ঘরবাড়ি পানিতে ভাসছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা অকেজো। গাছপালা উপড়ে পড়েছে। ভিটেমাটি ছেড়ে ছুটছে অসহায় প্রাণ। স্বজনদের খোঁজে দিশেহারা মানুষ। আকাশ থেকে স্যাটেলাইট চিত্র দেখলে মনে হবে প্রায় ডুবে যাওয়া এক অঞ্চল। এমনই সব চিত্র যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্য টেক্সাসে। ইতিহাসের স্মরণকালের বন্যায় বিপর্যস্ত টেক্সাস। দক্ষিণের শহর টেক্সাসে যখন আকষ্মিক বন্যা ঠিক তখন পশ্চিমাঞ্চলের শহর ক্যালিফোর্নিয়ায় দাবানলের ভয়াবহতা।
৪ জুলাই ছিল ‘আমেরিকা দিবস’। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে প্রতি বছর জুলাই মাসে কের কাউন্টিতে গুয়াডালুপে নদীর দুপাশে মেয়েদের গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্প বসে। ঠিক এ দিন থেকেই শুরু হয় অস্বাভাবিক বৃষ্টি। পাশের স্যান অ্যান্টোনিও শহরে দেখা দেয় টানা বৃষ্টিপাত।
বৃষ্টিপাতের কারণে গুয়াডালুপে নদীর পানি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। বন্যায় সবচেয়ে বেশি বিপর্যয় ঘটে টেক্সাসের মধ্যাঞ্চলের শহর কের কাউন্টির ‘ক্যাম্প মিস্টিক’ নামের গ্রীষ্মকালীন আবাসিক ক্যাম্পে। ক্যাম্পের আশপাশে মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে ৩০ সেন্টিমিটার (১২ ইঞ্চি) বৃষ্টিপাত হয়। যা কের কাউন্টির শহরের গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাতের তিন ভাগের এক ভাগ। গুয়াডালুপে নদীর পানি এক ঘন্টার ব্যবধানে ২৬ ফুটের (প্রায় ৮ মিটার) কাছাকাছি বেড়ে যায়।
এখন পর্যন্ত টেক্সাসের বন্যায় ১০৫ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এদের মধ্যে শিশু ৩০ জন। যারা সবাই মেয়েদের গ্রীষ্মকালীন ক্যাম্পে অবস্থান করেছিলেন। আহত হয়েছে শতাধিক। সিএনএন ও বিবিসি উদ্ধারকর্মীদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে মৃতের সংখ্যা আরো বাড়বে। টেক্সাসে হঠাৎ ও আকষ্মিক বন্যাকে অনেকে ফ্ল্যাশ ফ্লাড বা হড়পা বান বলে আখ্যায়িত করেছেন। কয়েকদিন ধরে বৃষ্টিতে হঠাৎ পানি অস্বাভাবিক রকমের বেড়ে গিয়ে হড়না বানের সৃষ্টি হয়। যা যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া দপ্তরও আঁচ করতে পারেনি! তাছাড়া যখন হড়পা বান জনপদে আছড়ে পড়ে তখন রাত হওয়ায় বেশিরভাগ মানুষ ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। যুক্তরাষ্ট্রে হড়পা বান নতুন নয়। এর আগে সান অ্যান্টোনিও শহরে ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে হড়পা বানে নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে বন্যার পূর্বাভাস সঠিক সময়ে পাওয়া যাবে না- এটা ভাবা যায় না! পৃথিবীর যেকোন দেশে ভূমিকম্পের ভয়াবহতার মাত্রা আগে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তির মাধ্যমে মুহুর্তের মধ্যে পাই। আর সেই সর্বাধিক তথ্য প্রযুক্তির দেশে বন্যার পূর্বাভাস সঠিক সময়ে না পৌঁছানোর কারণে হতাহতের ঘটনা ঘটবে- এটা বেমানান। টেক্সাসের বন্যায় হতাহতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের আবহাওয়া দপ্তর আঙুল তুলছেন ট্রাম্প প্রশাসনের খামখেয়ালিপনার দিকে। আবহাওয়া দপ্তরের অনেক পদে সময়মতো নিয়োগ দেয়া হয়নি। এছাড়া আবহাওয়া দপ্তরের বাজেটও কাটছাঁট করা হয়েছে।
পদ শূন্য থাকার কারণে সব কাজ সময়মতো করা সম্ভব হচ্ছে না বলে সূত্রের খবর। ভয়াবহ এই বন্যার কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রশান্ত মহাসাগর ও মেক্সিকো উপসাগরের থেকে আসা অতিরিক্ত আর্দ্রতা বায়ুমণ্ডলে জমা হয়ে টেক্সাসের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ঘূর্ণায়মান বায়ুর সংস্পর্শে এসে তা বৃষ্টিঝড় তৈরি করে। বিসিসির সূত্রে জানা যায়, টেক্সাসের মাটি তুলনামূলক কঠিন শিলা হওয়ায় বৃষ্টির পানি মাটির অভ্যন্তরে শোষিত না হয়ে দ্রুত গড়িয়ে পড়ে। যা হড়পা বানের মাধ্যমে বন্যার সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করে।
