
বই পড়া একসময় মানুষের জ্ঞানার্জন, বিনোদন ও মনের প্রশান্তি লাভের একটি প্রধান মাধ্যম ছিলো। কিন্তু আধুনিক যুগে এই অভ্যাস উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যাচ্ছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, পরিবর্তিত জীবনযাত্রা এবং সামাজিক পরিবর্তনের প্রভাবে বই পড়া যেনো দিন দিন পেছনে পড়ে যাচ্ছে। বর্তমান প্রজন্মের কাছে বই পড়া আগের মতো আকর্ষণীয় মনে হয় না। এই প্রবন্ধে বই পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়ার কারণ এর প্রভাব এবং এ সমস্যা সমাধানের উপায় নিয়ে বিশদ আলোচনার চেষ্টা করছি।
১. প্রযুক্তির আকর্ষণ
প্রযুক্তির অগ্রগতি আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এনেছে। এর প্রভাব বই পড়ার অভ্যাসেও পড়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া এবং মনোযোগের সমস্যা ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটকের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো আজকাল মানুষের দৈনন্দিন জীবনের একটি বড় অংশ দখল করে নিয়েছে। এই প্ল্যাটফর্মগুলো আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে এবং তা ধরে রাখতে খুবই দক্ষ। ছোট ছোট ভিডিও, ছবির পোস্ট, এবং মজাদার কনটেন্টের ভিড়ে বই পড়ার জন্য দীর্ঘ সময় মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
স্ট্রিমিং সেবা এবং গেমিং: নেটফ্লিক্স, ইউটিউব এবং ডিজনি প্লাসের মতো স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলো সহজলভ্য হয়ে যাওয়ায় মানুষ বিনোদনের জন্য বই পড়ার পরিবর্তে সিনেমা বা সিরিজ দেখাকে প্রাধান্য দিচ্ছে। একই সঙ্গে, ভিডিও গেমগুলো তরুণ প্রজন্মের জন্য এক ধরনের আসক্তি তৈরি করেছে, যা তাদের বইয়ের প্রতি আগ্রহকে কমিয়ে দিচ্ছে।
ই-বুক এবং অডিওবুক: যদিও ই-বুক এবং অডিওবুক বই পড়ার নতুন মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছে, এগুলো ঐতিহ্যবাহী বই পড়ার অভ্যাসকে পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করতে পারেনি। ডিভাইসের নোটিফিকেশন বা অন্যান্য ডিজিটাল বিভ্রান্তির কারণে ই-বুক পড়া প্রায়ই মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটায়।
২. ব্যস্ত জীবনযাপন ও অগ্রাধিকার পরিবর্তন
সময়ের অভাব: আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা বই পড়ার অভ্যাসে বড় প্রভাব ফেলেছে। কর্মজীবন, পরিবার, এবং সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেকেই বই পড়ার জন্য সময় বের করতে পারেন না। এমনকি যারা অবসর সময় পান, তারাও তা ভিডিও দেখা বা সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করার মতো সহজ বিনোদনে ব্যয় করেন।
উৎপাদনশীলতার প্রতি অতিরিক্ত গুরুত্ব: আজকের সমাজে এমন একটি ধারণা গড়ে উঠেছে যে সবকিছুতে ‘উৎপাদনশীল’ হতে হবে। বই পড়া, বিশেষত যদি তা শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য হয়, অনেকের কাছে ‘অপচয়’ মনে হয়। ফলে মানুষ বই পড়াকে অগ্রাধিকার দিতে চায় না।
ছোট আকারের কন্টেন্টের প্রতি আকর্ষণ: বর্তমানে মানুষের মনোযোগ ছোট আকারের কন্টেন্টে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। ব্লগ, আর্টিকেল বা সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে তথ্য পাওয়া সহজ হওয়ায় দীর্ঘ আকারের বই পড়া অনেকের কাছে সময়সাপেক্ষ মনে হয়।
৩. শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন
শিক্ষাব্যবস্থা একটি জাতির মধ্যে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কিন্তু বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে যা এই অভ্যাসকে বাধাগ্রস্ত করছে।
একাডেমিক চাপ: স্কুল এবং কলেজে পড়ুয়াদের বই পড়া প্রায়ই শুধুমাত্র পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত পাঠ্যবইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। ফলে শিক্ষার্থীরা বই পড়াকে আনন্দের পরিবর্তে দায়িত্ব মনে করে। এই মানসিকতা দীর্ঘমেয়াদে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দেয়।
সারাংশ নির্ভরতা: ইন্টারনেটের সহজলভ্যতার কারণে শিক্ষার্থীরা অনেক সময় সম্পূর্ণ বই না পড়ে সারাংশ বা ভিডিও টিউটোরিয়াল দেখে বিষয়টি বুঝে নিতে চেষ্টা করে। এটি গভীর পাঠাভ্যাসের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে।
লাইব্রেরির ব্যবহার কমে যাওয়া: স্কুল এবং কলেজে লাইব্রেরির ব্যবহার আগের মতো নেই। অনেক প্রতিষ্ঠানেই পর্যাপ্ত বইয়ের অভাব বা লাইব্রেরি ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করা যায়। ফলস্বরূপ, শিক্ষার্থীরা নতুন নতুন বই আবিষ্কার করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
