তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম স্বার্থক ঔপন্যাসিক। প্রথম স্বার্থক উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের দ্বার উন্মোচন করেন। তার নাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে অবিভক্ত বাংলার উত্তর চব্বিশ পরগনার নৈহাটি শহরের কাঁঠালপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বঙ্কিমচন্দ্র। তিনি উনিশ শতকের বিখ্যাত বাঙালি ঔপন্যাসিক।[insid-ad-1]
জীবিকাসূত্রে ছিলেন বিট্রিশ রাজ্যের কর্মকর্তা। তা সত্ত্বেও বাংলা সাহিত্যের গদ্য ও উপন্যাসের ধারায় তিনি অমর হয়ে আছেন। তাকে বলা হয় বাংলা উপন্যাসের জনক। ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৮৮৭ পর্যন্ত তিনি পনেরটি উপন্যাস লিখেছেন। উপন্যাসগুলোতে মোটাদাগে তিনটি শ্রেণিতে মেলে ধরা যেতে পারে। যথা- ইতিহাসাশ্রয়ী রোমান্সধর্মী, সামাজিক ও দেশাত্মবোধক উপন্যাস।
ইতিহাসাশ্রয়ী উপন্যাসসমূহের মধ্যে রয়েছে- ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘মৃণালিনী’, ‘রাজসিংহ’, ‘যুগলাঙ্গুরীয়’, ‘সীতারাম’ ও ‘চন্দ্রশেখর’। ‘বিষবৃক্ষ’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘ইন্দিরা’, ‘রাধারাণী’ ও ‘রজনী’ তার লেখা সামাজিক উপন্যাস। অপরদিকে তার দেশাত্মবোধক উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘আনন্দমঠ’ ও ‘দেবী চৌধুরাণী’। তার আরো একটি উপন্যাস রয়েছে। যেটি তার প্রথম লেখা।
ইংরেজিতে লেখা ‘ÔRajmohan’s WifeÕ ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসে বাস্তব জীবনের গল্প দিয়েই তিনি সাহিত্যসাধনার সূত্রপাত করেন। তিনি লেখালেখির ছদ্মনাম হিসেবে ‘কমলাকান্ত’ নামটি বেছে নিয়েছিলেন। বাংলা ভাষার আদি সাহিত্যপত্র ‘বঙ্গদর্শন’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন তিনি।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ইতিহাসকে আশ্রয় করে মানবজীবনের দৃশ্যকাব্য ফুটিয়ে তুলেছেন। ইতিহাসকে আশ্রয় করে তার প্রথম বাংলা উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’। পাঠান যুগের ইতিহাসকে কেন্দ্র করে লেখা এই উপন্যাসে পাঠান ও মোঘলদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রাধান্য পেয়েছে। ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত এই উপন্যাসে এক নারীর সংগ্রামের কথা উঠে এসেছে।
সমাজের বিপক্ষে গিয়েও যে নারী হেরে যাননি। স্বামীর মৃত্যুর বদলার মাধ্যমে এই উপন্যাসের সমাপ্তি ঘটে। ‘দুর্গেশনন্দিনী’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম স্বার্থক উপন্যাস। এছাড়া তিনি বাংলা সাহিত্যের ‘সাহিত্য সম্রাট’ হিসেবে সমধিক পরিচিত। তার উপন্যাসে একদিকে রয়েছে রোমান্স আবার অন্যদিকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। তার সময়ের আগে বাংলা উপন্যাসের কোনো দৃষ্টান্ত না থাকায় তিনি ইউরোপীয় ধারায় মনোনিবেশ করেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের স্বার্থক ও ঐতিহাসিক এক সৃষ্টি ‘রাজসিংহ’। ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ইতিহাসাশ্রয়ী এই উপন্যাসের উপজীব্য বিষয় রাজসিংহের সংগ্রাম। উপন্যাসের পরিসমাপ্তিতে রাজসিংহের জয়লাভ ও চঞ্চলকুমারীকে বিবাহের পরিণতিতে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে রোমান্সের এর মনোমুগ্ধকর বার্তা দিয়েছেন। সামাজিক উপন্যাস ধারায় চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তার আরেক বিখ্যাত সৃষ্টি ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’।
‘আনন্দমঠ’ তার স্বার্থক সৃষ্টি। মূলত সন্ন্যাসী বিদ্রোহের কাহিনী নিয়েই উপন্যাসটি। আনন্দমঠ প্রকাশিত হয় ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে। এই উপন্যাসে ভবানন্দের আদর্শচ্যুতিকেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সবমিলিয়ে এই উপন্যাসটি মহিমান্বিত লাভ করেছে এর মহাকাব্যিক আয়োজনের জন্য। দেশমাতৃকার নিয়োজিত থাকলেও ব্যক্তিজীবনে সবাই রক্তমাংসের মানুষ।
উপন্যাসটিতে গার্হস্থ্য প্রেম, স্বামী-স্ত্রী সত্ত্বেও ব্রহ্মচারী জীবনযাপন ও দেশের সেবার প্রসঙ্গ গুরুত্ব পেয়েছে। উপন্যাসের প্রাণ অ্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে এই উপন্যাসের সংগীতকে। উপন্যাসের গান ‘বন্দে মাতরম’ ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের জাতীয় স্তোত্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই গানকে মায়ের সঙ্গে কল্পনা করে বন্দনা করা হয়। উনিশ শতকে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে এই গান প্রেরণাদায়ী হিসেবে কাজ করে।
উপন্যাসের ভাষা নির্মাণ ও চরিত্রচিত্রণে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন জাদুকরের ভূমিকায়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে উপন্যাসের মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্র অমরত্ব লাভ করেছেন। তার লেখা প্রথম উপন্যাস যেমন বাংলা সাহিত্যের উপন্যাসের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে তেমনি তা বাংলা সাহিত্যে এক অমূল্য সম্পদ হয়ে আছে।
লেখক: শিক্ষক