ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪ , ১০ বৈশাখ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

nogod
nogod
bkash
bkash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
nogod
nogod
bkash
bkash

ফজল-এ-খোদা: মূল্যায়নহীন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব

মতামত

আনওয়ারুল কবীর বুলু

প্রকাশিত: ১৫:১৬, ২৯ জানুয়ারি ২০২৩

সর্বশেষ

ফজল-এ-খোদা: মূল্যায়নহীন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব

ফজল-এ-খোদা দেশের স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। একজন আলোচিত কবি-গীতিকার, শিশু সাহিত্যিক, সংগঠক ও পত্রিকার সম্পাদক। স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর  লেখা যে গানটি দেশবাসীকে সবচেয়ে বেশি অণুপ্রাণিত আর উজ্জ্বীবিত করেছিলো..সালাম সালাম হাজার সালাম.. শহীদ ভাইয়ের স্মরণে, আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই..। অথচ অবিস্মরণীয় গানের কন্ঠশিল্পী মোহাম্মদ আবদুল জব্বার একাধিক পুরস্কার এবং সম্মাননায় ভূষিত হলেও বরেণ্য গীতিকার ফজল-এ-খোদা স্বাধীনতার ৫২ বছরেও কোনো স্বীকৃতি পাননি! আশ্চর্য, জাতির কী দুর্ভাগ্য!  তাঁর সহধর্মিনী মাহমুদা সুলতানা কথাসাহিত্যিক। তাদের ৩ সন্তান। সাংবাদিক ও ছড়াকার ওয়াসিফ এ খোদা, সাংবাদিক সজীব ওনাসিস ও ব্যাঙ্কার ওয়েসিস এ খোদা। 

ফজল-এ-খোদার অসংখ্য জনপ্রিয় গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য..কলসি কাঁখে ঘাটে যায়, কখন তুমি আসবে আমায় বলো, আমি বন্ধুর শোকে হইলাম পাগল, ভালোবাসার মূল্য কতো, আমি প্রদীপের মতো রাত জেগে জেগে, ঢাকা শহর ঘুরতে এসে, যে দেশেতে দীঘির জলে শাপলা শালুক ভাসে, খুকুমনি রাগ করে না বায়না এমন ধরেনা, বাসন্তী রঙ শাড়ি পরে কোন সে বঁধুয়া চলে যায়' আমি মন রেখেছি তোমার মনের আঙিনায়, ডোরাকাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায় ইত্যাদি।

প্রথিতযশা সাহিত্যিক ফজল-এ-খোদার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩০। এর মধ্যে প্রেমের কবিতা, স্বরচিত একাধিক গানের বই, আত্মজীবনী। বিশেষত: শিশু-কিশোরদের জন্যে রচিত গ্রন্থ পাঠকমহলে অত্যন্ত সমাদৃত, প্রশংসিত। লিখেছেন ইসলামি গজলও। তিনি বাংলাদেশ বেতারের সাবেক আঞ্চলিক পরিচালক এবং ‘বেতার বাংলা’র তদানীন্তন সম্পাদক। শাপলা শালুক পত্রিকার  সম্পাদক ও সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক।  

একান্ত নিভৃতচারী ছিলেন ফজল-এ-খোদা। স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা! জীবনে চাওয়া-পাওয়ার ন্যূনতম আকাঙ্ক্ষা বুঝি কখনো ছিলো না তাঁর।

আধুনিক বাংলা গানের নন্দিত কন্ঠশিল্পী মো. আবদুল  জব্বার, বিশিষ্ট গীতিকার শ্রদ্ধেয় ফজল-এ-খোদা-উল্লেখিত দুটি নাম আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পৃক্ত..  ওতপ্রোতভাবে  জড়িত। জাতির ইতিহাসে  সত্যিই অনিবার্য স্মরণীয়-অনস্বীকার্য এই দুটি নাম। মরহুম জব্বার  একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন.. আমরা খুশি-আপ্লুত। জব্বার-একজন বরেণ্য গায়ক।

