কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক চাঞ্চল্যকর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বাংলাদেশ-ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠা ভয়াবহ কিডনি পাচারচক্রের ভয়াল বাস্তবতা। বিশেষ করে জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বাইগুনি গ্রামকে ঘিরে একটি চক্রের অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছে, যেখানে দরিদ্র মানুষদের অর্থের লোভ দেখিয়ে কিডনি বিক্রি করানো হচ্ছে। তাদেরই একজন ৪৫ বছর বয়সি সাফিরুদ্দিন। গত বছরের গ্রীষ্মে তিনি ভারতে গিয়ে নিজের কিডনি বিক্রি করেন সাড়ে তিন লাখ টাকায়। ভেবেছিলেন এই টাকা পেলে তার পরিবার আর দরিদ্র থাকবে না। তিন সন্তানের জন্য বাড়ি বানাতে পারবেন। কিন্তু সেই টাকা এখন শেষ, বাড়িও অসম্পূর্ণ আর ব্যথা তাকে ভোগাচ্ছে।
এখন সাফিরুদ্দিন একটি কোল্ড স্টোরেজে দিনমজুরের কাজ করেন। কিন্তু তার শরীর খারাপ হওয়ায় কাজ করাও কঠিন হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আমি কিডনি বিক্রি করেছি, যাতে আমার পরিবারের সদস্যরা আরো ভালোভাবে জীবনযাপন করতে পারে। আমি আমার স্ত্রী এবং সন্তানদের জন্য সবকিছু করেছি।
সাফিরুদ্দিন জানান, কিডনি বিক্রির সময় বিষয়টি খুব বিপজ্জনক মনে হয়নি। দালালরা বলেছিল এটা একটা সুযোগ, কোনো ভয় নেই। প্রথমে সন্দেহ হলেও শেষমেশ দারিদ্র্য আমাকে রাজি হতে বাধ্য করে।
বাইগুনি গ্রামের এই বাসিন্দা আরো জানান, দালালরা তাকে মেডিক্যাল ভিসায় ভারতে নিয়ে গিয়েছিল। সব ব্যবস্থা তারা করেছিল। ভারতে যাওয়ার পর তার পাসপোর্টটাই তার নিজের ছিল। বাকি কাগজপত্র জাল করেছিল দালালরা। তার পরিচয় বদলে দেওয়া হয়েছিল আর তার কিডনি অজানা একজনের শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল, যাকে তিনি কখনো দেখেননি।
তবে ভারতের আইন অনুযায়ী শুধু ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের মধ্যে অথবা সরকারের অনুমতি নিয়ে কিডনি দেওয়া যায়। কিন্তু বিষয়টি এড়াতে দালালরা জালিয়াতির আশ্রয় নেয়। তারা পারিবারিক সম্পর্ক, হাসপাতালের কাগজপত্র, এমনকি ডিএনএ টেস্ট পর্যন্ত জাল করে।
দক্ষিণ এশিয়ায় অঙ্গ পাচার নিয়ে গবেষণা করছেন মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অঙ্গ প্রতিস্থাপনসংক্রান্ত টাস্কফোর্সের সদস্য মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, সাধারণত বিক্রেতার নাম বদলে দেওয়া হয় এবং আইনজীবীর কাছ থেকে নেওয়া নোটারি সনদ দিয়ে দেখানো হয় তারা সম্পর্কে আত্মীয়।
সাফিরুদ্দিনের মতো তার গ্রামের অনেকেই কিডনি বিক্রি করেছেন। এটি সেখানে একটি সাধারণ ঘটনা। ফলে গ্রামটিকে স্থানীয়রা ‘এক কিডনির গ্রাম’ বলে ডাকেন। কালাই উপজেলার এই এলাকা এখন কিডনি পাচারের কেন্দ্র। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে একটি গবেষণায় দেখা যায়, এখানকার প্রতি ৩৫ জন প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে একজন কিডনি বিক্রি করে দিয়েছেন।
কালাই বাংলাদেশের দরিদ্র উপজেলাগুলোর একটি। এ উপজেলার বেশিরভাগ কিডনি বিক্রেতা পুরুষের বয়স ৩০ বছরের আশপাশে। তারা সহজে দ্রুত টাকা পাবেন- এমন কথা শুনে কিডনি বিক্রি করেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৩ শতাংশই দারিদ্র্যের কথা বলে কিডনি বিক্রি করেছেন। কিছু লোক ঋণ পরিশোধ, মাদকাসক্তি বা জুয়ার জন্য কিডনি বিক্রি করেছেন।
সাফিরুদ্দিন বলেন, দালালরা তার পাসপোর্ট নিয়ে গিয়েছিল। তা আর কখনো ফেরত দেয়নি। অপারেশনের পর যে ওষুধগুলো দরকার ছিল, সেগুলোও দেয়নি। তারা আমার সবকিছু নিয়ে গেছে।
অস্ত্রোপচারের পর দালালরা প্রায়ই পাসপোর্ট এবং মেডিকেল প্রেসক্রিপশন রেখে দেয়, যাতে বোঝা না যায় কিডনি নেওয়া হয়েছে।