৪. অর্থনৈতিক ও প্রবেশযোগ্যতার সমস্যা
বইয়ের উচ্চমূল্য: অনেক মানুষের জন্য বই কেনা একটি ব্যয়বহুল বিষয়। নিম্ন আয়ের পরিবারে বই কিনতে চাওয়া বিলাসিতা বলে বিবেচিত হয়।
লাইব্রেরি এবং বুকস্টোরের সংকট: লাইব্রেরি এবং স্বাধীন বুকস্টোরগুলো অনেক জায়গায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বিশেষত গ্রামীণ অঞ্চলে এই সংকট আরো তীব্র। ডিজিটাল মাধ্যমে বই পাওয়া সহজ হলেও এই মাধ্যমগুলো সবসময় সবার জন্য প্রবেশযোগ্য নয়।
ভাষাগত এবং সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতা: সব জায়গায় স্থানীয় ভাষায় মানসম্মত বই পাওয়া যায় না। ফলে, অনেক মানুষ বই পড়তে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে কারণ তারা তাদের সংস্কৃতি বা ভাষার সঙ্গে সংযুক্ত বই পায় না।
৫. মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব
বই পড়া একটি ধৈর্য ও মনোযোগের কাজ। কিন্তু আধুনিক যুগে এমন অনেক বিষয় আছে যা মানুষের মানসিকতা এবং মনোযোগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
মনোযোগের ঘাটতি: সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে মানুষের মনোযোগের পরিধি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। স্মার্টফোন এবং দ্রুতগতির ইন্টারনেটের কারণে গভীর মনোযোগ ধরে রাখার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে, যা বই পড়ার মতো মনোযোগী কাজের জন্য প্রয়োজনীয়।
মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ: আধুনিক জীবনের চাপ ও উদ্বেগ অনেক সময় বই পড়ার ইচ্ছাকে দমন করে। মানুষ তখন সহজ এবং কম চিন্তাশীল কাজের দিকে ঝুঁকে পড়ে, যেমন টিভি দেখা বা গেম খেলা।
ফোমো: ‘ফিয়ার অব মিসিং আউট’ বা ফোমো একটি মানসিক চাপ, যেখানে মানুষ অনুভব করে যে তারা কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা প্রবণতা থেকে পিছিয়ে পড়ছে। এই মানসিকতা বই পড়ার মতো মনোযোগী কাজে বাধা সৃষ্টি করে।
৬. সংস্কৃতি ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা
বই পড়ার প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি: অনেক তরুণ প্রজন্ম বই পড়াকে ‘পুরনো দিনের কাজ’ বলে মনে করে। তারা মনে করে যে সিনেমা, ভিডিও গেম বা সোশ্যাল মিডিয়া বইয়ের চেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ও সময়োপযোগী।
সামাজিক স্বীকৃতি এবং চাপ: সোশ্যাল মিডিয়া যুগে এমন একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে যেখানে ট্রেন্ড অনুসরণ করাকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। বই পড়া, যা মূলত একটি একাকী কার্যকলাপ, এখানে তেমন আকর্ষণীয় বলে মনে হয় না।
বই পড়ার অভ্যাস পুনরুজ্জীবিত করার উপায়
বই পড়ার অভ্যাস ফিরিয়ে আনার জন্য ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজের সম্মিলিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
১. পড়ার সময় নির্ধারণ
প্রতিদিন ১৫-৩০ মিনিট বই পড়ার জন্য সময় নির্ধারণ করলে অভ্যাস তৈরি হয়। সকালে বা রাতে শোয়ার আগে বই পড়া ভালো একটি অভ্যাস হতে পারে।
২. স্কুল ও কলেজে বই পড়ার প্রচার
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বই পড়াকে শুধুমাত্র পরীক্ষার জন্য নয় ও আনন্দের জন্য উৎসাহিত করা উচিত। বিভিন্ন সাহিত্যিক প্রতিযোগিতা বা বই মেলা আয়োজন করলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ বাড়বে।
৩. প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার
ই-বুক, অডিওবুক, এবং পড়ার অ্যাপ ব্যবহার করে বই পড়া সহজ এবং আকর্ষণীয় করা যেতে পারে।
৪. পরিবারে পড়ার সংস্কৃতি গড়ে তোলা
পরিবারে অভিভাবকরা পড়ার অভ্যাস তৈরি করলে শিশুরাও তাতে উৎসাহিত হবে। পরিবারে একসঙ্গে পড়ার সময় নির্ধারণ একটি ভালো উদ্যোগ হতে পারে।
৫. বই সহজলভ্য করা
সুলভ মূল্যে বই সরবরাহ করা এবং গ্রামে-গ্রামে লাইব্রেরি স্থাপন করার উদ্যোগ নিতে হবে।
উপসংহার: বই পড়ার অভ্যাস কমে যাওয়া আমাদের ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এটি শুধু জ্ঞানার্জনই নয়, বরং সৃজনশীলতা এবং মানসিক প্রশান্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। প্রযুক্তি, সময়ের অভাব, এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বই পড়ার অভ্যাস পুনরুদ্ধার করা সম্ভব। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টা, পারিবারিক সহযোগিতা ও সামাজিক উদ্যোগের মাধ্যমে আমরা এই মূল্যবান অভ্যাসটিকে টিকিয়ে রাখতে পারি। কারণ, বই শুধু তথ্যের ভান্ডার নয়; এটি আমাদের কল্পনা ও বোধের দিগন্তকে প্রসারিত করে।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়