‘নেতানিয়াহুর জয়ের দাবি সত্ত্বেও ইসরায়েলিদের মধ্যে তার প্রতি আস্থার অভাব’,‘খামেনির ভিন্ন ইরান দর্শনের ইঙ্গিত’,‘ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আইএইএ (আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা) নিয়ে ইরানের প্রশ্ন’—এই সবকিছুই ইরান-ইসরায়েলের এই চলমান সংঘাতের বহুমাত্রিকতাকে তুলে ধরে।
পাশাপাশি আমেরিকার এই যুদ্ধে হুট করে এন্ট্রি নেয়া ও প্রবেশের দ্বিগুন গতিতে যুদ্ধ থেকে প্রস্থান অনেক প্রশ্ন জন্ম দিয়েছে। তাহলে এই যুদ্ধের ভবিষ্যত কি? শান্তি না অন্য কিছু।
যুদ্ধরত পক্ষগুলো বিরতির ফাঁকে কি নতুন করে শক্তি সঞ্চার করবে না কি স্থায়ী সমাধানের পথে যাবে। আমেরিকা ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে এভাবে প্রবেশ করলো কেন? যুদ্ধে শেষ না টেনে বেরিয়েই বা গেলো কেন? এই যুদ্ধ কি এখন ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ আছে না কি ‘ইরান-ইসরায়েল-মার্কিন সংঘাত’ নাম নিয়েছে?
বিরতির পর যদি যুদ্ধে ফের শুরু হয়ে কোন নাম হবে। মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশের যুদ্ধ না কি আটলন্টিকের ওপরের নামও জড়াবে এই যুদ্ধে?
১২ দিনের ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে উভয় পক্ষেই উল্লেখযোগ্য ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যদিও ক্ষয়ক্ষতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র এখনো সম্পূর্ণ স্পষ্ট নয়। কারণ উভয় পক্ষই নিজ নিজ ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করছে।
ইরানের প্রতিশোধমূলক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলায় ইসরায়েলে কমপক্ষে ৩১ হাজার ভবন এবং ৪ হাজার যানবাহন ধ্বংসসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অবকাঠামোগত ক্ষতির অনুমান করা হচ্ছে কমপক্ষে ১ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার।
ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ইসরায়েল সরকারকে আনুমানিক ৫৭০ থেকে ৮৬০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যদিও ইসরায়েল নিহতের সংখ্যা কমিয়ে দেখাচ্ছে, প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ইসরায়েলে ২৮ জন নিহত হয়েছেন। কিছু সূত্রের মতে, এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে।
অপর দিকে ইসরায়েলি হামলায় ইরান সরকারের হিসাবে এখন পর্যন্ত দেশটির ৯৩৫ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে অনেক শীর্ষ সামরিক কমান্ডার, পারমাণবিক বিজ্ঞানী এবং সাধারণ নাগরিক রয়েছেন।
ইসরায়েল দাবি করেছে যে তারা ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে তাদের কর্মসূচি 'ধ্বংস' করেছে। তবে ইরান এই দাবি অস্বীকার করে বলেছে যে তাদের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ করে যুক্তরাষ্ট্র 'উল্লেখযোগ্য কিছু অর্জন করতে পারেনি'। ইউরেনিয়াম মজুদগুলি মূলত অক্ষত রয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে।
এই সংঘাতের সবচেয়ে রহস্যময় দিকগুলির মধ্যে একটি হলো আমেরিকার হঠাৎ করে এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। প্রশ্ন উঠেছে, যুদ্ধ বন্ধ করা নাকি কিছু অর্জন করা ছিল আমেরিকার উদ্দেশ্য? ইরানকে পারমাণবিক বোমা তৈরি থেকে বিরত রাখার দাবি, নাকি বোমা না থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পর ট্রাম্পের কৃতিত্ব অর্জন? ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে অভয় দেওয়াও কি আমেরিকার একটি উদ্দেশ্য হতে পারে?