এসব কিডনি বাংলাদেশ বা ভারতের ধনী গ্রহীতাদের কাছে বিক্রি করা হয়। তাদের অনেকেই দীর্ঘ সময় এবং কঠোর নিয়মকানুন এড়িয়ে যেতে চান। উদাহরণস্বরূপ ভারতে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রায় ১৩ হাজার ৬০০টি কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয়, যেখানে প্রতি বছর আনুমানিক দুই লাখ রোগী কিডনি রোগে আক্রান্ত হন।
বাংলাদেশের অনেক কিডনি বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলেছে আলজাজিরা, যাদের গল্প প্রায় একই। আর তা হলো—দারিদ্র্যের কারণে তারা কিডনি বিক্রি করেছেন। এ ব্যবসার কারণ খুব সহজ, দারিদ্র্য কিডনি বিক্রেতা তৈরি করে আর ধনী মানুষ দ্রুত কিডনি পেতে চায়। সেই সঙ্গে আইন কঠোর না থাকায় এ ব্যবসা থামছে না।
কালাই উপজেলার বিনাই গ্রামের ৪৫ বছর বয়সি বিধবা জ্যোৎস্না বেগম তার দুই মেয়েকে বড় করার জন্য সংগ্রাম করছিলেন। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি ঢাকায় গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করতে যান। সেখানে বেলাল নামে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং তারা বিয়ে করেন। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে দালালদের প্রলোভনে জ্যোৎস্না আর বেলাল দুজনই ভারতে কিডনি বিক্রি করেন।
জোৎস্না বলেন, প্রথমে দালালরা পাঁচ লাখ টাকা দেবে বলেছিল। পরে বাড়িয়ে সাত লাখ বললেও শেষ পর্যন্ত মাত্র তিন লাখ টাকা দিয়েছে। কলকাতার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আন্তর্জাতিক কার্ডিয়াক বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে আমাদের অপারেশন হয়। দালালরা জাল কাগজপত্র বানিয়ে কিডনি বিক্রি করে। কাগজপত্রে কিডনিগ্রহীতাকে আত্মীয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিয়াক সায়েন্সেসের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে আলজাজিরার মন্তব্যের অনুরোধের কোনো সাড়া দেননি।
অনেক সময় যারা কিডনি পাচারের শিকার হন, তারাই পরে এই অবৈধ কারবারের অংশ হয়ে যান। মোহাম্মদ সজল (ছদ্মনাম) আগে ঢাকায় ব্যবসা করতেন। তিনি ইভ্যালির মাধ্যমে প্রেশার কুকার, প্লাস্টিকের জিনিস, ব্লেন্ডার ইত্যাদি বিক্রি করতেন। ইভ্যালি বড় লাভের আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু ২০২১ সালে ইভ্যালির ধস নামার পর সজল সবকিছু হারান, তার সঞ্চয় এবং ব্যবসা দুইই শেষ হয়ে যায়। ভাগ্য বিপর্যয়ে পড়ে এবং ঋণের চাপে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দিল্লির ভেঙ্কটেশ্বর হাসপাতালে নিজের কিডনি বিক্রি করেন। দালালরা তাকে ১০ লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলেছিল কিন্তু তিনি পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে তিন লাখ টাকা। তিনি বলেন, তারা আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে।
সজল ভাবছিলেন, কিডনি বিক্রি করে যে টাকা পাওয়ার কথা ছিল, সেটা যদি পেতে হয়, তাহলে তাকেও এই দালালদের সঙ্গে কাজ করতে হবে। এরপর কয়েক মাস তিনি দালাল হিসেবে কাজ করেন। বাংলাদেশের অনেক মানুষকে তিনি ভারতীয় হাসপাতালে কিডনি দিতে নিয়ে গেছেন। পরে টাকা ভাগাভাগি নিয়ে দালালদের সঙ্গে ঝামেলা হয়। তখন প্রাণের ভয়ে তিনি এ কাজ ছেড়ে দেন।
বাংলাদেশ পুলিশ জানিয়েছে, আন্তর্জাতিক এই কিডনি পাচার বন্ধ করতে তারা কাজ করছে। বাংলাদেশ পুলিশের সহকারী মহাপরিদর্শক এনামুল হক সাগর বলেন, কিডনি পাচার চক্রকে খুঁজে বের করতে মাঠে কাজ চলছে।
