চাকরি অধ্যাদেশের কিছু ধারা অপপ্রয়োগের শঙ্কা | বিবিধ নিউজ

চাকরি অধ্যাদেশের কিছু ধারা অপপ্রয়োগের শঙ্কা

সরকারি কর্মচারীদের শৃঙ্খলা সংক্রান্ত চার অপরাধে চাকরিচ্যুতির বিধান রেখে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করেছে সরকার।

#সচিবালয় #সরকারি চাকরি #বিসিএস

সরকারি কর্মচারীদের শৃঙ্খলা সংক্রান্ত চার অপরাধে চাকরিচ্যুতির বিধান রেখে ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করেছে সরকার। এই অধ্যাদেশের কয়েকটি ধারায় বেশ কিছু দুর্বলতা চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব ধারা অপপ্রয়োগের শঙ্কা রয়েছে। অপরাধ না করেও অনেকে সাজার মুখোমুখি হতে পারেন। কিছু ক্ষেত্রে কর্মচারীরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আক্রোশের শিকার হতে পারেন বলে মনে করেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।

আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানও মনে করেন কিছু প্রভিশন আছে, যেগুলো অপপ্রয়োগের সম্ভাবনা আছে। এসব কারণে ২৫ মে সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশটি কার্যকর হওয়ার পর থেকেই এটি বাতিলের দাবিতে আন্দোলনে নামেন নন-ক্যাডার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আন্দোলনের একপর্যায়ে গত ৪ জুন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে সরকার।

এ কমিটিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। কমিটিকে সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ পর্যালোচনা এবং কর্মচারী সংগঠনগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সুচিন্তিত সুপারিশ করতে বলা হয়েছে। তবে কত দিনের মধ্যে সুপারিশ পেশ করতে হবে সে বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। ১ জুন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা এবং ৩ জুন আইন উপদেষ্টা নিজ নিজ দপ্তরে অধ্যাদেশটি বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত কর্মচারী সংগঠনগুলোর নেতাদের সঙ্গে বৈঠককালে অধ্যাদেশের কিছু ধারার অপপ্রয়োগের আশঙ্কা ব্যক্ত করেন।

সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের প্রথম দুর্বলতা হচ্ছে-অধ্যাদেশটিতে সরকারি চাকরি আইনযুক্ত করায় এর বিভিন্ন ধারায় কি ধরনের প্রভাব পড়বে তা দেখা হয়নি। যেমন সরকারি চাকরি আইনের (৪২) ধারার উপ-ধারা-২ এ বলা হয়েছে-কোনো সরকারি কর্মচারী ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক অনূর্ধ্ব এক বছর কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হলে কর্তৃপক্ষ চার ধরনের শাস্তি আরোপ করতে পারবে। এই ধারায় এক বছরের কম কারাদণ্ড ভোগের পর ওই কর্মচারীর কি হবে? সে কি চাকরিতে যোগদান করতে পারবে কিনা সে বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। অধ্যাদেশের দ্বিতীয় দুর্বলতা হচ্ছে-আদালত কত টাকা অর্থদণ্ড আরোপ করলে সে শাস্তিপ্রাপ্ত হবে সে বিষয়ে আইনে কিছুই বলা হয়নি। একজন কর্মচারী যদি ১০০ কোটি টাকার অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হন, তারপরও সে চাকরি ফিরে পাবে। কারণ আইনে এ বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলা নেই।

এ বিষয়ে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া বলেন, এটি অধ্যাদেশের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। অধ্যাদেশ প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্তদের অদক্ষতা এবং অযোগ্যতাকে তিনি দায়ী করেন। তিনি আরও বলেন, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে আইন প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্তরা ইচ্ছে করে আইনে ফাঁক রেখেছে। আর বর্তমানে দায়িত্বশীলরা তা খেয়ালই করেননি। ফলে সরকারি চাকরি আইন হাস্যকর আইনে রূপান্তর হয়েছে।

অধ্যাদেশের তৃতীয় দুর্বলতা হচ্ছে-যে অধ্যাদেশে এক বছরের কম সময় কারাদণ্ড ভোগ করার পরও একজন কর্মচারীর চাকরি যাবে না-সেই অধ্যাদেশে অনানুগত্যের জন্য চাকরিচ্যুতির বিধান রাখা হয়েছে। একজন কর্মচারী একশ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দিয়েও সে চাকরি ফিরে পাওয়ার সুযোগ রয়েছে অথচ একই আইনে শুধু কর্মস্থলে অনুপস্থিতির জন্য চাকরিচ্যুত হবে। অধ্যাদেশে বিষয়গুলো সুস্পষ্ট করা হয়নি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

অধ্যাদেশটির চতুর্থ দুর্বলতা হচ্ছে-অধ্যাদেশে কর্মচারীর অপরাধ তদন্তের সুযোগ রাখা হয়নি। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে অপরাধীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতেই হবে। তদন্তের মাধ্যমে দোষী নির্দোষ প্রমাণিত হবে। অপরাধী হলে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। তদন্ত ছাড়া একজন কর্মচারী দোষী না নির্দোষ তা কিভাবে প্রমাণ হবে। এই ধরণের ধারার অপপ্রয়োগের আশঙ্কা অনেক বেশি। কর্তৃপক্ষের অন্যায় ও খামখেয়ালিপনার শিকার হতে পারেন কর্মচারীরা। কর্মকর্তারা নিজের ইচ্ছামতো যখন-তখন যে কাউকে চাকরিচ্যুত করতে পারবেন।

