ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শুধু জ্ঞানের আলোই জ্বালে না, বরং জাতির মুক্তির অগ্রদূত হিসেবেও কাজ করে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ।
মঙ্গলবার (১ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টায় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের প্রতিপাদ্য ‘বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় ইউজিসি চেয়ারম্যান এই মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অসামান্য সাহস, সুদূরপ্রসারী দৃষ্টিভঙ্গি এবং আপোষহীন নেতৃত্ব ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে কেন্দ্রীয় শক্তিতে পরিণত হয়। তাদের ঐক্যবদ্ধ ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক অচলাবস্থার গতি বদলে দেয়, কাঁপিয়ে তোলে রাষ্ট্রের চরম দমন-পীড়নের যন্ত্র। এই রক্তাক্ত ও বীরত্বগাথা অধ্যায়টি আজ বাংলাদেশের ইতিহাসে অম্লান গৌরবের অধ্যায় হয়ে রইলো-যেখানে পুনরায় প্রমাণিত হলো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু জ্ঞানের আলোই জ্বালে না, বরং জাতির মুক্তির অগ্রদূত হিসেবেও কাজ করে।
তিনি আরও বলেন, আজকের এই গৌরবময় দিনে-১ জুলাই ২০২৫, আমরা দাঁড়িয়ে আছি এক শতাব্দী ও পাঁচ বছরে পদার্পণের এক দীপ্ত ইতিহাসের দ্বারপ্রান্তে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়ের প্রতীক, একটি সভ্যতা গঠনের শিকড়, একটি স্বাধীনতার জাগরণগাথা।
ঢাবির সাবেক এই ভিসি বলেন, ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে, যখন ঢাকায় শিক্ষার একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়, তখন অনেকেই হয়তো কল্পনাও করতে পারেননি, এই প্রতিষ্ঠান একদিন হয়ে উঠবে একটি জাতির মেরুদণ্ড। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সেই পুণ্যভূমি, যেখানে শত সহস্র স্বপ্ন সঞ্চারিত হয়েছে, ইতিহাসের দিগন্ত রাঙিয়েছে জ্ঞানের দীপ্ত শিখায়। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর লর্ড লিটন বলেছিলেন, ‘... This University is Dacca's greatest possession, and will do more than anything else to increase and spread the fame of Dacca beyond the limits of Bengal or even of India itself।’
'বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়'-এটি কেবল একটি স্লোগান নয়, এটি আমাদের বোধ, আমাদের নৈতিক দায়, এবং আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি, বলেন তিনি।
ড. এস এম এ ফায়েজ বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মই হয়েছিল এক প্রকার বৈষম্য দূরীকরণের তাগিদে। শিক্ষায় পশ্চাৎপদ, সামাজিকভাবে বঞ্চিত, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা এক জনগোষ্ঠীর জন্য একটি আলোকিত ভবিষ্যৎ নির্মাণই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মূল মন্ত্র। তাই আজকের এই প্রতিপাদ্য, ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় যেমন যুক্তিযুক্ত, তেমনি বর্তমান সময়ের চাহিদায় তা অত্যন্ত সময়োপযোগী।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্যের একটি ভাষণের কথা স্মরণ করে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ফিলিপ জে হার্টগ ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ জানুয়ারি 'সাহিত্য সমাজ' নামে একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন কর্তৃক আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন, ‘এই ঐতিহাসিক নগরে যে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তা এর ইতিহাস ও ভবিষ্যতের উপযোগী হবে। এখানে হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতি এবং মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়েও অধ্যয়ন-অনুশীলন হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক পটভূমি আপনারা জানেন। নতুন প্রদেশ বাতিলের পর ভাইস রয় লর্ড হার্ডিঞ্জের কাছে মুসলমান প্রতিনিধিদলের আলাপ-আলোচনার ফসলই এই বিশ্ববিদ্যালয়। অনগ্রসর মুসলমান সম্প্রদায়ের অগ্রগতির ব্যবস্থা করাই এটি প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্দেশ্য।
ইউজিসির চেয়ারম্যান বলেন, তাদের শিক্ষিত করে তুলতে হবে এমনভাবে, যাতে তারা রাজনৈতিক ব্যাপারে আরও বেশি অংশ নিতে পারেন এবং ভবিষ্যতে বাংলার সরকার পরিচালনায় যথেষ্ট যোগ্যতা ও দক্ষতার পরিচয় দেন। তিনি লর্ড হার্ডিঞ্জকে উদ্ধৃত করেছিলেন এই বলে যে, এটি কোনো মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় হবে না, এটি কোনো হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় হবে না; তিনি বলেছেন, এটি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। সেই চেতনায়ই এই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হবে। দীর্ঘ পথপরিক্রমায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক টানাপোড়েনের মধ্যেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালীন এ চেতনা থেকে বিচ্যুত হয়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়-এটি বাঙালির আত্মবিকাশ, জাতিসত্তা ও স্বাধীনচেতা মননের প্রতীক। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুলাই প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয় পূর্ব বাংলার জনগণের শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়, গড়ে তোলে একটি প্রগতিশীল, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চেতনার ভিত। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানে ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ আগস্ট কার্জন হল প্রাঙ্গণে ইউনিয়ন জ্যাক নামিয়ে উত্তোলন করা হয় নবগঠিত পাকিস্তানের সবুজ-সাদা পতাকা। কিন্তু এই পরিবর্তন ছিল একটি নতুন সংগ্রামের সূচনা। মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীরা বুকের রক্ত ঢেলে দেন। তাদের এই আত্মত্যাগ বাংলা ভাষাকে এনে দেয় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে সামরিক শাসকের চাপিয়ে দেওয়া শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতির পক্ষে যে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে ওঠে, তারও নেতৃত্ব দেয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান বেগবান হয়। অবশেষে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে এই ক্যাম্পাসেই আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলিত হয় বাংলাদেশের সবুজ জমিনে লাল সূর্যের মাঝে খচিত হলুদ মানচিত্রের পতাকা-এক স্বাধীন রাষ্ট্রের পূর্বাভাস। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের হাত ধরেই ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে জন্ম নেয় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র-বাংলাদেশ, বলেন তিনি।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর গণতন্ত্র রক্ষা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথচলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কখনোই তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব থেকে সরে আসেনি। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় যে অগ্রণী ভূমিকা এই বিশ্ববিদ্যালয় পালন করেছিল, তা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে। ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে আবারও জাতির ক্রান্তিকালে নেতৃত্বের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা বিলুপ্ত করে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ নিশ্চিতের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সূচিত হয় এই আন্দোলন। ছাত্র, শিক্ষক, পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও স্কুলের শিক্ষার্থীরা একত্রিত হয়ে গড়ে তোলে এক অনমনীয় প্রতিরোধ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে, ন্যায়ের পক্ষে। পুরো জাতিকে একত্রিত করে গড়ে ওঠে ঐতিহাসিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন।
সারাদেশের রাজপথে যখন ফুঁসে ওঠে ছাত্র-জনতা, তখন তাদের হাতিয়ার ছিল কেবল সত্য, ন্যায় এবং স্বাধীনতার প্রতি দৃঢ় প্রত্যয়। এই আন্দোলন ছিল একটি নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতি, যেখানে কোনো অপশক্তি টিকে থাকতে পারে না, এবং জনগণের মুক্ত আকাঙ্ক্ষা অবদমিত হয় না, বলেন ঢাবির সাবিক ভিসি।