ইলিশ বাঙালির আবেগ, অনুভূতি, আদিখ্যেতা এবং বাড়াবাড়ি অন্য যে কোনো মাছের তুলনায় বেশি। মৌসুমে জেলেদের জালে ইলিশ মাছ ধরা না পড়লেও সেটি যেমন শিরোনাম হয়। তেমনি ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ মাছ ধরা পড়লেও হয় শিরোনাম। সেই ইলিশই এবার শিরোনাম হয়েছে দূষণের কারণে!
যেসব সামুদ্রিক খাবার মানুষ খায়, তাতে ব্যাপক মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ ধরা পড়েছে সাম্প্রতিক এক গবেষণায়। ভোজনরসিক বাঙালির প্রিয় ইলিশেও পাওয়া গেছে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা। শুধু তা-ই নয়, ইলিশের শরীরে বাসা বেঁধেছে ক্যাডমিয়াম, সিসা, পারদ, আর্সেনিকের মতো ভারী ধাতু।
গবেষণায় দেখা গেছে, ইলিশের অন্ত্র, যকৃতে, এমনকি পেশিতেও পাওয়া গেছে ৫ মিলিমিটারের চেয়েও ছোট প্লাস্টিক কণা, যেগুলোকে বলা হয় মাইক্রোপ্লাস্টিক। এই কণা প্লাস্টিক ব্যাগ, বোতল, সিনথেটিক কাপড়, টায়ার কিংবা কসমেটিকস থেকে এসে পড়ে নদী ও সাগরে। সেখান থেকেই তা গিলে ফেলে মাছ।
গবেষণা প্রতিবেদনটি গত এপ্রিলে প্রকাশিত হয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক খ্যাতনামা বিজ্ঞান সাময়িকী ওয়াটার, এয়ার সয়েল পলিউশন-এ। গবেষণাটি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অ্যাকুয়াটিক জুওলজি রিসার্চ গ্রুপ এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের একদল বিজ্ঞানী।
গবেষণাটি হয়েছে মূলত মেঘনা নদীর মোহনায়। চাঁদপুরের হাইমচর, লক্ষ্মীপুরের আলেকজান্ডার ও রামগতি, ভোলার দৌলতখান ও তজুমদ্দিন এবং নোয়াখালীর হাতিয়া এলাকা থেকে ইলিশের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের এই এলাকা দেশের অন্যতম উৎপাদনশীল জলজ প্রতিবেশব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত। ইলিশের জন্য এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিচরণ ও প্রজননক্ষেত্র। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদনের মাত্র ২ শতাংশ আসে পদ্মা থেকে। তা-ও সেগুলো আকৃতিতে ছোট হয়। বড় ও স্বাদের ইলিশের বেশির ভাগই পাওয়া যায় মেঘনা অববাহিকায়।
গবেষণার জন্য দেশের চার জেলায় মেঘনা নদী থেকে ২০টি ইলিশ সংগ্রহ করা হয়। ইলিশগুলো ধরার পর ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রেফ্রিজারেটরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। নমুনাগুলো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওশানোগ্রাফি বিভাগের পরীক্ষাগারে নেওয়া হয়। নমুনা সংগ্রহের সময় প্রতিটি মাছের দৈর্ঘ্য ও ওজন রেকর্ড করা হয়। প্রতিটি মাছের অন্ত্রনালি পেটের দিক থেকে কেটে ফেলে দেওয়া হয়।
গবেষণার জন্য ইলিশগুলো সংগ্রহ করা হয়েছিল ২০১৯ থেকে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। এরপর একাধিক দফায় এগুলোর পরীক্ষা করা হয়। অণুবীক্ষণযন্ত্রের সহায়তায় ইলিশের শরীরে প্লাস্টিকের নমুনা শনাক্ত করা হয়।
গবেষণায় সব ইলিশেই মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। গড়ে প্রতিটি মাছের মধ্যে ১০টি মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে। এই গবেষণায় পাঁচ রঙের ক্ষুদ্র প্লাস্টিক পাওয়া গেছে। সেগুলো হলো স্বচ্ছ, সবুজ, লাল, নীল ও কালো।
আকারের দিক থেকে দেখা গেছে, প্রায় ৪৩ শতাংশ কণাই ১ থেকে ৫ মিলিমিটারের মধ্যে। ৫০০ মাইক্রোমিটারের চেয়ে ছোট কণাগুলো কম পাওয়া গেছে ২৩ ভাগ। ৫০০ মাইক্রোমিটার থেকে ১ মিলিমিটার আকার ৩৪ শতাংশের কিছু বেশি। সুতা আকৃতি, গোলাকৃতি, গোলাকার এবং এর বাইরের ভিন্ন আকৃতির প্লাস্টিক পাওয়া গেছে।
গবেষণার আরেক গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এখানে ইলিশে পাওয়া গেছে সিসা, ক্যাডমিয়াম, পারদ, আর্সেনিক ও ক্রোমিয়াম। এসবই ভারী ধাতু। এর পরীক্ষার জন্য এনার্জি ডিসপারসিভ এক্স-রে ফিউরে এসেন্স স্পেকট্রোসকপি (ইডিএক্সআরএফ) বিশ্লেষণ করা হয়। গবেষণায় দূষকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে, ধরে নেওয়া হচ্ছে, এই ধাতুগুলোর উপস্থিতি ভবিষ্যতে ইলিশের খাদ্য গ্রহণ ও প্রজনন ক্ষমতাও কমিয়ে দিতে পারে। বড় আকারের ইলিশে সিসা ও তামার মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতি দেখা যায়।
গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, অতিমাত্রায় কিছু ভারী ধাতু এবং মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতির কারণে তুলনামূলকভাবে বড় আকারের ইলিশে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেশি দেখা গেছে।
মানবদেহে মাইক্রো প্লাস্টিকের ক্ষতিকর প্রভাব
• ফুসফুসে প্রদাহ
• অক্সিডেটিভ স্ট্রেস
• কার্ডিওভাসকুলার ব্যাধি
• রক্তনালী-সংক্রান্ত রোগ
• শ্বাসযন্ত্রের জটিলতা
• জ্বিনগত সমস্যা
• হরমোনজনিত সমস্যা
• কোষের ধ্বংস বৃদ্ধি অব্যাহত থেকে নতুন কোষ তৈরিতে ব্যাঘাত ঘটা
• ওজন বৃদ্ধি
• অ্যালার্জি সমস্যা
• দীর্ঘস্থায়ী মানসিক সমস্যা
• রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস হয়ে ক্যান্সারের দিকে পরিচালিত হওয়া
• প্রজনন জটিলতা
• শিশুদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ক্রমবিকাশে ব্যাঘাত ঘটা
• সাধারণ কোষের ক্যান্সার কোষে রূপান্তর
• বিপাকীয় জটিলতা