ঢাকা রোববার, ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪ , ২৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

পরীক্ষার ফল পরিবর্তনে আস্থা হারাচ্ছে শিক্ষা বোর্ড

মতামত

মাছুম বিল্লাহ , আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০০:০০, ২৪ নভেম্বর ২০২৪

আপডেট: ১৬:৫৩, ২৪ নভেম্বর ২০২৪

সর্বশেষ

পরীক্ষার ফল পরিবর্তনে আস্থা হারাচ্ছে শিক্ষা বোর্ড

গত ১৫ অক্টোবর এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। এ বছর সাধারণ শিক্ষাবোর্ডে পাসের হার ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এগারটি শিক্ষাবোর্ডে এবার জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯১১ জন শিক্ষার্থী। প্রকাশিত ফলে কারো প্রত্যাশিত ফল না এলে তাকে পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন বা উত্তরপত্র চ্যালেঞ্জ করার সুযোগ দেয় শিক্ষা বোর্ডগুলো। সে অনুযায়ী গত ১৬ অক্টোবর থেকে এ কার্যক্রম শুরু হয় এবং তা চলে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত। ১৪ নভেম্বর খাতা চ্যালেঞ্জের ফল প্রকাশিত হয়, তাতে দেখা যায় প্রতিবছরের মতোই ফলাফলে বিরাট পরিবর্তন, এমনকি ফেল করা শিক্ষার্থীও জিপিএ-৫ পেয়ে গেছেন। এবারের এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষা শুরু হয় গত ৩০ জুন।

সাতটি পরীক্ষার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ায় পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। এরপর প্রথম ১১ আগস্ট ও পরে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে বাকি পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু আগস্টে সচিবালয়ের ভেতরে ঢুকে একদল শিক্ষার্থী স্থগিত পরীক্ষা বাতিল করার জন্য বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ফলে, মন্ত্রণালয় নাজুক পরিস্থিতিতে তাদের কথা শুনতে বাধ্য হয় যা অবশ্য কারোর জন্যই তা মঙ্গলজনক ছিলো না। বাতিল পরীক্ষাগুলোর ফল বিষয় ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় একজন পরীক্ষার্থী এসএসসিতে একটি বিষয়ে যতো নম্বর পেয়েছিলেন, এইচএসসিতে সেই বিষয় থাকলে তাতে এসএসসিতে প্রাপ্ত নম্বর বিবেচনায় নেয়া হয়। আর এসএসসি ও এইচ এসসি বা সমমানের পরীক্ষায় বিষয়ের ভিন্নতা থাকলে ম্যাপিংয়ের নীতিমালা অনুযায় নম্বর বিবেচনা করে ফল প্রকাশ করা হয়। 

এইচএসসি পরীক্ষার খাতা পুনর্নিরীক্ষণে ঢাকা বোর্ডে ফেল থেকে পাস করেছেন ১৩৭ জন শিক্ষার্থী। আর নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ২০০ জন পরিক্ষার্থী। ঢাকা বোর্ডের ৫৯ হাজার ৬৭৮ জন পরীক্ষার ফল পুনর্নিরীক্ষার আবেদন করেছিলেন। তাদের মধ্যে ১ হাজার ৩১৯ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। এবার ফেল থেকে এ বোর্ডে একজন পরীক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছেন। খাতা চ্যালেঞ্জ করে চট্টগ্রাম বোর্ডে ফেল থেকে পাস করেছেন ১০১জন শিক্ষার্থী। আর নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬১ জন। কুমিল্লা বোর্ডে ফেল থেকে পাস করেছেন ৯৩ জন। নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৩৬ জন। দিনাজপুর বোর্ডে ফেল থেকে পাস করেছেন ২৪ জন। নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১২ জন পরীক্ষার্থী। বরিশাল বোর্ডে ফেল থেকে পাস করেছেন একজন। আর নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ২৯ জন পরীক্ষার্থী।

এ বোর্ডের ৭ হাজার ২১ জন পরীক্ষার্থী ফল পুনর্নিরীক্ষার আবেদন করেছিলেন। তাদের মধ্যে ৮৯ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। ময়মনসিংহ বোর্ডে ফেল থেকে পাস করেছেন ৫৯৯ জন শিক্ষার্থী। আর নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৩২৩ জন। ফেল থেকে জিপিএ-৫ পেয়েছেন একজন। যশোর বোর্ড থেকে পাস করেছেন ২৭জন। নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১৭ জন।
রাজশাহী বোর্ডে ফেল থেকে পাস করেছেন ৯ জন, নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ১৪ জন পরীক্ষার্থী। সিলেট বোর্ডে ফেল থেকে পাস করেছেন ১৫ জন শিক্ষার্থী। আর নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৭ জন শিক্ষার্থী। আলিম পরীক্ষার খাতা পুনর্নিরীক্ষণে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে ফেল থেকে পাস করেছেন ১০ জন শিক্ষার্থী। আর নতুন জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬ জন পরীক্ষার্থী। এ বোর্ডের ২ হাজার ৭১৪ জন খাতা পুনর্নিরীক্ষণের আবেদন করেছিলেন। তাদের মধ্যে ৩৬ জনের ফল পরিবর্তন হয়েছে। গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার খাতা চ্যালেঞ্জ করে পাস করেছিলেন ফেল করা ১ হাজার ৩৯৮ জন পরীক্ষার্থী। নতুন করে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন ৫৮৫ জন। গত বছরও ফেল করার পর জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন একজন। 

বোর্ড পরীক্ষার পর ফলের পরিবর্তন প্রতিবছর যেভাবে হচ্ছে তাতে বোর্ডের ওপর শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের আস্থা দিন দিন কমতে শুরু করেছে। তাদের কাছে বিষয়টি এমন মনে হচ্ছে, বোর্ড পরীক্ষা মানেই এ ধরনের ভুল হবে আর দরখাস্ত করলে ফল পরিবর্তন হবে। পরীক্ষকদের খাতা মূল্যায়নে অবহেলার বিষয়টি স্বীকার করে আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও ঢাকা বোর্ড চেয়ারম্যান বলেন, আমরা প্রত্যেক বছরই পরীক্ষকদের ত্রুটি বিচ্যুতি পাই। পরীক্ষকদের ভুল-ভ্রান্তির পরিমাণের ওপর নির্ভর করে তাদের সাজা পেতে হবে। আগামী সপ্তাহে তালিকা তৈরি করে ব্ল্যাকলিস্টেড করবো আগামী পাঁচ বছরের জন্য। আমাদের সব পাবলিক এক্সামিনেশনে তাদেরকে পাঁচ বছরের জন্য অব্যাহতি দেবো। প্রত্যেক বছর মূল্যায়নের জন্য তাদেরকে পারিশ্রমিক দেয়া হতো, সেটা স্থগিত করা হবে। 

শিক্ষা বোর্ডগুলোর মধ্যে এক ধরনের অসহায়ত্ব প্রতীয়মান হচ্ছে। কারণ, বোর্ড পরীক্ষার খাতা যারা মূল্যায়ন করতে পারেন অর্থাৎ দেশের স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মেধাবী ও অভিজ্ঞ শিক্ষক তাদের অধিকাংশই সাধারণত বোর্ডের খাতা মূল্যায়নে অংশগ্রহণ করেন না। তার দুটি কারণ, একটি হচ্ছে বোর্ডের খাতা মূল্যায়নে যে পরিমাণ পারিশ্রমিক দেয়া হয় সেটি তাদের ক্ষেত্রে অপ্রতুল। দ্বিতীয়ত, নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়ানো, বিভিন্ন জায়গায় ক্লাস ও সেশন পরিচালনা করে ভালো অর্থ উপার্জন করেন। তারা খাতা মূল্যায়নের জন্য অতিরিক্ত সময় দিতে চান না। আবার অনেকে যারা খাতা আনেন তারাও খুব আন্তরিকতার সঙ্গে খাতা মূল্যায়ন করেন না। কারণ, বোর্ড তাদের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নিলে তারা পরীক্ষক হতে পারেন না, তারা আসলে সেটিই চান। ফলে, শিক্ষা বোর্ডগুলোকে এমনসব পরীক্ষকদের প্রতি নির্ভর করতে হয় যারা খাতা মূল্যায়ন করতে জানেন না, যাদের মধ্যে রয়েছে সততার অভাব এবং অনেক ক্ষেত্রেই অনভিজ্ঞ শিক্ষকদের দ্বারা খাতা মূল্যায়ন করাতে হয়। 

যেকোনো বিষয়ের খাতা মূল্যায়নের পূর্বে বোর্ডে প্রধান পরীক্ষক, পরীক্ষক ও বোর্ড কর্তৃপক্ষের সমন্বয়ে একটি কার্যকরী মিটিং হওয়ার রেওয়াজ বহু আগে থেকেই প্রচলিত ছিলো। সেটির এখন কী অবস্থা সঠিক জানি না। তবে আমরা যখন পরীক্ষক ছিলাম তখন দেখতাম ব্যক্তি বিশেষ অর্থাৎ যে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক যতো সিনসিয়ার, তার বোর্ডে এ ধরনের মিটিংগুলো মোটামুটি কার্যকরীভাবে হতো যদিও তখনকার শিক্ষকদের সততা, দায়িত্ববোধ বর্তমানের চেয়ে নিঃসেন্দেহে অনেক বেশি ছিলো। তারপরেও, অনেক শিক্ষক ওইসব সমন্বয় সভায় যোগদান করতেন না। যোগদান না করার অর্থ হচ্ছে তারা মূল বহু সমস্যা থেকে দূরে থাকতেন। ফলে, উত্তরপত্র মূল্যায়নে তখনো অনেক সমস্যা হতো। দিনে দিনে তা আরো বেড়ে গেছে। পরীক্ষায় পাসের হার হু হু করে বাড়ছে। তবে,  মান ও সততার জায়গাটিতে ঘাটতি যেনো আরো বেড়ে গেছে। 

 শিক্ষাক্ষেত্রে, শিক্ষাদানে ও মূল্যায়নে বহু পরিবর্তন ঘটেছে গোটা বিশ্বে। কিন্তু আমাদের শিক্ষাবোর্ডগুলো সেসব পরিবর্তনের সঙ্গে কতোটা পরিচিত, কতোটা খাপ খাওয়াতে অভ্যস্ত সেটি প্রশ্ন সাপেক্ষ। সেই মান্ধাতার আমলের মতোই খাতা মূল্যায়ন হচ্ছে, প্রশ্নপ্রত্র তৈরি হচ্ছে, শিক্ষকদের প্রস্তুতি ছাড়াই খাতা মূল্যায়ন করানো হচ্ছে। বরং রেজাল্ট তাড়াতাড়ি দেয়ার জন্য খাতা যেনতেন প্রকারে মূল্যায়ন করার একটি ট্র্যাডিশন বেশ কয়েকবছর লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আগে বোর্ড পরীক্ষার ফল দিতো কমপক্ষে তিনমাস পর, আর এখন দুমাসের কম সময়ের মধ্যে ফল দেয়ার হিড়িক যা প্রকৃতপক্ষে ভালো কোনো কিছু বয়ে আনে না। 

শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বোর্ড পরীক্ষকদের মূল্যায়ন কাজের জন্য তৈরি করা প্রতিটি শিক্ষাবোর্ডের একটি পবিত্র দায়িত্ব। খাতা মূল্যায়ন করা যেকোনো ধরনের কাজের চেয়ে পুরো আলাদা, এটি একটি মহত্তম দায়িত্ব, পবিত্রতম দায়িত্ব সেটি তাদেরকে মনেপ্রাণে বোঝাতে পারা বোর্ডের কাজ। এখানে শুধু অর্থ উপার্জন আর স্বল্প সময়ে খাতা মূল্যায়ন করাটাই মুল বিষয় নয়। আর এগুলো করার জন্য বোর্ড কর্তৃপক্ষকে ইনোভেটিভ ওয়েতে প্রতি বছর চিন্তা ভাবনা করতে হয়। কিন্তু তারা কি সেটি করেন? প্রতিটি সিদ্ধান্তের জন্য তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আমলাদের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে থাকেন যদিও তাদের মূল্যায়ন বিষয়ে অভিজ্ঞতা নেই, থাকার কথাও নয়। শিক্ষা বোর্ডগুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসনের তেমন কিছু দেখা যায় না। 

একটি বিষয়ের খাতা মূল্যায়নের জন্য কমপক্ষে তিনজন পরীক্ষক থাকা প্রয়োজন। কারণ, উত্তরপত্র মূল্যায়ন সাধারণ বিচারকদের চেয়েও বড় বিচারিক কাজ। এখানে তো অখ্যাত কোনো বিদ্যালয়ের বা কলেজের বা নতুন কোনো শিক্ষকের বা অমুকের আত্মীয় বলে বোর্ড পরীক্ষক হওয়ার কোনো সুযোগ থাকার কথা নয়। তিনজন পরীক্ষক খাতা দেখলে সবাই তটস্থ থাকবেন, সবাই সিনসিয়ারলি খাতা মূল্যায়ন করবেন এবং সে পদ্ধতির মাধ্যমে ফল তৈরি করাটা হবে জেনুইন। অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থী যে গ্রেড পাবেন, যে নম্বর পাবেন তার ওপর সবাই আস্থা রাখতে পারবেন।

পরবর্তী স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও বোর্ড পরীক্ষার ফলের ওপর পূর্ণ আস্থা রাখতে পারবে। এখন যেটি হয়, কারোরই কোনো আস্থা নেই। বোর্ডের মাধ্যমে পরীক্ষা দিতে হয়, তাই দেয়া। একটা নম্বর ফর্দ বা একটি সার্টিফিকেট নিতে হয় তাই নেয়া। কিন্তু ভর্তি ও চাকরির ক্ষেত্রে কেউই ওই ফলকে বিশ্বাস করে না, সবাই পুনবায় শিক্ষার্থীদের বাজিয়ে দেখতে চায়। এটি তো সত্যি কথা। বোর্ডগুলো এখানে নতুন কোনো পদ্ধতি আবিষ্কার করেনি। তারা সেই পরীক্ষক আর প্রধান পরীক্ষক ছাড়া নতুন কোনো পদ্ধতিতে উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে নতুনত্ব দেখাতে পারেনি। বোর্ডগুলো অহরহই দেখাচ্ছে ফেল করা থেকেও জিপিএ-৫ পাওয়া যায়। এসব জায়গায় বোর্ড কর্তৃপক্ষের বহু কাজ করার, বহু গবেষণার ও বহু ইনোভেশনের প্রযোজন রয়েছে। তারা কী কোনো ইনোভেশন নিয়ে আসবেন, না এই পুরাতন খেলাই খেলতে থাকবেন?
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক

জনপ্রিয়