অডিও-ভিডিও বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে বিচারপ্রার্থী পক্ষগণ, তাদের আইনজীবী বা সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তি বা সাক্ষীগণের ভার্চুয়াল উপস্থিতিতে সাক্ষ্য গ্রহণ ও শুনানি সংক্রান্ত অনুসরণীয় ‘প্র্যাকটিস নির্দেশনা’ জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন।
আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার আইন, ২০২০-এর ক্ষমতাবলে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ গত ১৪ মে নতুন এই ‘প্র্যাকটিস নির্দেশনা’ জারি করেছেন।
এর আগে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ২০ আগস্ট একই বিষয়ে জারি করা পূর্ব প্র্যাকটিস নির্দেশনা বাতিল করা হয়েছে। নতুন এই প্র্যাকটিস নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘বিচারক এবং ডাক্তার সাক্ষীদের সাক্ষ্য অবশ্যই অডিও-ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হবে। তবে উল্লেখ্য যে, বিচারিক আদালত যদি মনে করেন মামলার ধরন অনুযায়ী বিচারক এবং ডাক্তার সাক্ষীদের সাক্ষ্য সশরীরে গ্রহণ করা আবশ্যক, সেক্ষেত্রে তাদের সশরীরে সাক্ষ্য গ্রহণের বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করতে পারবেন।’
প্র্যাকটিস নির্দেশনা-সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, অডিও-ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের সাধারণ নীতি হচ্ছে, ‘আদালতের কাছে স্বীয় বিবেচনায় কিংবা মামলাসংশ্লিষ্ট কোনো পক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যদি প্রতীয়মান হয় যে, মামলাটি চাঞ্চল্যকর; কিংবা মামলার কোনো পক্ষ, সাক্ষী বা অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আদালতে সশরীরে হাজির করলে বিশেষ পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে; অথবা মামলাটির কোনো পক্ষ, সাক্ষী বা অভিযুক্ত ব্যক্তি দূরত্ব বা অন্য কোনো যুক্তিসংগত কারণে আদালতে উপস্থিত হতে পারবেন না; সেক্ষেত্রে ওই আদালত মামলার যে কোনো পর্যায়ের যে কোনো কার্যক্রম (যেসব ক্ষেত্রে আদালতের দৃষ্টিতে কারও শারীরিক উপস্থিতি আবশ্যক এমন পর্যায় ছাড়া) অডিও-ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের নির্দেশনা প্রদান করবেন।’
আদালত প্রান্ত এবং দূরবর্তী প্রান্তে অডিও-ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যেসব সুবিধা থাকতে হবে বলে প্র্যাকটিস নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ‘ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট সংযোগসহ মোবাইল ডিভাইস এবং প্রিন্টার; নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার ডিভাইস; ক্যামেরা, মাইক্রোফোন এবং স্পিকার; প্রদর্শন ইউনিট; গোপনীয়তা নিশ্চিত করে পর্যাপ্ত বসার ব্যবস্থা; পর্যাপ্ত আলো এবং একটি শান্ত এবং নিরাপদ স্থানের প্রাপ্যতা।’
প্র্যাকটিস নির্দেশনায় প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে আদালত প্রান্তে একজন এবং দূরবর্তী প্রান্তে একজন সমন্বয়কারী থাকবেন। আদালত প্রান্তে আদালত নিজে অথবা আদালত কর্তৃক মনোনীত একজন সমন্বয়কারী থাকবেন।
দূরবর্তী প্রান্তে নিজের তালিকা অনুযায়ী একজন সমন্বয়কারী হিসেবে থাকবেন। এক্ষেত্রে দূরবর্তী স্থান দেশের বাইরে হলে সমন্বয়কারী হবেন বাংলাদেশি সংশ্লিষ্ট কনস্যুলেট বা দূতাবাস অথবা হাইকমিশনের একজন কর্মকর্তা। দূরবর্তী স্থান কারাগার হলে সংশ্লিষ্ট কারাগারের জেল সুপারিনটেনডেন্ট বা দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সমন্বয়কারী হবেন। দূরবর্তী স্থান হাসপাতাল হলে সমন্বয়কারী হবেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মনোনীত কোনো কর্মকর্তা।
নিরাপদ ছাদ, প্রত্যয়িত প্রতিষ্ঠান, শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র বা যে কোনো প্রতিষ্ঠান যেখানে ‘আইনের সংস্পর্শে আসা শিশু’কে রাখা হয়েছে, সেখানে সমন্বয়কারী হবেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধায়ক বা দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্য কোনো কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিস বা জেলা লিগ্যাল এইড অফিস দূরবর্তী স্থান হলে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড অফিসার বা জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার সমন্বয়কারী হবেন। ফরেনসিক ল্যাবরেটরিতে সমন্বয়কারী হবেন সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের মনোনীত কোনো কর্মকর্তা। এ ছাড়া অন্য যে কোনো স্থানে সমন্বয়কারী হবেন সংশ্লিষ্ট আদালত কর্তৃক মনোনীত যে কোনো ব্যক্তি।
