‘জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন’ সংশোধনী অধ্যাদেশ জারি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ৩ জুন জারি করা নতুন অধ্যাদেশে দুই জায়গায় জামায়াতকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী বলা হয়েছে। সেই সহযোগিতা যে সশস্ত্র ছিল, তারও ইঙ্গিত মিলেছে। যাদের বিরুদ্ধে করা যুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধ ও যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলে তিনি মুক্তিযোদ্ধা হবেন, দুটি জায়গাতেই জামায়াতে ইসলামীর নাম আছে। যদিও ইদানীং জামায়াত নেতাদের দাবি হলো, তাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা ছিল নিছকই রাজনৈতিক।
৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর জামায়াতেরউত্থান নিয়েও তুমুল আলোচনা চলছে। এটাও বলাবলি হচ্ছে যে, অন্তর্বর্তী সরকারের একটি শক্তির জায়গা জামায়াত।
গত ২২ মে মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে যে আলোচনা তৈরি হয়েছিল, সেদিন জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানই তাকে সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহেরও সোজাসাপ্টা বলেছিলেন, এই সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে। সেদিন সরকারের যে ভঙ্গুর অবস্থান দেখা গিয়েছিল, সেটি অবশ্য এখন আর নেই।
গত ১০ মাসে জামায়াত যে নিজেকে আগের চেয়ে বেশি শক্তিশালী অবস্থানে দেখছে, সেই বিষয়টিও স্পষ্ট। দুই যুগের জোট সঙ্গী বিএনপির সঙ্গে জামায়াত বাহাসে জড়াচ্ছে, এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। তবে বিএনপি আবার জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অবস্থান তুলে এনে দলটিকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। যদিও ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে জামায়াতকে ক্ষমতার অংশীদার করেছিল বিএনপি, আলবদর বাহিনীর দুই নেতা নিজামী ও মুজাহিদকে মন্ত্রী করার পর তুমুল সমালোচনাও হয়েছে।এর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের জারি করা এই অধ্যাদেশটি যে বিএনপি সমর্থকদের হাতে ‘হাতিয়ার’ তুলে দিয়েছে, সেটিও স্পষ্ট। অধ্যাদেশটিতে একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে যে কথা লেখা আছে, সেই পৃষ্ঠা দুটি বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা সামাজিক মাধ্যমে দেদার শেয়ার করছেন।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন ২০২২ সংশোধন কল্পে প্রণীত অধ্যাদেশে ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা’র যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সেটি হলো: “যাহারা ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ হইতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের অভ্যন্তরে গ্রামেগঞ্জে যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং অভ্যন্তরীণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করিয়াছেন এবং যে সকল ব্যক্তি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বাংলাদেশের
সীমানা অতিক্রম করিয়া ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে তাহাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করিয়াছেন এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে পাকিস্তানের বিপক্ষে যুদ্ধে লিপ্ত হইয়া হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী ও তাহাদের এ দেশীয় সহযোগী রাজাকার, আল বদর, আল শামস, তৎকালীন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করিয়াছেন।”মুক্তিযুদ্ধের যে সংজ্ঞা দেওয়া আছে, তাতে লেখা হয়েছে, “১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষায় হানাদার ও দখলদার পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী এবং তাহাদের সহযোগী রাজাকার, আল বদর, আল শামস, তৎকালীন মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম এবং দালাল ও শান্তি কমিটির বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধ।”
এই দুই সংজ্ঞায় এটাই স্পষ্ট যে, অন্তর্বর্তী সরকারও মনে করছে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের জামায়াতের বাংলাদেশ বিরোধিতা কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং অস্ত্র হাতেও তারা লড়াই করেছে।
এই সংজ্ঞায় যে আলবদর বাহিনীর কথা বলা আছে, সেটি সে সময় জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতাকর্মীরা গড়ে তুলেছিলেন। জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ এই বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়েছেন।
আল বদর বাহিনীর পক্ষে জামায়াতের মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় নিজামীর লেখা এখনও অনলাইনে খুঁজে পাওয়া যায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মে মাসে খুলনার খানজাহান আলী সড়কে জামায়াত নেতা আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর প্রথম ইউনিট শপথ গ্রহণ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক এম এ কাউসার বলেন, “জামায়াতে ইসলাম কী বলবে সেটি তো আমি বলতে পারব না। তবে মুক্তিযুদ্ধটা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে ছিল। এই বাহিনীকে যারা সহযোগিতা করেছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধটা চলে আসে।”
আল বদর, আল শামসসহ যারাই সহযোগিতা করেছে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের শত্রুপক্ষ ছিল বলে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, “ফলে শত্রুপক্ষকে শুধু জামায়াত ইসলামী নয়, সে সময় থাকা কোনো দলের কোনো সদস্য যদি সহযোগিতা করে তারাও তো শত্রুপক্ষের দোসর হিসেবে থাকবে।”
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই আজম বলেছেন, “ আমরা যেটা ইতিহাসে সত্য সেটা উল্লেখ করেছি। জামায়াতকে আমরা পাকিস্তানের সহযোগী বলছি। আর তারা আলবদর নামে একটা দল বানিয়েছিল না?”
