ঢাকা রোববার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪ , ২৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

সোশ্যাল জাস্টিস শিক্ষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত

মতামত

আমাদের বার্তা প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০০:২০, ৫ নভেম্বর ২০২৪

সর্বশেষ

সোশ্যাল জাস্টিস শিক্ষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত

ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম জাভা প্রদেশের রাজধানী বান্দুং-এ ২৩ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর  অনুষ্ঠিত হলো ভাষা ও শিক্ষা সম্মেলন। বান্দুং একটি ঐতিহাসিক শহর।  ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের নেহরু-নাসের-টিটু-সুকর্ণ-উনুর নেতৃত্বে প্রথম জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় এই এই  বান্দুং সিটিতে।

১৯৫৫খ্রিষ্টাব্দের ১৮ থেকে ২৪ এপ্রিল ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং সিটিতে ঐতিহাসিক বান্দুং সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের পক্ষে এই বান্দুং সম্মেলন এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই সম্মেলনে এশিয়া ও আফ্রিকার ২৯টি দেশের প্রতিনিধিরা মিলিতভাবে ঔপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করেছিলেন।

 গত শতাব্দীর বিশ্ব রাজনীতি ছিলো আপাদমস্তক ঘটনাবহুল। ইতিহাসের মোড় আর বিশ্ব রাজনীতির পট পরিবর্তন করে দেয়ার মতো অনেক ঘটনাই ঘটেছে গত শতকে। এর মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ, যখন বিশ্ব সবে রক্তস্নান থেকে মুক্তি পেয়ে বুক ভরে শ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছে, দেশে দেশে যখন ঔপনিবেশিক শাসন কাঠামো ভেঙ্গে পড়ছে। আফ্রিকা, এশিয়া আর লাতিন আমেরিকায় যখন চলছে স্বাধীনতার সংগ্রাম।

বিশ্ব যখন স্নায়ুযুদ্ধ নামক এক দীর্ঘস্থায়ী স্নায়ুক্ষয়ী রোগে আক্রান্ত, সেই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে শুরু হয়েছিলো ‘নন অ্যালাইনড মুভমেন্ট’ বা ‘ন্যাম’ নামে খ্যাত এক গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন যাকে বাংলায় বলা হয় ‘জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন’। এই আন্দোলনের প্রাথমিক সাফল্য ছিলো দশটির অধিক দেশের স্বাধীনতা আর বিশ্ব শান্তি রক্ষায়ও এই আন্দোলনের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।  সেখানেই অনুষ্ঠিত হলো ভাষা ও শিক্ষা সম্মেলন।

এতে বাংলাদেশ থেকে দৈনিক শিক্ষাডটকম ও দৈনিক আমাদের বার্তার লিড-এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ মাছুম বিল্লাহ যোগদান করেছিলেন। বাংলাদেশ থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকও যোগদান করেছিলেন উক্ত সম্মেলনে। ইন্দোনেশিয়া কিন্তু উন্নত দেশ নয় তারপরেও যেটি ভাল লেগেছে বান্দুং কিংবা জাকার্তা কোথাও কিন্তু গাড়ীর হর্ণ বাজানো হচ্ছেনা। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ নেই। রাস্তায় এমনি পুলিশের দেখাও নেই যা আমাদের সিটিগুলোতে অহরহ দেখা যায়। এটি একটি পজিটিভ সাইন। 

যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সেখানে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বিষয় এখানে তুলে ধরা  হলো। ড. ডায়ানা স্মীথ - ইউনিভার্সিটি কলেজ, লন্ডন--এর অধ্যাপক। তিনি শিক্ষায় এবং ভাষা শিক্ষায় ‘সোশ্যাল জাস্টিস’ কিংবা সামাজিক বিচার বিষয় নিয়ে কথা বলেন এবং উপস্থাপনা করেন। তার আলোচনার বিভিন্ন দিকের মধ্যে তিনি বাংলাদেশ তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে  অনুষ্ঠিত ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের  ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে তুলে ধরেন। শিক্ষার্থীরা ছিলেন এই আন্দোলনের অগ্রভাবে।

তারা মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন শুরু করেন, তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে, ফলে কয়েকজন শিক্ষার্থী শহীদ হন। পুরো ইতিহাস তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত সবার উদ্দেশে বলেন। এই ঘটনাটিকে তিনি শিক্ষায় ‘সোশ্যাল জাস্টিস’ বলে অভিহিত করেন। শিক্ষার্থীরা সামাজিক বিচার করেছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, শিক্ষকদের এবং শিক্ষার্থীদের যেসব দায়িত্ব থাকে তারমধ্যে এই ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয় যা এক ধরনের ‘সোশ্যাল জাস্টিস’ ।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজ শুধুমাত্র সিলেবাস অনুসরণ করে পড়া, পড়ানো আর পরীক্ষা দেয়া বা নেয়া  নয়। বিভিন্ন ধরনের সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ও নি:স্বার্থ ভূমিকা পালন করতে হয় যা ‘সোশ্যাল জাস্টিস’ নামে পরিচিত। এখানেই শিক্ষার মূল স্বার্থকতা নিহিত।