এ বিষয়ে ফিরোজ মিয়া বলেন, আইন বা অধ্যাদেশে তদন্ত এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকতেই হবে। পর্যাপ্ত সময় দিয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। সময় নিয়ে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে হবে। তদন্ত ছাড়া কিভাবে প্রমাণ হবে অভিযোগ সত্য কিংবা মিথ্যা। এ ধারার বিষয়ে তিনি বলেন, নিবর্তনমূলক এই অধ্যাদেশটি নারীদের জন্য আরও বেশি ভয়ংকর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অসাধু কর্মকর্তা তার অধীনস্ত নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নানাভাবে নাজেহাল করতে পারেন। কর্মরত নারী সদস্যদের বাজে প্রস্তাব দিলে এবং তাতে সাড়া না পেলে ভিন্ন আঙ্গিকে অনানুগত্যের অভিযোগ আনতে পারে। যে কারণে নারী কর্মচারীদের জন্য অধ্যাদেশটি অনিরাপদ বলে মনে করেন তিনি।

অধ্যাদেশের পঞ্চম দুর্বলতা হচ্ছে-১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের সরকারি চাকরি (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশে কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টির কারণে শাস্তির বিধান ছিল। বর্তমান অধ্যাদেশে অনানুগত্যের জন্য শাস্তির বিধান করা হয়েছে। এতে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হবে। কোনো দুর্নীতিবাজ অফিস প্রধানের কথা যদি ভালো তথা নৈতিকমান সম্পন্ন কোনো কর্মচারী না শোনে, তখন সেই ভালো কর্মচারীর বিরুদ্ধে অনানুগত্যের অভিযোগ এনে তাকে চাকরিচ্যুত করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে ফিরোজ মিয়া বলেন, অনানুগত্য প্রমাণে কর্মচারীরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হবে। কারণ খারাপ কর্মকর্তারা কর্মচারীকে নিয়ন্ত্রণের জন্য নানা ধরনের কৌশলের আশ্রয় নেবেন। এতে অধ্যাদেশটির অপব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।

অধ্যাদেশের ৬ষ্ঠ দুর্বলতা হচ্ছে-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের বার্তা বা সংবাদ ই-মেইলে নোটিশ আকারে প্রেরণের বিধান করা হয়েছে। এতে সমস্যা তৈরি হবে এবং অধ্যাদেশের অপব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া বৈরী আবহাওয়া ও নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে অনেক সময় ই-মেইল ওপেন করা হয় না। অনেকে নেটওয়ার্কের বাইরে থাকতে পারে। ইন্টারনেট সচরাচর নাও থাকতে পারে। ফলে অভিযুক্ত কর্মচারী জানবেই না তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়েছে এবং জবাব দিতে হবে। এটা কৌশলে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ বঞ্চিত করার শামিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কর্মচারীকে শাস্তি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ বঞ্চিত করা অমানবিক বলে মন্তব্য করেছেন মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া।

অধ্যাদেশের সপ্তম দুর্বলতা হচ্ছে-নতুন অধ্যাদেশ অনুযায়ী অধস্তন কর্তৃপক্ষও সংশ্লিষ্ট অভিযুক্তকে দোষী বা নির্দোষ সাব্যস্ত করতে পারবে। এটা সংবিধানের ১৩৫ অনুচ্ছেদের দফা (১) এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানের ১৩৫ অনুচ্ছেদের দফা (১) বলা হয়েছে-‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে অসামরিক পদে নিযুক্ত কোনো ব্যক্তি তাহার নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ অপেক্ষা অধস্তন কোনো কর্তৃপক্ষের দ্বারা বরখাস্ত বা অপসারিত বা পদাবনমিত হইবে না।’ জারি করা অধ্যাদেশের উপধারা-১ বলা হয়েছে- ‘কোনো অপরাধের জন্য কার্যধারা গ্রহণ করা হয়, সেই ক্ষেত্রে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ অথবা এতদুদ্দেশ্যে তৎকর্তৃক সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি অভিযোগ গঠন করিবেন।’ ফিরোজ মিয়ার মতে এটা দেশের সংবিধানের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এ ধরনের বিধান প্রণয়নের আগে বিষয়টি যাচাই-বাছাই করা উচিত ছিল।

তিনি আরও বলেন, আমার মতে হাস্যকর আইন ও নিবর্তনমূলক অধ্যদেশটি বাতিল করে সরকার নতুন কঠোর আইন প্রণয়ন করতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে ফিরোজ মিয়া বলেন-যারা অধ্যাদেশ জারি করেছেন তারাই আবার পর্যালোচনা করবেন এটা কেমন করে হয়। তারা কি ভেটিংয়ের সময় তা দেখেননি। এখন নতুন করে কি দেখবেন। তারা হয়তো ব্যস্ত ছিলেন সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাদের একান্ত সচিব, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবরা কি করেছেন। তারা কেন এসব দুর্বলতা খেয়াল করলেন না-এমন প্রশ্ন ফিরোজ মিয়ার।

#সচিবালয় #সরকারি চাকরি #বিসিএস