মওলানা মুহাম্মদ নুরুদ্দিন ফতেহপুরী ছিলেন শিলালিপি বিশেষজ্ঞ এবং আরবী, ফারসি ও উর্দু ভাষার সুপণ্ডিত ও ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সম্পাদক। এই লেখক-গবেষক-অনুবাদক বিগত শতকের আশির দশকে সরজমিনের মাধ্যমে বিভিন্ন অপ্রকাশিত শিলালিপির পাঠ সংগ্রহ শুরু করেছিলেন। বাংলাদেশে ইতিহাস চর্চায় সরজমিনের মাধ্যমে শিলালিপির পাঠ সংগ্রহ তিনিই প্রথম শুরু করেছিলেন।
মওলানা ফতেহপুরী ২০১০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তিনি ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটির শিলালিপি বিষয়ক প্রকাশিতব্য গ্রন্থের অন্যতম সম্পাদক হিসাবে যুক্ত হন। সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া, অন্যতম সম্পাদক মওলানা ফতেহ্পুরী এবং অন্য সম্পাদকরা মিলে ইতিমধ্যেই ঢাকার প্রাচীন শিলালিপিসমূহের পাঠ, উচ্চারণ ও অনুবাদ সম্পাদনার কাজ সমাপ্ত করেছেন।
মওলানা ফতেহ্পুরী বিভিন্ন ভাষায় সৃজনশীল ও মননশীল গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘বিন্দুবিহীন বর্ণে মহানবী (সা.)’ ‘বিন্দুবিহীন বর্ণে বাংলাদেশ’, ‘কুন্তু লা আদরী’ (উর্দু ভাষায় লেখা গল্প গ্রন্থ), শেখ সাদির কাব্য ‘কারিমা’ (অনুবাদ), সুফী কবিতার সংকলন ‘জজবায়ে মারেফত’ (অনুবাদ) ইত্যাদি।
লেখক-গবেষক-অনুবাদক মওলানা ফতেহপুরী ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার মুক্তারপুর ইউনিয়নের পোটন (ফতেহ্পুর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমে পড়াশোনা করেন মইশাইর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর গ্রামের মেহতাহুল মাদ্রাসা ও বড় কাটরা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। তার পরিকল্পনা ছিল ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দে উচ্চতর পড়াশোনা করা। কিন্ত ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কারণে তার পরিকল্পনা ব্যাহত হয়। এরপর ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি করাচীর জামেয়া ইসলামিয়ায় হাদিস বিষয়ে এবং ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে লাহোরের জামেয়া আশরাফিয়ায় হাদিস ও এলমে ক্বেরাত বিয়য়ে পড়াশোনা করেন।
মওলানা ফতেহপুরী বড় কাটরা মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছেন, ছাত্রজীবন শেষে দীর্ঘদিন শিক্ষকতাও করেন বড় কাটরা মাদ্রাসায়। ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন মুঘল স্থাপত্য বড় কাটরা থেকেই। নব্বই দশকের প্রথমভাগে দলীয় রাজনীতির প্রভাবে কওমী ধারার ঐতিহ্যবাহি এই মাদ্রাসায় অস্থিরতা তৈরি হলে তিনি সেখান থেকে চলে আসেন। এরপর শিক্ষকতা করেন খাজে দেওয়ান লেন মহিলা মাদ্রাসায়। শিক্ষকতার পাশাপাশি লালবাগের অন্যতম মুঘল স্থাপত্য বড় ভাট মসজিদের খতিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন ৬০ এর দশক থেকে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে তিনি গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার পোটান গ্রামে নিজের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। সেখানেই গত মঙ্গলবার বেলা আড়াইটায় বার্ধক্যজনিত কারণে তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, দুই পুত্র, দুই কন্যাসহ অসংখ্য ছাত্র, ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ী রেখে গেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটির পরিচালনা পরিষদের সদস্য তরুণ সরকার স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
গতকাল বুধবার সকালে মওলানা ফতেহপুরীর নামাজে জানাজা পোটনে তাঁর নিজ বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। তারপর তার মরদেহ আনা হয় ঢাকার বড় ভাট মসজিদে। সেখানে হয় দ্বিতীয় জানাজা। তারপর তাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।
ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এক শোক বিবৃতিতে মওলানা মুহাম্মদ নুরদ্দিন ফতেহ্পুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন। বিৃবতিতে তিনি বলেন, মওলানা ফতেহ্পুরী ছিলেন একজন জ্ঞানসাধক। তাঁর মৃত্যুতে একদিকে যেমন ঢাকার স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ প্রণয়ন কমিটির ঢাকার ইতিহাস বিষয়ক গবেষণা কাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, অন্যদিকে জাতীয় পর্যায়েও প্রাচীন শিলালিপি বিশেষত আরবি, ফার্সি, উর্দু শিলালিপির চর্চায় এক গভীর শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। গবেষক মওলানা ফতেহ্পুরীর জীবনাদর্শ অনুসরণ করতে কমিটি সচেষ্ট থাকবে। বিবৃতিতে তিনি শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।