ভারতের রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে এক উজ্জল জোতিষ্ক হলেন ড. বি. আর আম্বেদকর। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, ভারতে দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা জাতপাত ব্যবস্থায় সামাজিক বৈষম্যের মূল কারণ। তিনি সামাজিক অধিকার, সাম্য, ন্যায়, স্বাধীনতা, সৌভ্রাতৃত্ব ইত্যাদি মূল্যবোধগুলো সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়োজনীয়তা জরুরি বলে মনে করেন। তিনি শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত দলিতদের জন্য প্রকৃতঅর্থেই অধিকার ও ন্যায় বিচার যাতে পান তার সুব্যস্থা করেছিলেন এবং অন্যদের তা করতে উৎসাহিত করেছিলেন।

ডা. ডায়ানা  আরো বলেন লন্ডনের বিদ্যালয়গুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা শিক্ষার্থীদের ২৭২টি ভাষায় শিক্ষাদান করা হয়। এ

টিকেও তিনি ‘সোশাল জাস্টিস’ বলেছেন কারণ এই নীতির মাধ্যমে সব ভাষাভাষী  শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে ।
তিনি ভিডিয়োতে দেখিয়েছেন লন্ডনের স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা কোন ভাষায় শিখছেন। তিনি আরো উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের সিলেট থেকে লন্ডনে যাওয়া শিক্ষার্থীরা নিজেরাই বাংলা না শিখে ইংরেজি শিখতে চান। কেনো বাংলা না শিখে ইংরেজি তারা পড়তে চান এবং ইংরেজি ভালভাবে শিখতে চান তার উপর তিনি গবেষণা পরিচালনা করে দেখেছেন যে, বাংলাদেশের সিলেটিরা বলেছেন, বাংলা শিখতে চাওয়া বা বাংলায় কিছু পড়তে যাওয়া মানে সময় নষ্ট করা যা তাদের কোথাও কোন কাজে লাগবে না।

এসবের উত্তরে মাছুম বিল্লাহ বাংলাদেশ প্রসঙ্গে লন্ডনের একজন অধ্যাপকের বাংলাদেশের ভাষার ঐতিহ্যবাহী ইতিহাস তুলে ধরার জন্য ধন্যবাদ দেন এবং বাংলাদেশে দুমাস আগে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে শিক্ষার্থীরা যে ভূমিকা রেখেছেন সেটিকেও তিনি ‘সোশ্যাল জাস্টিস’ বলবেন কিনা উত্তরে অধ্যাপক বলেছেন, তিনি বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সাম্প্রতিক ইতিহাস পুরোটা জানেন না। তবে, শিক্ষার্থীরা যা করেছেন তা ‘সোশ্যাল জাস্টিসে’র মত্যে কাজ।  

যেকোনো শিক্ষায়, জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে ভাষা একটি প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। একজন শিক্ষক বিজ্ঞান পড়াচ্ছেন তাকে ভাষা ব্যবহার করতেই হচ্ছে। তার ভাষা যত উন্নত ও মাধুর্যময় হবে তার শিক্ষাদান প্রক্রিয়াও তত উন্নত হবে। এভাবে গণিত, ব্যবসায় শিক্ষা, পরিবেশ বিজ্ঞানসহ  শিক্ষার সবক্ষেত্রেই কিন্তু ভাষার ব্যবহার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যেখানে বিশ্বে বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে আছে।

ফলে, তারা যতটুকু কোন বিষয়ে বুঝেছেন সেটিকে সেভাবে প্রকাশ করতে পারেন না। আর প্রকাশ করতে না পারার অর্থ হচ্ছে তারা যা শিখেছেন সেটি অনেকটাই কার্যকরী নয়। গোটা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার্থীরা বহু ভাষায় জ্ঞান অর্জন করছেন, শিক্ষায় নতুন নতুন বিষয় আবিষ্কার করছেন সেগুলোকে চারদিকে ছড়িয়ে দিতে, অন্যান্য দেশের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও গবেষকদের কাছে পৌঁছানোর মাধ্যম হচ্ছে একটি আন্তর্জাতিক ভাষা। ইংরেজিই সেই ভাষার স্থান দখল করে আছে। যাদের মাতৃভাষা ইংরেজি নয় তাদের এই ভাষায় অবহেলা করা মানে বৈশ্বিক দৌঁড়ে পিছিয়ে থাকা। সেটি কোনভাবেই করা যাবেনা।