'সালাম  সালাম'এই গানের জন্য ফজল-এ-খোদা কোনো  জাতীয় পুরস্কার বা সম্মাননা পাননি। আমি সেজন্যে ব্যথিত। মাথা ঘামানোরও দরকার নেই। এটি জাতির লজ্জ্বা! বরণীয় ব্যক্তিত্বের  প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা। আর তিনি আমাদের অহঙ্কার। চিরদিনই মানুষের হৃদয়ে। মো.আবদুল জব্বার ও ফজল-এ-খোদা সঙ্গীতাঙ্গণে দুই  কিংবদন্তি। বিশিষ্ট গীতিকবি..সাহিত্যিক  ফজল-এ-খোদা এবং তাঁর  স্ত্রী  কথাশিল্পী  মাহমুদা  সুলতানা দুজনই করোনাক্রান্ত হয়ে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি হন। এখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নালিল্লাহি..রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৮০ বছর। স্রষ্টার কী খেলা!  তাঁর স্ত্রী সৌভাগ্যক্রমে সুস্থ হয়ে ওঠেন। তাঁর 'সালাম  সালাম  হাজার  সালাম' গানটি আমজনতাকে সেদিন স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবলভাবে  উদ্বুদ্ধ করেছিলো। ফজল-এ-খোদা জাতির  অহঙ্কার...একটি গর্বিত উচ্চারণ। স্মরণীয় এবং সমুজ্জ্বল এক ব্যক্তিত্ব। আমার  পরম শ্রদ্ধেয়..ভালোবাসার মানুষ। প্রিয় স্বজন। তিনি আমার নিকটাত্মীয়। আমার বড় ভায়রা। কবি-পত্নী মাহমুদা সুলতানার অপর তিন ভাই-বোনও সাহিত্যিক। এরা হলেন, যথাক্রম নাট্যকার আহমেদ আল মামুন, জুবায়ের আল মাহমুদ ও ফেরদৌসী সুলতানা রুনা। 

ফজল-এ-খোদা এই পৃথিবীর সমুদয় মায়া-মমতা ত্যাগ  করে পাড়ি  জমিয়েছেন আরেক ভূবণে..যেখান থেকে কেউ আর কখনো ফিরে আসে না ! ওগো করুণাময়..বেহেশতের সর্বোচ্চ  মর্যাদায়  এই  গুণী  ব্যক্তিকে  তুমি অভিষিক্ত  করো। তোমার আরশে ঠাঁই  দিও। 

একাত্তুরে স্বাধীনতাযুদ্ধের  উজ্জ্বীবক প্রাণশক্তি 'সালাম সালাম হাজার সালাম শহীদ ভাইয়ের' গানের কালজয়ী গীতিকার  স্মৃতিতে এখন দূরাকাশের কোনো জ্বলজ্বলে তারা! তিনি চিরদিনই আপন স্বকীয়তা ও মহিমায় দেদীপ্যমান। সবার  হৃদয়াসনে অধিষ্ঠিত। অজস্র জনপ্রিয় গানের ঈর্ষণীয় স্রষ্টা ফজল-এ-খোদা। কিন্তু জীবদ্দশাতে পাননি রাষ্ট্রীয়  কোনো স্বীকৃতি কিংবা কোনো পুরস্কার..সম্মাননা! 

তিনি ভূষিত হননি বিশেষ কোনো পদকে! তাঁর আরেকটি  শ্রোতানন্দিত..প্রশংসিত গান.. আমি..প্রদীপের মতো রাত জেগে জেগে নিজেকে  বিলিয়ে  দিলাম..আর বিনিময়ে শুধু  আঁধারের কাছে শূন্যতা খুঁজে পেলাম' অস্ফুট যন্ত্রণার আর্তনাদ ! হয়তো  হৃদয়ের তীব্র কোনো অভিব্যক্তি ! মৃত্যুর পর প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বকে রাজধানীর রায়েরবাজার কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। 

ফজল-এ-খোদা সম্পর্কে আরেক বিশিষ্ট গীতিকার মোহাম্মদ রফিকউজ্জামানের গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে। স্মৃতিচারণে তিনি লিখেছেন..আমরা বন্ধুবান্ধবরা তাঁকে ডাকতাম ‘ফজলে’ বলে। আসলে তাঁর নাম ফজল-এ-খোদা। কবে থেকে তিনি আমার এত ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন, তা আর এখন মনে করতে পারি না। একটা সময় আমরা প্রচুর আড্ডা দিতাম। তখন ধানমন্ডির দুই নম্বরের কোনায় ডিজি অফিসটা ছিল। ওখানে আমি প্রোগ্রাম প্লানিংয়ের লোক হয়ে বসতাম। শহীদুল ইসলাম বসতেন। ওখানেই ফজল-এ-খোদার বেতার বাংলার অফিস ছিলো। আর আশরাফুল আলমও ওখানে বসতেন। আমরা এই চারজন জম্পেশ আড্ডা দিতাম। 