ইরান বারবার দাবি করেছে যে তাদের কাছে পারমাণবিক শক্তি আছে। তবে পারমাণবিক অস্ত্র নয়। তারা পারমাণবিক শক্তিকে শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে, বিশেষ করে জ্বালানি উৎপাদনে ব্যবহার করতে চায়। তবে ইসরায়েল এই দাবি শুনতে নারাজ।
তারা ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করার পাশাপাশি এর সঙ্গে জড়িতদের হত্যা করেও নিশ্চিন্তে থাকতে চায়। ইসরায়েলের আশঙ্কা, ইরান তাদের জন্য মধ্যপ্রাচ্যে একমাত্র হুমকি। কারণ ইহুদিবাদের বিস্তার শুরু হলে শুধুমাত্র ইরানই তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
তাই ইরানের হাতে থাকা পারমানবিক শক্তিকে দেশটি যেন সামরিক কাজে ব্যবহার করতে না পারে ইসরায়েল সেই নিশ্চয়তা চায়। কিন্তু আমেরিকা ছাড়া আর কি কারো দায় পড়েছে তাদের সেই নিশ্চয়তা দেওয়ার? অবশ্যই না।
এত কিছুর পরও দাবি করা হচ্ছে যে ইরানের কাছে যা আছে, তাতে দশটি পারমাণবিক বোমা তৈরি হতে পারে।চাইলে হলে পারে। কারণ ইরানের দাবি মতে তাদের কাছে ইউরেনিয়াম আছে। কিন্তু মানববিধ্বংসী বোমা বা পরমানুস্ত্র নয়।
তবে পারমাণবিক বোমা তৈরি হবে কি না, তা এখনো খামেনির সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে। এমনকি চরম উত্তেজনার দিনগুলোতেও খামেনি পারমাণবিক বোমা তৈরির অনুমোদন দেননি। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, তার পথ কোরআন দ্বারা নির্দেশিত, যেখানে পারমাণবিক বোমার মতো ধ্বংসাত্মক কোনো পথের নির্দেশনা নেই।
ইরানের কাছে পারমাণবিক বোমা না থাকা সত্ত্বেও ইসরায়েলের এই আগ্রাসন এবং ভয় পেয়ে আমেরিকাকে এই যুদ্ধে জড়ানো হাস্যকর বিষয় বলে অনেকে মনে করেন। ইসরায়েল তার 'আয়রন ডোম'-এর অহংকার ইরানের কাছে চূর্ণ করে বরাবরের মতোই আমেরিকার করুণার দাসে পরিণত হয়েছে বলেও মনে হচ্ছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন ইরান তার দুই মিত্র চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে যে সাহায্য পাবে, তাতে তারা আরও শক্তিশালী হবে। ইতিমধ্যেই তারা ইসরায়েলের অহংকার শেষ করেছে। ইরানের তুলনায় ইসরায়েল একটি ছোট দেশ।
তবে প্রযুক্তি ও সুরক্ষায় তারা এগিয়ে থাকলেও, শুধুমাত্র দেশজুড়ে বাঙ্কার থাকায় প্রাণহানি তুলনামূলকভাবে কমের মধ্যেই আটকাতে পেরেছে দেশটি। তবে অর্থের বিচারে সম্পদহানির তালিকাটা ইসরায়েলের জন্যই অনেক বড় হয়েছে।
আমেরিকাকে দিয়ে ইরানের পারমানবিক অস্ত্রভান্ডার খতিয়ে দেখে আদতে ইসরায়েল কি অর্জন করলো তা এখনো স্পষ্ট নয়। কারণ তাদের শক্তিশালী গোয়েন্দা দল বেডরুমে ঢুকে জেনারেলদের হত্যা করতে সফলতা দেখালেও পরমানু অস্ত্রের বিষয়ে নিশ্চিত তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে বললে খুব বেশী ভুল হবে মনে করছি না।