দৈনিক শিক্ষাডটকম ও দৈনিক আমাদের বার্তা পত্রিকার লিড -এডুকেশন ও রিচার্স তার প্যানেল আলোচনায় এবং প্রশ্নোত্তর পর্বে বাংলাদেশে শিক্ষার অবস্থা, মান ও সেখানে ইংরেজির অবস্থান কি দর্শকরা জানতে চাইলে তিনি বলেন যে, বাংলাদেশের শিক্ষার ইতিহাসের সঙ্গে ঔপনিবেশিক ধারণা এখনও জড়িয়ে আছে। আর ইংরেজি বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক বিষয়  হিসেবে ১২ বছর পড়ানো হলেও শিক্ষার্থীরা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েটরা এটিকে একটি বিষয়ের মতো পড়েন। তাদের ব্যক্তিগত জীবনে এটিকে ব্যবহার করার জন্য পড়েন না। পরীক্ষায় পাস করা ও সার্টিফিকেট নেয়ার জন্য তারা ইংরেজি পড়েন। কিন্তু চাকরিতে যেহেতু এই ভাষাকে গুরুত্ব দেয়া হয় তাই শিক্ষার্থীরা শিক্ষাজীবন শেষ করার পর ইংরেজি জানা শুরু করেন যাতে চাকরি পাওয়া যায়।

আর সেটি তারা করেন বেসরকারি কিংবা ব্যক্তি পরিচালিত কিংবা ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে। মাছুম বিল্লাহকে আরো প্রশ্ন করা হয়েছিলো যে, শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগ নেয়া হয় তা বাস্তবায়নের জন্য সরকারের ইচ্ছা থাকতে হয় কিন্তু সেই ইচ্ছে সরকারি প্লান-প্রোগ্রামে দেখা যায় না। এটির সমাধান কি? এই প্যানেল ডিসকাশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি মাছুম বিল্লাহ এবং কোরীয় অধ্যাপক ড. জনসন আর. বেকার  ছিলেন। 

তাদের দুজনকেই জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো যে অনেক দেশের সরকার শিক্ষার প্ল্যান ও পরিকল্পনা করে কিন্তু সব সময় তা  দেশের মানুষ যা চায়, শিক্ষার্থীদের যেভাবে দরকার, শিক্ষকদের যা অনুকূলে যাবে যেসবের মাঝখানে বিরাট ফারাক থেকে যায়। এখানে আপনাদের সাজেশন কি এবং এক্ষেত্রে দক্ষিণ কোরিয়া ও বাংলাদেশে কি করা হয় যা ইন্দোনেশিয়ার জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে। উত্তরে প্যানেল আলোচকরা বলেছেন যে,  শিক্ষার্থীরাই  একদিন সরকার হবে, এখনও যদি সরকার সবকিছু শিক্ষার অনুকূলে কিছু না করেন একজন শিক্ষক যখন শ্রেণিকক্ষে ভালভাবে পড়াবেন, ফলপ্রসূভাবে পড়াবেন এবং দক্ষ শিক্ষার্থী তৈরি করবেন তখন ঐ শিক্ষার্থীরা একসময় শিক্ষকের কথা মনে করে সবকিছু বাস্তবায়ন করবেন। এটি দ্রুত কোনো বিষয় নয়, সময়সাপেক্ষ। আর শিক্ষক সংগঠনগুলোকে দৃশ্যমান ভূমিকা পালন করতে হবে যা যেকোনো দেশের সরকারকে সেনসেটাইজ করবে এবং অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবায়নের চিন্তা করবে। তবে, শিক্ষকদের পদক্ষেপগুলো এমন হতে হবে যাতে সরকারকে পজিটিভলি শিক্ষার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করা যায়। 

ন্যাশনাল ইনিস্টিটিউট অব সিঙ্গাপুর -এর  অধ্যাপক উইলি এ. রেনানডিয়া বলেছেন শিক্ষায় সমস্যা থাকবেই সেটি নেগেটিভ কিছু নয়। সমস্যা থাকা মানেই হচ্ছে শিক্ষকদের কাজে ব্যস্ত থাকা, শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান প্রক্রিয়ায় এনগেজড রাখা। সমস্যা না থাকলে নতুন নতুন চিন্তা কেউ করবে না, নির্জীব হয়ে পড়বে। শিক্ষকদের নতুন কিছু আবিষ্কার করতে গেলে সমস্যার মধ্য দিয়ে সাঁতরিয়ে যেতে হয়, তাদেরকে নতুন কিছু আবিষ্কার করে বিশ্ব শিক্ষায় কাজে লাগাতে হবে আর সেজন্য শিক্ষাক্ষেত্রে সমস্যাবলীকে নেগেটিভলি দেখা যাবেনা, ভাবা যাবেনা।
কিন্তু অনেক  শিক্ষকরা সমস্যা দেখলেই ঘাবড়ে যান, কাজ না করার বিভিন্ন অজুহাত খুঁজেন যেটি ঠিক নয়। সমস্যা না থাকলে তারা শিক্ষার এক্সাইটমেন্ট কোথায় পাবেন, কোথায় গবেষণা করবেন, কিসের ওপর গবেষণা করবেন? শিক্ষায় সমস্যা সব দেশেই আছে, তার রকমফের ভিন্ন কিন্তু সমস্যা আছেই। আর সমস্যা আছে বলেই শিক্ষকরা উজ্জীবিত আছেন। 

 

জনপ্রিয়