জামায়াতের প্রচার সম্পাদক মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘‘এ বিষয়টি নিয়ে কোনো ব্যক্তিগত মন্তব্য করার সুযোগ নেই। এটা সাংগঠনিক বিষয়। এ নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা হবে। এরপর আমরা এ বিষয়ে জানাতে পারব।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মামুন আল মোস্তফা মনে করেন, এই অধ্যাদেশে জামায়াতের মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা উঠে এলেও দলটি খুব একটা নাখোশ হবে না।
কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “এখানে খুবই মুন্সিয়ানার সঙ্গে ‘তৎকালীন জামায়াতের’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। তার মানে, বর্তমানের জামায়াত সেই আগের জামায়াত নয়, এমন একটি ব্যাখ্যা করা সম্ভব।”
“আমার মনে হয়, এখানে সরকার স্বীকৃতি দিচ্ছে যে, তাদের সঙ্গে যে জামায়াত আছে, সেই জামায়াত আর একাত্তরের জামায়াত এক নয়। এ জন্য জামায়াত মনে হয় না খুব একটা অখুশি হবে।”
কিন্তু জামায়াত তো একাত্তরের ভূমিকার জন্য কখনও দুঃখ প্রকাশ করেনি, সে ক্ষেত্রে ‘একাত্তরের জামায়াত’ আর ‘বর্তমান জামায়াত’ এই বিষয়টি কি আলাদা করা সম্ভব?- এই প্রশ্নে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই শিক্ষক বলেন, “আসলে জামায়াত যাদের ভোট পেয়ে থাকে, তাদের কাছে একাত্তর কোনো গুরুতর প্রশ্ন নয়।
“আর একাত্তরের পরে নিষিদ্ধ জামায়াত তো ১৯৭৬/৭৭ খ্রিষ্টাব্দের বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য এবং সংবিধান মেনে চলার শর্তে নিবন্ধন নিয়েছে। এখনকার জামায়াত তো বলতে পারে, তারা বাংলাদেশের অস্তিত্ব ও সংবিধান মেনে নিয়ে কাজ করছে।”
অধ্যাদেশে মুসলিম লীগ-জামায়াতের নামের আগে ‘তৎকালীন’ শব্দ কেন?- এই প্রশ্নে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা আজম “যুদ্ধটা তো তখনকার বিষয়। আর সে সময়ের জামায়াত পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছে।”
আপনি কি তবে মনে করেন, এখনকার জামায়াত সেই সময়ের অবস্থানকে অস্বীকার করে?- উপদেষ্টা বলেন, “আমি এটা মনে করি না। এটার ব্যাপারে তারা ব্যাখ্যা দেবে। তাদের কাছে জিজ্ঞেস করতে পারেন।”
এখনকার জামায়াতকেও মুক্তিযুদ্ধের অবস্থানের দায় নিতে হবে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তাদেরকে তো বলতে হবে যে তৎকালীন জামায়াতের অবস্থান আমরা স্বীকার করি না।”
পাকিস্তানকে সমর্থন ‘অপরাধ না’: জামায়াত
জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানের গত নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের একটি বক্তব্য প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে।
যুক্তরাজ্যের লন্ডনে মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে সেদিন বলেন, “ইয়েস, জামায়াতে ইসলামী ওয়ান পাকিস্তানের পক্ষে সাপোর্ট দিয়েছিল। এটা রাজনীতিতে অপরাধ না। তখন পাকিস্তানের অংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান।”
এক কোটি মানুষ ভারতে গেলেও তাদের যাওয়ার জায়গা ছিল না বলে দাবি করে তিনি বলেন, “জামায়াতে ইসলামী বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য সে সময় দেশের ভেতরে থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা ও তাদের পক্ষে অবস্থান নেওয়া ছাড়া আর কিছু করার ‘সুযোগ ছিল না। শুধু জামায়াত না, যারা ইন্ডিয়ায় যেতে পারেনি তারা সকলেই পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।”
বাকিদের প্রসঙ্গ না এলেও জামায়াতের প্রসঙ্গটা আসে বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কারণ, বাকি দলগুলো নিজেদের কার্যক্রমের মাধ্যমে জাতির সামনে নিজেদের অবস্থানটা তুলে ধরতে পারেনি, রাজনীতিতে তাদের অবস্থানটা উল্লেখযোগ্য না। তাদেরকে কেউ মাথাব্যথা হিসেবে নিচ্ছে না। সাবজেক্ট হিসেবে থেকে গেল জামায়াতে ইসলামী।”
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিয়োগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।