এতো কিছুর পরও মধ্যপ্রাচ্যে আদৌ শান্তি ফিরবে কি না, তা এখনো অজানা। যেকোনো সময় এই যুদ্ধবিরতির নীরবতা ভেঙে আবার আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র গর্জে উঠতে পারে। তখন যদি কোনো প্রকার ঘোষণা ছাড়াই রাশিয়া, চীন এবং উত্তর কোরিয়া এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাহলে কি বিশ্ব অবাক হবে? এই তিনটি দেশের মধ্যপ্রাচ্যের বন্ধু ইরান।
কারণ অন্য দেশগুলো আমেরিকার সাথে একাকার হয়ে গেছে বহু আগেই। আমেরিকার বেইস্ প্রায় সবগুলো দেশেই আছে। কাতার তো আক্রমনেরও শিকার হয়েছে। ওদিকে হুতি আর হামাস তো সুযোগের অপেক্ষায়। সময় হলেই হয়তো ইরানের পক্ষ নিয়ে আবার মরনকামড় তুলবে। কারণ ১২ দিনের যুদ্ধ মূলত মোটা দাগে ইসরায়েলের শক্তি যাচাই হয়ে গেছে। অনেক যুদ্ধ বিশ্লেষক মনে করেন, আমেরিকা চুপ থাকলে ইরান একাই ইসরায়েলের জন্য যথেষ্ট ছিল।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের মতো, ইসরায়েল-ইরান যুদ্ধে আমেরিকার হঠাৎ করে প্রবেশ অনেক সন্দেহ ও প্রশ্ন জন্ম দেয়। ভারত-পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সন্দেহ ছিল যে, পাকিস্তানের পারমাণবিক প্রকল্পের ক্ষতি ঠেকাতে ট্রাম্প রাতারাতি ঢুকে যুদ্ধ থামিয়েছিলেন।
একইভাবে, ইরানের ইউরেনিয়াম সরিয়ে নেওয়ার পর আমেরিকা কেন ফাঁকা মাঠে বি-২ বোমা মেরে আবার যুদ্ধবিরতির ডাক দিল? আমেরিকা যখন একটি পক্ষে যুদ্ধেই জড়িয়েছে, তখন কেন যুদ্ধবিরতির ডাক দিল, সেটাও প্রশ্ন।
ওদিকে মার্কিন সিনেট তাকে আবার যুদ্ধের ক্ষমতা দিয়েছে, অথচ তিনি নিজেই মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন যুদ্ধ না করার কথা বলেছেন। তাহলে কোনটা আসল উদ্দেশ্য? ইসরায়েলকে দিয়ে যুদ্ধ শুরু করে ইরানকে ইউরেনিয়াম সরিয়ে নিতে বলা এবং সেখানে বি-২ বোমা মেরে পরে শান্তির ডাক দেওয়া, নাকি নতুন করে যুদ্ধের জন্য ইরানকে উস্কে দিয়ে পরে আবার নতুন করে 'যুদ্ধ যুদ্ধ' খেলা শুরু করা? এখন তা কেবল সময়ের অপেক্ষায়।
এখন পযন্ত যা হয়েছে তাতে একথা বলা যায় যে ‘মধ্যপ্রাচ্য শান্তি অনেক সস্তায় পেয়েছে’। এই শান্তিকে ধরে রাখতে চীন, রাশিয়ারমত দেশগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। তারা ইরানের বন্ধু হলেও যুদ্ধে জড়ায়নি। তবে আমেরিকাকে দিয়ে শান্তির আশা করা হবে হটকারি চিন্তা। কারণ তারা যুদ্ধের আগে থেকেই এই যুদ্ধের একটি পক্ষ। যুদ্ধের মধ্যেও তার প্রমাণ দিয়েছে।
কাতারে আরেমরিকান বেইস্ এ ইরান হামলা না করলে আমেরিকা যুদ্ধ বিরাতির ডাক দিতে কি-না তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। তাদের হয় তো ধারণা ছিলো বি-২ বোমা হামলার পর ইরান হতভম্ব হয়ে পড়বে। কিন্তু তা না হয়ে যখন পাল্টা জবাব হিসেবে কাতারের ইউএস বেইস্ এ আঘাত করলো তখন মধ্য প্রাচ্যের অন্যান্য মার্কিন ঘাঁটিগুলোও হুমকির মুখে পারলো।
ফলে পুরো মধ্যপ্রাচ্যেই আমেরিকার ঘাটিগুলো অরক্ষিত হয়ে ওঠলো। এতে ইরান ছাড়া অন্য আমেরিকান গোপন বা ঘাপটি মোরে থাকা শত্রুরা সুযোগ নিলে শুধু ইসরায়েলই নয় খোদ আমেরিকারই ইতিহাস নতুন করে লেখা হতে পারতো সম্ভাবত।
লেখক: মো: আবু সাঈদ; ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ।