মহাত্মা হ্যানিম্যানঃ চিকিৎসা শিক্ষায় এক আলোর দিশারী | মতামত নিউজ

মহাত্মা হ্যানিম্যানঃ চিকিৎসা শিক্ষায় এক আলোর দিশারী

কে এই মহাত্মা ? অল্প কথায় তার পরিচয় দেয়া সম্ভব নয় কারণ তিনি নিজেই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। সমমত দ্রষ্টা ঋষি স্যামুয়েল হ্যানিম্যানের জন্ম হয়েছিলো ১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ১০ এপ্রিল জার্মানির অন্তর্গত স্যাক্সনি প্রদেশের মাইসেন নামে একটি ক্ষুদ্র গ্রামের এক সামান্য গৃহস্থের ঘরে মধ্যরাতের পর।

#মহাত্মা হ্যানিম্যান #চিকিৎসা শিক্ষা

হ্যানিম্যান এবং হোমিওপ্যাথি –এ দু’টি শব্দ যেনো একে অন্যের পরিপূরক, হোমিওপ্যাথি শব্দটি উচ্চারণ করলেই হ্যানিম্যানের নাম আপনাআপনি এসে পড়ে। হোমিওপ্যাথি বা ‘সদৃশবিধান’ শব্দটির সঙ্গে মানুষ প্রথম পরিচিত হয় ১৮১০ খ্রিষ্টাব্দে মহাত্মা হ্যানিম্যান রচিত ‘অর্গানন অব মেডিসিন’ নামক গ্রন্থ প্রকাশের পর।

হ্যানিম্যান স্বয়ং অ্যালোপ্যাথিক শাস্ত্রে এমডি ডিগ্রিধারী হয়েও তিনি তার লেখায় অ্যালোপ্যাথিক ওষুধ ব্যবহারের নানা কুফল সম্পর্কে তুলে ধরেন, অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার বিভিন্ন সমালোচনা করেন এবং চিকিৎসা জগতে একমাত্র আরোগ্যনীতি ‘সমমত’ বা সদৃশ বিধিই প্রাকৃতিক নিয়ম বলে দাবি করেন। তিনি সুস্থ শরীরে লব্ধ ভেষজসমূহের গুণাগুণ সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন মেটিরিয়া মেডিকা পিউরা নামক গ্রন্থে। নতুন কোনো মতামত সহজে গ্রহণ করা সর্বকালেই মানুষের স্বভাব বিরোধী। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো মহাপুরুষকেই দেখা যায়নি বিনা বাধায় নিজস্ব মতামত প্রতিষ্ঠা করতে । ধর্ম, কর্ম ও বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যেসব দিগ্ববিজয়ী, প্রতিভাশালী ব্যক্তিত্ব জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাদের প্রায় সবাইকেই প্রথমে উপেক্ষা, বিভিন্ন বাধা এবং পরে শারীরিক লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে। স্যামুয়েল হ্যানিম্যানও তার ব্যতিক্রম নন।

কে এই মহাত্মা ? অল্প কথায় তার পরিচয় দেয়া সম্ভব নয় কারণ তিনি নিজেই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। সমমত দ্রষ্টা ঋষি স্যামুয়েল হ্যানিম্যানের জন্ম হয়েছিলো ১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দের ১০ এপ্রিল জার্মানির অন্তর্গত স্যাক্সনি প্রদেশের মাইসেন নামে একটি ক্ষুদ্র গ্রামের এক সামান্য গৃহস্থের ঘরে মধ্যরাতের পর। তার সুদীর্ঘ জীবননাট্যের ঘটনাবহুল গৌরবদীপ্ত, ভাস্বর অধ্যায়ের সঙ্গে পরিচিত হতে একান্ত আগ্রহ প্রকাশ করে থাকেন প্রত্যেক জ্ঞানপিপাসু মানুষ বিশেষ করে যারা হোমিওশাস্ত্র সমপর্কে সম্যক অবহিত। স্বল্প পরিসরে এই মহাত্মার জীবনী তুলে ধরা প্রায়ই অসম্ভব তবে সংক্ষেপে বলা যায় ধর্ম প্রচারে আল্লাহর নবীদেরকে যেরূপ যাতনা, লাঞ্ছনা ও অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করতে হয়েছিলো, একইভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞানে সেকালে সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী(এমডি) এই মহামানবকেও নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিলো কেনোনা তিনি প্রচলিত মতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন।

সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য পরার্থে উৎসর্গীকৃত হ্যানিম্যান, অকুতোভয়ে প্রবল বিরোধী শক্তির সঙ্গে সংগ্রাম করে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তার হোমিও চিকিৎসা পদ্ধতি। তার পিতা গডফ্রে হ্যানিম্যান তাকে সবসময় বলতেন, ‘সকল বিষয়ে ভালো করে পরীক্ষা করবে, যেটা সত্য বলে প্রমাণিত হবে সেটা গ্রহণ করবে।’ মহানুভব হ্যানিম্যান পিতার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। তিনি স্বীয় অলৌকিক প্রতিভা ও অসীম অধ্যাবসায়ের প্রভাবে শত সহস্র বিঘ্ন-বিপত্তি অতিক্রম করে মানব জীবনের এক আদর্শ স্থানে নিজেকে উপনীত করেছিলেন। তার অসচ্ছল পিতা সন্তানের উচ্চশিক্ষার ব্যয় বহনে অপারগতা প্রকাশ করলে বালক হ্যানিম্যানের অসাধারণ ধীশক্তি, অবিচলিত অধ্যাবসায় এবং সরলতাপূর্ণ সৎস্বভাব দেখে তার অধ্যাপকরা তার শিক্ষার সমস্ত ব্যয় বহনে রাজি হয়েছিলেন।
ঐ বয়সেই তিনি কয়েকখানি ইংরেজি গ্রন্থ জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে বেশকিছু অর্থ উপার্জনেও সমর্থ হয়েছিলেন। অধ্যাপক ডা. কোয়ারিন এবং পরবর্তীতে ভেষজশাস্ত্রে অদ্বিতীয় পণ্ডিত ডা. ওয়াগনারের সহায়তায় অল্পকালের মধ্যেই হ্যানিম্যান একজন খ্যাতনামা চিকিৎসক হিসেবে যশলাভ করলেন। তার খ্যাতি এতটাই প্রসার লাভ করেছিলো যে সেকালে অনেক রোগীই মনে করতেন হ্যানিম্যানের দর্শন লাভ করতে পারলেই তারা সুস্থ হয়ে উঠবেন। কিন্তু এই সময় হতেই প্রচলিত চিকিৎসার প্রতি হ্যানিম্যানের সংশয় ও অনাস্থা ক্রমেই পুঞ্জিভূত ও বদ্ধমূল হতে লাগলো। যে সন্দেহ-বীজ পরিপক্ক হয়ে সমস্ত চিকিৎসা-শাস্ত্রকে কাল্পনিক ভিত্তি হতে উদ্ধার করে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির ওপর স্থাপন করবে, সেই সন্দেহ-বীজ এক্ষণে তার বিশাল মনক্ষেত্র দখল করে ফেললো। অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা পদ্ধতি থেকে তার চিন্তাপ্রসূত গতিপথ অন্য ধারায় প্রবাহিত হতে লাগলো।
তিনি আপাতত চিকিৎসা–ব্যবসায় পরিত্যাগ করে রসায়ন ও সাহিত্য নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখলেন এবং ভাবতে লাগলেন কী উপায়ে একটি সহজ, নিশ্চিত ও বিশ্বাসযোগ্য চিকিৎসা প্রণালী উদ্ভাবন করা যায় যা ব্যবহারে শরীরের কোনো ক্ষতি না করে বা বিশেষ কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই রোগের মূলোৎপাটন করা যায়। আর ঠিক তখন হতেই হোমিপ্যাথির সমূহসম্ভাবনার উজ্জ্বল আলোকরশ্মি পশ্চিমাকাশের দিকচক্রবাল রেখা ভেদ করে ক্রমেই স্ফুরিত হতে লাগলো। কুইনাইনের গুণাগুণ পাঠে তার মস্তিষ্কে নতুন চিন্তার অনুপ্রবেশ ঘটলো।

