা আইনমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিই। যদিও তাঁরা সবাই নিয়মিত উপসচিব। বিভাগটি এমনকি নিয়মিত অতিরিক্ত সচিববিহীনভাবেও চলছে। আশা করি, এই বিভাগের বড় পদগুলোতে সুপ্রিম কোর্টের সুপারিশের ভিত্তিতে জগদ্দল পাথরগুলো এবার নড়বে। আমরা নিয়মিত যুগ্ম, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পাব।
৮ আগস্ট ক্যাট কতগুলো সুপারিশ করেছে। এর ২৭ দফার প্রতি আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করব। সেখানে ভারি মজার একটা কথা বলা হয়েছে,‘আইন মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে এনে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে শক্তিশালী করতে হবে।’ কথাটা সরকারকে নয়, জাতিসংঘ কথাটা ‘স্টেট পার্টি’কে মানতে বলেছে। রাষ্ট্রপক্ষের মধ্যে নিশ্চয় বিচার বিভাগ পড়ে। তাই তাদেরও করণীয় আছে।
১৩ ডিসেম্বর ২০১৩। সুপ্রিম কোর্টের চত্বরে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন বিচার বিভাগীয় সচিবালয় উদ্বোধন করবেন। আমন্ত্রণপত্র ছাপানো হলো। তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ অদম্য উদ্যোগী। কিন্তু জানা গেল সরকারের ওপর মহল নারাজ। তাদের ভুল বুঝিয়েছিলেন সদ্য অবসরে যাওয়া আইন মন্ত্রণালয়েরই একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তা। তবে বিচার বিভাগীয় সচিবালয়ের এই নামফলক স্মৃতিস্মারক হয়ে আজও সুপ্রিম কোর্টের দেয়ালে রয়েছে।