অন্যদিকে, ভারতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কিছু ডাক্তারকে গ্রেপ্তার করেছে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে দিল্লি পুলিশ বিজয়া রাজাকুমারী নামে ৫০ বছর বয়সি এক কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জনকে গ্রেপ্তার করে। তদন্তে জানা যায়, ২০২১ থেকে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তিনি দিল্লির একটি বেসরকারি হাসপাতালে প্রায় ১৫ জন বাংলাদেশি রোগীর কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব গ্রেপ্তার এতই কম আর বিচ্ছিন্ন যে, এতে কিডনি পাচারে আসলে তেমন কোনো বড় ধাক্কা লাগে না। এ ব্যবসার মূল কাঠামো ঠিকই চালু থাকে। বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, ভারত সরকারের ওপর দুদিক থেকে চাপ আছে- একদিকে আইন ঠিকভাবে চালানো, অন্যদিকে মেডিকেল ট্যুরিজম বা চিকিৎসা ভ্রমণ ব্যবসা বাড়ানো। ২০২৪ সালে এ খাত থেকে ভারতে ৭ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে।
গবেষক মনিরুজ্জামান বলেন, ভারত এখন আইন ও নৈতিকতার দিকটা ঠিকমতো দেখছে না। তারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এ ব্যবসা থেকে আসা অর্থের দিকে। এজন্যই অবৈধ কিডনি প্রতিস্থাপন সহজেই চলছে।
ভারতের ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দের মানব অঙ্গ প্রতিস্থাপন আইন অনুযায়ী, কিডনি প্রতিস্থাপন সাধারণত বাবা-মা, ভাই-বোন, সন্তান বা স্বামী-স্ত্রীর মতো কাছের আত্মীয়দের মধ্যেই করা যায়। আত্মীয় না হলে সরকারের বিশেষ অনুমতি কমিটি থেকে অনুমোদন নিতে হয়। এর মূল উদ্দেশ্য কেউ টাকার লোভে যেন কিডনি দিতে না পারেন। কিন্তু দালালরা এ নিয়ম সহজেই ফাঁকি দেয়। তারা ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে দাতা ও গ্রহীতার মধ্যে মিথ্যা আত্মীয়তার সম্পর্ক দেখায়।
ঢাকায় বাংলাদেশের এক কর্মকর্তা শাহ মোহাম্মদ তানভীর মনসুর বলেন, এই জাল কাগজপত্র তৈরির সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারি কেউ জড়িত নয় এবং বাংলাদেশ সব আইনি নিয়ম ঠিকমতো অনুসরণ করে।
দিল্লির পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, অনেক সময় হাসপাতাল বোর্ড এই জাল কাগজ চিনতে পারে না, তাই অবৈধ প্রতিস্থাপন হয়।
গবেষক মনিরুজ্জামান বলেন, অনেক হাসপাতাল ইচ্ছা করেই এসব ভুল দেখে না। কারণ কিডনি প্রতিস্থাপন বাড়লে তাদের আয়ও বাড়ে।
মিজানুর রহমান নামে বাংলাদেশের এক দালাল বলেন, দালালরা অনেক সময় ভারতের ডাক্তার বা হাসপাতালের কমিটির লোকেদের ঘুস দেয়। বাংলাদেশের দালালরা ভারতের দালালদের সঙ্গে সব সময় যোগাযোগে রাখে। ভারতের দালালরাই ডাক্তার ঠিক করে দেয়। অনেক সময় ডাক্তাররাই এ টাকার বড় অংশ নিয়ে নেন।
ভারতের অঙ্গ প্রতিস্থাপন সংস্থার শীর্ষ এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি। তবে সংস্থার সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, অনেক সময় হাসপাতালগুলো দালাল, দাতা এবং ধনী রোগীর চাপের মধ্যে পড়ে। যদি হাসপাতাল বোর্ড রাজি না হয়, ধনী রোগীরা অনেক সময় উচ্চপর্যায়ে অভিযোগ করেন বা আদালতে যান। এ ঝামেলা এড়াতে হাসপাতালগুলো অনেক সময় অস্ত্রোপচার করে ফেলে।
দালাল আর সংশ্লিষ্ট হাসপাতালগুলোর জন্য এই কিডনি পাচার বড় ধরনের লাভের সুযোগ। কিডনি নিতে চাইলে অনেক সময় একজন রোগী ২২ থেকে ২৬ হাজার ডলার পর্যন্ত দেন। কিন্তু যিনি কিডনি দেন, তিনি এ টাকার খুব সামান্য অংশই পান। দালাল মিজানুর রহমান বললেন, সাধারণত দাতারা তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা পান।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সহযোগী পরিচালক শরীফুল হাসান বলেন, অনেকে সত্যিই চরম দারিদ্র্যের কারণে কিডনি বিক্রি করেন। তাদের মধ্যে অনেকেই প্রতারণার শিকার হন। ভারতে কোনো ধনী রোগীর কিডনি দরকার হলে দালালরা বাংলাদেশের কোনো গরিব দাতা খুঁজে বের করে বা চাকরির লোভ দেখিয়ে কাউকে নিয়ে যায়। এই চক্র এভাবেই চলতে থাকে।
ভারতের কিডনি রোগীদের সহায়তা করা সংগঠন ‘কিডনি ওয়ারিয়রস ফাউন্ডেশন’-এর প্রধান রঘুবংশী বলেন, ভারতে বৈধ দাতার অভাবই এই পাচার ব্যবসার বড় কারণ। অত্যন্ত অসহায় রোগীরা তখন অবৈধ পথে কিডনি খোঁজেন আর এ সুযোগে গরিব মানুষরা ফাঁদে পড়েন।