প্র্যাকটিস নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, ‘আদালতে ভার্চুয়াল উপস্থিতি প্রয়োজন এমন কোনো ব্যক্তি যখন এমন কোনো দূরবর্তী প্রান্তে থাকেন, যেখানে অডিও-ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের সুবিধাগুলো অনুপস্থিত, তখন সংশ্লিষ্ট আদালত দূরবর্তী প্রান্তের স্থানীয় এখতিয়ার সম্পন্ন জেলাকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করবেন নিকটবর্তী এবং উপযুক্ত স্থান থেকে একটি অডিও-ভিডিও কনফারেন্সিং সুবিধা প্রদানের ব্যবস্থা করার জন্য।
আদালত প্রান্ত এবং দূরবর্তী প্রান্ত উভয় প্রান্তের সমন্বয়কারীরা নিশ্চিত করবেন যে অডিও-ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের সময়ে ডেস্কটপ, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট সংযোগসহ যেসব সুবিধা থাকার কথা, সে সুবিধাসমূহ পাওয়া যাবে। এ ছাড়া দূরবর্তী প্রান্তের সমন্বয়কারী নিশ্চিত করবেন যে, ‘কনফারেন্সিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যক্তি নির্ধারিত সময়ের কমপক্ষে ৩০ মিনিট আগে দূরবর্তী প্রান্তে প্রস্তুত হয়েছে। কোনো অননুমোদিত রেকর্ডিং ডিভাইস ব্যবহার করা হচ্ছে না।
অডিও-ভিডিও কনফারেন্স চলাকালীন কোনো অননুমোদিত ব্যক্তি কনফারেন্স রুমে প্রবেশ করবেন না। যে ব্যক্তিকে পরীক্ষা করা হচ্ছে, তাকে কোনোভাবে প্ররোচিত করা, টিউটর করা, বাধ্য করা হয়নি এবং যে ব্যক্তিকে পরীক্ষা করা হচ্ছে তাকে কনফারেন্স চলাকালীন সংশ্লিষ্ট আদালতের অনুমতি ছাড়া কোনো নথি, স্ক্রিন বা ডিভাইস দেখানো হয়নি। এ ছাড়া আদালত অডিও-ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের সময়সূচি নির্ধারণ করে নোটিশ দেবেন এবং উপযুক্ত ক্ষেত্রে দূরবর্তী প্রান্তের সমন্বয়কারীর অফিসিয়াল ইমেইল অ্যাকাউন্টে মামলার কাগজপত্রের প্রয়োজনীয় অংশের স্ক্যানকপি আগেই প্রেরণ করবেন।’
‘অডিও-ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের পদ্ধতি’
আদালত কর্তৃক মামলার কার্যক্রম অডিও-ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হবে মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে আদালত অডিও-ভিডিও কনফারেন্সের সময়সূচি নির্ধারণ করবেন। অডিও-ভিডিও কনফারেন্সের আবেদনে অডিও-ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে উপস্থিতি, শুনানি অথবা সাক্ষ্য গ্রহণের সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের শনাক্তকরণের সুবিধার্থে জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, টেলিফোন বা মোবাইল নম্বর, ইমেইল আইডি-সংক্রান্ত তথ্য উল্লেখ করতে হবে। জেলহাজতে আটক অভিযুক্ত বা সাক্ষীর ক্ষেত্রে কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আবেদন করা যাবে।
অথবা আদালত ওই তথ্যাবলি সরবরাহের জন্য সংশ্লিষ্ট পক্ষকে নির্দেশ প্রদান করবেন। আদালত প্রান্তের সমন্বয়কারী অডিও-ভিডিও কনফারেন্সে অংশগ্রহণকারীদের ইমেইল আইডি বা মোবাইল নম্বরের মাধ্যমে মিটিং লিঙ্ক বা মিটিং আইডি অথবা পাসওয়ার্ড (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) প্রেরণ করবেন।
অডিও-ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সাক্ষ্যগ্রহণের পূর্বে দূরবর্তী প্রান্তে উপস্থিত অভিযুক্ত ব্যক্তি বা সাক্ষীকে ওই স্থান থেকে অডিও-ভিডিও সংযোগের মাধ্যমে আদালত প্রান্তে সংশ্লিষ্ট বিচারক কর্তৃক শপথ পাঠ করাতে হবে। পরীক্ষা শেষ হলে গৃহীত সাক্ষ্যে আদালত প্রান্তে সংশ্লিষ্ট বিচারক এবং পক্ষদের প্রতিনিধি (যদি থাকে) দ্বারা স্বাক্ষরিত হবে এবং এটির স্ক্যানকপি দূরবর্তী প্রান্তে সমন্বয়কারীর অফিসিয়াল ইমেইলে পাঠানো হবে।
দূরবর্তী প্রান্তের সমন্বয়কারী গৃহীত সাক্ষ্যের প্রিন্ট আউট নিয়ে তাতে পরীক্ষিত ব্যক্তির স্বাক্ষর নেবেন এবং নিজে স্বাক্ষর করবেন। এরপর স্ক্যানকপি আদালত প্রান্তে ইমেইলের মাধ্যমে প্রেরণ করবেন এবং হার্ডকপি পরবর্তী ৩ কার্যদিবসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট আদালত বরাবরে প্রাপ্তি স্বীকার পত্রসহ রেজিস্টার্ড ডাকযোগে প্রেরণ করবেন। অডিও-ভিডিও কনফারেন্সিং কার্যক্রম শেষ হলে, আদালত আদেশনামায় কনফারেন্সিংয়ের সময় ও স্থায়িত্বকাল উল্লেখ করবেন এবং কনফারেন্সিংয়ে ব্যবহৃত সফটওয়্যার বা প্ল্যাটফর্মের নাম উল্লেখ করবেন।
এ ছাড়া আদালত কনফারেন্সিংকালে এর অডিও-ভিডিও এবং সংযোগের বিষয়ে তার সন্তুষ্টি আদেশে উল্লেখ করবেন। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি কর্তৃক পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এ নির্দেশনা কার্যকর থাকবে।