নয় মাসে সংস্কার কতোদূর | মতামত নিউজ

নয় মাসে সংস্কার কতোদূর

২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি বড় রাজনৈতিক টানাপোড়েনের অবসান ঘটবে, এমন আশা ছিলো জনসাধারণের

২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি বড় রাজনৈতিক টানাপোড়েনের অবসান ঘটবে, এমন আশা ছিলো জনসাধারণের। রাষ্ট্র পরিচালনায় আসার পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত এই সরকার নিজেকে ‘নিরপেক্ষ, সংস্কারমুখী ও জনবান্ধব’ প্রশাসন হিসেবে উপস্থাপন করেছিলো। তারা বলেছিলো, এই সরকার হবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোর গভীরে থাকা সমস্যাগুলোর টেকসই সমাধানকল্পে কার্যকরী সংস্কারের অঙ্গীকারে দৃঢ়।

কিন্তু নয় মাস পার না হতেই রাষ্ট্রজুড়ে প্রশ্ন উঠছে, এই সরকারের প্রতিশ্রুতি ছিলো কি কেবল কথার ফুলঝুরি? সংস্কারের কথা বলে যে স্বপ্নের প্রদীপ জ্বালানো হয়েছিলো, তার আলো কি নিভে যাচ্ছে? সম্প্রতি অধ্যাপক ইউনূসের পদত্যাগ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজব এবং তা ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে।

গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, যদি সবাই আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে অন্তর্বর্তী সরকারকে কার্যত বন্দি করে রাখে, তাহলে আমাদের জন্য দায়িত্ব পালন করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ ব্যাপারে উপদেষ্টা রিজওয়ানা নিশ্চিত করেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস পদত্যাগ করেননি, তিনি আছেন ও থাকবেন।

মূলত, এই নয় মাসে সরকারের কর্মকাণ্ড জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই সাধারণ মানুষ দিনদিন অসন্তুষ্ট হয়ে উঠছে। সরকার যে পাঁচটি প্রধান খাতে সংস্কারের কথা বলেছিল—প্রশাসন, শিক্ষা, অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলা ও নির্বাচনী ব্যবস্থা—তার কোনোটিতেই দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই, বরং কিছু ক্ষেত্রে অবনতি হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন।

উদাহরণস্বরূপ, প্রশাসনে দুর্নীতিমুক্ত করার যে অঙ্গীকার ছিলো, সেটি রয়ে গেছে মুখে। এখনো বদলি, পদোন্নতি কিংবা টেন্ডার প্রক্রিয়ায় অদৃশ্য রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করছে। শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নের জায়গায় এসেছে নতুন বিতর্ক। পাঠ্যবই বিতরণে অব্যবস্থা, পাঠ্যবিষয়ে বিভ্রান্তিকর উপস্থাপন ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার শুধু শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নয়, জাতির ভবিষ্যৎকেই বিপন্ন করে তুলছে।

অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার প্রচেষ্টা দৃশ্যমান নয়। চাল, ডালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়েই চলেছে। নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য জীবনধারণ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর আইনশৃঙ্খলার দিক থেকে বলা চলে, একটি বৃহৎ ব্যর্থতা।

দেশে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ এখনো থামছে না। বিশেষ করে নারী ও শিশু ধর্ষণের ঘটনায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি, বিলম্বিত তদন্ত ও মামলার দীর্ঘসূত্রতা অপরাধীদের উৎসাহিত করছে। ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম তিন মাসেই ধর্ষণের ঘটনা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৯ শতাংশ বেশি বেড়েছে বলে বেসরকারি একাধিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা জানিয়েছে। অথচ সরকার এই বিষয়ে নীরব।

এই অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হচ্ছে—সরকারকে এখনই স্বচ্ছ বার্তা দিতে হবে। তাদেরকে সংলাপ চালু করতে হবে, প্রয়োজনে সংস্কার কমিশনে করে জাতীয় ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্বদের যুক্ত করতে হবে। প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনতে হবে, আর নিরপেক্ষ নির্বাচনের রোডম্যাপ নির্দ্বিধায় জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। সময় থেমে থাকে না। ইতিহাস অনেক কিছুই ভুলে যায়, তবে নেতৃত্বের ব্যর্থতা সহজে ভোলে না। ড. ইউনূস সরকার এই নয় মাসে যে আস্থাহীনতার দেয়াল তৈরি করেছে, সেটি ভেঙে আবার বিশ্বাসের সেতু গড়ে তুলতে না পারলে এই সরকার ইতিহাসে আরেকটি ব্যর্থ অধ্যায় হিসেবেই গণ্য হবে।

লেখক: সংবাদকর্মী