এ তো গেলো বন্যার কথা। জলবায়ু সৃষ্ট যৌথ দুর্যোগের কবলে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক সংবাদমাধ্যমের খবর, পশ্চিমাঞ্চলের রাজ্য ক্যালিফোর্নিয়ার সান লুইস ওবিম্পো কাউন্টিতে ভয়াবহ দাবানল ছড়িয়ে পড়ে স্বাধীনতা দিবসের আগের দিন অর্থাৎ ৩ জুলাই থেকে।
এরই মধ্যে পুড়ে গেছে ৯০ হাজার একর এলাকা। ‘মাদ্রে ফায়ার’ নামের এই দাবানল ক্যালিফোর্নিয়ায় চলতি বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় দাবানলের ঘটনা। তিন শতাধিক মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর জানিয়েছে, নতুন নতুন এলাকায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। এর আগে চলতি বছরের জানুয়ারিতে লস অ্যাঞ্জেলেসে ভয়াবহ দাবানলে ৩০ জন নিহত হয়েছিল। এর আগেও চলতি বছরে ক্যালিফোর্নিয়ায় একাধিকবার দাবানলের ঘটনা ঘটেছে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, সামনের গ্রীষ্ম মৌসুমে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ায় এ বছর শুষ্ক শীত দেখা গেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বছরের বিভিন্ন সময় আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে দাবানলের ঘটনা ঘটে। চলতি সপ্তাহে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়া টেক্সাসেও ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রয়ারি ও মার্চ মাসে দাবানলের ঘটনা ঘটে। শক্তিশালী শুষ্ক বাতাসের কারণে ছড়িয়ে পড়া দাবানলে ১০ লাখ একরের বেশি জমি পুড়ে যায়। ২ জন নিহতসহ বহু প্রাণী মারা যায়। ঘরবাড়ি ও বহু স্থাপনা পুড়ে যায়।
মানবসৃষ্ট জলবায়ু দুর্যোগের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে বন্যা, দাবানল ও খরার ঘটনা ঘটছে বহু বছর ধরে। পৃথিবীব্যাপী মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের কারণে তাপমাত্রা বাড়ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, পুরো পৃথিবীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা বেড়েই চলেছে। শুষ্ক আবহাওয়ার দরুণ যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা দেখা যায়। তবু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সংবাদমাধ্যমে একাধিকবার বলেছেন যে, তিনি জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বাস করেন না।
আর বিশ্বাস করেন না বলেই যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পরপরই ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ‘প্যারিস জলবায়ু চুক্তি’ থেকে আমেরিকাকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। বিশ্বের পরিবেশবাদীরা ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে চরম খামখেয়ালীপনার বহিঃপ্রকাশ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি শিল্পযুগের আগের অবস্থা থেকে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রাখার বৈশ্বিক সিদ্ধান্ত হুমকির মুখে! ট্রাম্প প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট হয়ে আগের মেয়াদেও যুক্তরাষ্ট্রকে জলবায়ু চুক্তি থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন।
২০২১ খ্রিষ্টাব্দে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হয়ে সেই জলবায়ু চুক্তিতে আবার ফিরে আসেন। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কার্বন নিঃসরণকারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের জলবায়ু চুক্তিতে না থাকাটা গ্রিনহাউস গ্যাস কমানোর বৈশ্বিক প্রচেষ্টা হুমকির মুখে পড়বে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হলো, যে যুক্তরাষ্ট্র জলবায়ু দুর্যোগে বিপর্যস্ত সেই দেশের প্রেসিডেন্ট জলবায়ু সমস্যা বিশ্বাস করেন না -এটা হাস্যকর ছাড়া আর কী হতে পারে। জলবায়ুগত সমস্যা মনুষ্যসৃষ্ট বৈশ্বিক সমস্যা। তাই বৈশ্বিকভাবে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রতিরোধ ছাড়া সম্ভব নয়। জলবায়ুগত সমস্যা বন্যা, দাবানল ও খরার কবলে পড়া যুক্তরাষ্ট্রের আর কবে বোধোদয় হবে?
লেখক: শিক্ষক, লৌহজং বালিকা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, মুন্সীগঞ্জ।