ফজল-এ-খোদার সঙ্গে এই যে ঘনিষ্ঠতার কথা বললাম, এই ঘনিষ্ঠতার অনেক আগেই কিন্তু ফজল-এ-খোদা আমার কাছে একটি পরিচিত নাম। আমার প্রথম গান ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘এ-মাসের গান’ (চার সপ্তাহে একই গান চার শিল্পী এককভাবে গাইতেন) হিসেবে প্রচারিত হয়েছিলো। যেহেতু আমি ঢাকায় থাকতাম না, সেই কারণে আমার গান খুব কমই প্রচারিত হতো। তখন যাঁদের গান খুব বেশি প্রচারিত হতো, তাঁদের গান আমরা শুনতাম মনোযোগ দিয়ে।কবি আজিজুর রহমান তো ছিলেনই; এছাড়া ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল, ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, মাসুদ করিম, ফজল-এ-খোদা—এঁদের গান খুব শুনতাম। 

আমি ঢাকায় এলাম ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে। ঢাকায় আসবার আগ পর্যন্ত এই বিশিষ্ট কয়েকজনের নামই আমি জানতাম। ফজল-এ-খোদা বিভিন্ন ধরনের গান লিখেছেন। আমাদের যখন সংগ্রাম চলছে, তখনও স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়নি। মিছিল চলছে, মিটিং চলছে সর্বত্র রাস্তায় রাস্তায়। শহীদ হচ্ছে পুলিশের গুলিতে, আর্মির গুলিতে আমাদের মতো মানুষ। সাধারণ মানুষেরা। তো এই অনুভূতিটিকে নিয়েই বঙ্গবন্ধুর একটা প্রচ্ছন্ন নির্দেশে ফজল-এ-খোদার যে গানটি ঢাকা রেডিওতে রেকর্ড হয়েছিল—সেই গানটি চিরকালীন হয়ে গেছে। বাংলা গানে, বাংলাদেশের বাংলা গানে যদি নাম করতে হয়, তাহলে চিরকালের গানের মধ্যে সেই গান একটি—‘সালাম সালাম হাজার সালাম, সকল শহীদ স্মরণে’। এ-গান স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিনিয়ত বেজেছে। তার আগ পর্যন্ত ঢাকা রেডিও থেকে নিয়মিতই প্রচারিত হয়েছে। এই গানটির জন্য আমাদের কাছে যখন পরিচিত মুখ হয়ে গেলেন ফজল-এ-খোদা। ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ এটুকু শুনলেই ওঁর চেহারাটা ভেসে উঠতো। ফজল-এ-খোদার কত গান। দুটি বই আছে—‘আধুনিক বাংলাগান রচনার কলাকৌশল’ এবং ‘বাংলা গান রচনাকৌশল ও শুদ্ধতা’। পরে প্রথম বইটি বাদ দিয়ে দ্বিতীয় বইটিকে নেওয়া হয়েছে। ফজল-এ-খোদা নিজের টাকায় এই বইয়ের কয়েকশ কপি কিনেছেন! 

ফজল-এ-খোদা বাংলাদেশপ্রেমি একজন কবি। তাঁর ‘কাজল মাটির গান’ নামে একটি বই আছে, যেখানে আমাদের গ্রামের বিচিত্র চিত্র আছে গানগুলোর মধ্যে। অপূর্ব সুন্দর তাঁর যে নির্বাচিত গানের বইটি, সেটি প্রকাশিত হয়েছিল শিল্পকলা একাডেমি থেকে। বড় দুঃখ—বাংলা একাডেমি তাঁকে চিনলো না। বাংলা একাডেমি কেনো জানি না গানের কবিতাকে কবিতা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়। যে বাংলা কবিতা আর বাংলাভাষার জন্মই হয়েছে গানের মধ্যে দিয়ে। আমরা সর্বপ্রাচীন যা এ পর্যন্ত পেয়েছি—চর্যাপদ, সেই চর্যাপদের সমস্ত কবিতার ওপরে রাগের নাম তালের নাম লেখা আছে। অর্থাৎ সেটি গান। যে ভাষা জেগে উঠেছে গানের মধ্যে দিয়ে, সেই ভাষার গানের কবিতাকে কবিতা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না—এটা আমার কাছে সাহিত্যভক্ত মানুষের কাজ বলে মনে হয় না।
ফজল-এ-খোদা বাংলা গানের চিরঞ্জীব এক সত্তা। কালজয়ী অনন্য প্রতিভা।

জনপ্রিয়