মো. নজরুল ইসলাম মো. নজরুল ইসলাম

হোমিওপ্যাথি কী, হোমিও ওষুধ কীভাবে কাজ করে --এ সম্পর্কে অনেকেরই পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই, তাই এ বিষয়ে ধারণা দেয়া প্রয়োজন। ইংরেজি হোমিওপ্যাথি শব্দটি গ্রিক Homoeopathia (homoios=like, pathos=feeling) হতে উৎপন্ন । অতএব এর শব্দগত অর্থ হলো—সদৃশ লক্ষণদৃষ্টে চিকিৎসা বা সদৃশ বিধান চিকিৎসা। সুস্থ কোনো ব্যক্তির শরীরে বিশেষ কোনো একটি ওষুধ প্রয়োগ করলে তার শরীরে কতগুলো দ্রব্যজাত লক্ষণ প্রকাশ পায় এবং কোনো পীড়ায় ঠিক ঐ লক্ষণসমূহ দৃশ্যমান হলে সেই পীড়ায় ঐ ওষুধ দ্বারা চিকিৎসা করাকেই সদৃশবিধান চিকিৎসা বা হোমিওপ্যাথি বলে। এই পদ্ধতিতে অল্প মাত্রায় সমগুণ সম্পন্ন ওষুধ প্রয়োগে বিস্ময়কর ফল পাওয়া যায়। অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের স্থুলমাত্রার প্রয়োগ রোগ নিরাময়ের সঙ্গে সঙ্গে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় শরীরের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে, রোগী দুর্বলতা অনুভব করে।

হোমিওপ্যাথিক ওষুধের মাত্রা সূক্ষ্ম হওয়ায় ওষুধটি শুধু রোগ নির্মূল করে কোনোরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই। হ্যানিম্যান লক্ষ্য করলেন যে অ্যালোপ্যাথিকের স্থুলমাত্রার প্রয়োগে রোগী আরোগ্য হয়েও কিছুদিন পর রোগীর শরীরে কিছু নতুন কুলক্ষণ উৎপাদিত হয়, যেমন কুইনাইন সেবনে জ্বর আরোগ্য হয় বটে, কিন্তু পরে রক্তশূন্যতা, প্লীহা, যকৃৎ ন্যাবা, ঘুষঘুষে জ্বর ইত্যাদি নানা প্রকার উপসর্গ রোগীর শরীরে প্রকাশ পায় এবং রোগীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে আক্রান্ত করে। হ্যানিম্যান এই সময় ওষুধের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে দেখলেন ওষুধের পরিমাণ কম হলেও ঐ ওষুধের আরোগ্যদায়িনী শক্তি পূর্বের মতই অটুট থাকে এবং শরীরে কোনো কুফল উৎপাদিত হয় না। তার পরীক্ষা থেকেই তিনি তিনটি নিয়মের কথা বললেন- (১) ‘সিমিলিয়া সিমিলিবাস কিউরেন্টর’ অর্থাৎ রোগ লক্ষণের সঙ্গে ওষুধের লক্ষণের সাদৃশ্য নির্ধারণ করে ওষুধ নির্বাচন; (২) নিতান্ত স্বল্প মাত্রায় ওষুধ প্রয়োগ এবং (৩) প্রথম মাত্রায় উপকার পেলে এবং সেই উপকার বিদ্যমান থাকা অবস্থায় দ্বিতীয় মাত্রা প্রয়োগ না করা।

অনেকের ধারণা হোমিও ওষুধ অ্যালকোহল ছাড়া আর কিছুই নয়, কাজেই হোমিওর প্রতি তাদের কোনো আস্থা নেই। বিষয়টি মোটেও সত্য নয়। চারটি উৎস হতে হোমিও ওষুধ তৈরি করা হয়—(১) উদ্ভিজ জগত; (২) প্রাণি জগত;(৩) খনিজ ও রাসায়নিক জগত এবং (৪) রোগজ অর্থাৎ বিভিন্ন রোগের জীবাণু। কাজেই হোমিও ওষুধের এবং এই চিকিৎসা পদ্ধতির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

মনে রাখা দরকার ফ্রান্স ও আমেরিকার মত উন্নত দেশেও হোমিওপ্যাথিক সোসাইটি ও হাসপাতাল রয়েছে যেখান থেকে পৃথিবীর অনেক মহান ব্যক্তিরাও চিকিৎসা গ্রহণ করে থাকেন। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই হোমিও চিকিৎসা সরকারিভাবে স্বীকৃত। যে মহাত্মা এই বিরল চিকিৎসা ব্যবস্থা মানবজাতির কল্যাণে রেখে গেছেন তিনি ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২ জুলাই ৮৮ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ওপারে পাড়ি জমালেন। যাবার সময় ভক্তদের উদ্দেশে মৃদুস্বরে বলে গেলেন, ‘আমি বৃথা জীবন ধারণ করিনি। আমি মানুষকে যা সত্য, অবিনাশী, তাই দিয়ে গেলাম।’

লেখক: পরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

#মহাত্মা হ্যানিম্যান #চিকিৎসা শিক্ষা