রাজধানীতে মাসে অরাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার ২০ জনের বেশি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে এমন তথ্য।
পুলিশ সূত্র জানায়, পারিবারিক কলহ, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, অর্থনৈতিক লেনদেন ও তুচ্ছ ঘটনাকে ঘিরে মব তৈরি করে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা বাড়ছে। এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের শিকার শুধু কিশোর বা পুরুষই না, আক্রান্ত হচ্ছেন নারীরাও।
এ ধরনের অরাজনৈতিক অপরাধ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিতের পরামর্শ বিশ্লেষকদের।
অপরাধীকে চিহ্নিত করা এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব বলে মনে করেন মানবাধিকার কর্মী ও পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য এএসএম নাসির উদ্দিন এলান। তিনি বলেন, ‘অরাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলো ইনসিডেন্টের ওপর নির্ভর করে।
কোনো মাসে এটা বাড়তে পারে, আবার কমতেও পারে। এটার নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতে থাকে না। দেখা গেল স্বামী তার স্ত্রীকে হত্যা করল। সেটা চার মাস আগেও হতে পারে, আবার পরেও হতে পারে। এখন বিষয় হচ্ছে পুলিশ অপরাধীদের চিহ্নিত করতে পারছে কিনা এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারছে কিনা। যখনই এ ধরনের অপরাধীদের চিহ্নিত করা যাচ্ছে না বা আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না তখনই দেখা যায় এসব হত্যাকাণ্ড বা অপরাধ বেড়ে যায়।
ডিএমপির তথ্যমতে, গত জানুয়ারি থেকে মে—পাঁচ মাসে রাজধানীতে ১৬৮টি হত্যা মামলা রেকর্ড হয়েছে। এর মধ্যে ১০২টিই অরাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়ের, যা ঢাকার মোট হত্যা মামলার ৬১ শতাংশ। গড় হিসাব করলে প্রতি মাসে ঢাকায় অরাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ২০ জনেরও বেশি।
মাসভিত্তিক অপরাধ তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, জানুয়ারিতে অরাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে মোট ২০ জন। এরপর পর্যায়ক্রমে ফেব্রুয়ারিতে ২২, মার্চে ১৭, এপ্রিলে ২০ ও মে মাসে সর্বোচ্চ ২৩ জন অরাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে।
একই সময়ে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ৬৬ জন। এর মধ্যে বছরের প্রথম তিন মাসের প্রতি মাসেই ১৬ জন করে এমন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়। পরবর্তী দুই মাসে অবশ্য রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা কমে আসে। গত এপ্রিল ও মে মাসে নয়জন করে রাজনৈতিক কারণে খুন হয়।
রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক দুই ধরনের অপরাধই সমান গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘সব ঘটনাই আমাদের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ।
তবে অরাজনৈতিক যে হত্যাকাণ্ডগুলো হচ্ছে তার বেশির ভাগই পারিবারিক সহিংতা। আবার কিছু হচ্ছে আর্থিক লেনদেনকে কেন্দ্র করে। পাশাপাশি পূর্বশত্রুতার জেরেও এমন অপরাধ সংঘটিত হয়।
সম্প্রতি মিরপুরে এক ভাগ্নে তার দুই খালাকে মেরে ফেলল। এগুলো কিন্তু ঘরের মধ্যে সংঘটিত অরপাধ। এখানে আগাম কোনো ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ থাকে না। এ ধরনের অরাজনৈতিক অপরাধ বেড়ে যাওয়ার পেছনে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ রয়েছে। অপরাধীদের চিহ্নিত করা এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার মধ্য দিয়ে এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ বরাবরই কাজ করে যাচ্ছে।’
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার বছর হতে চললেও মব সংস্কৃতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি অরাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডও বাড়ছে বলে মনে করেন অপরাধ বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, পারিবারিক ও সামাজিক নৃশংসতা প্রতিরোধের জন্য বিচার দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ে।
এছাড়া পারস্পরিক বন্ধন গড়ে তোলা এবং সহমর্মিতা ও অন্যের প্রাপ্যতার বিষয়ে সংবেদনশীল হতে হবে। পরিবার ও সমাজে মতের অমিল ও বিভেদ চিরদিনই থাকবে, এটিকে সহিংসতায় রূপ না দিয়ে যৌক্তিক সমাধান খুঁজতে হবে। সামাজিক সংগঠনগুলোকে সক্রিয় করে, মানুষকে সৃজনশীল, মনুষ্যত্ব বোধসম্পন্ন করে গড়ে তোলা, সুকুমারবৃত্তি জাগ্রত করা, বই পড়া, খেলাধুলা, সংস্কৃতিচর্চায় গুরুত্ব দেয়াসহ সুষম প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন করে গড়ে ওঠার সুযোগ করে দেয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। সেই সঙ্গে রাষ্ট্র ও সমাজ এ কাজগুলোয় জোর দিলে নিজ থেকেই নৃশংস ঘটনাগুলো কমে আসবে বলে মনে করেন তারা।
বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ৯৩ নারী পরিবারের সদস্যদের হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৪৩ নারী। এ তিন মাসে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২৯৯ শিশু। এর মধ্যে ৮৪ শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১৬ শিশু নিহত হয়েছে পারিবারিক সহিংসতায়। আর শারীরিক নির্যাতনে হত্যার শিকার হয়েছে ২১ শিশু। এছাড়া ২৭ শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে।
ঢাকার পাশাপাশি সারা দেশেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে ১ হাজার ২৪৬টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা বেড়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে ২৯৪টি, ফেব্রুয়ারিতে ৩০০, মার্চে ৩১৬ ও এপ্রিলে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ৩৩৬টি।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘পরিবারে বন্ধন ও সমাজে পারস্পরিক মূল্যবোধের ঘাটতি, সন্তানদের মানসিক বিকাশে প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিংয়ের অভাব, সন্তানরা কে কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে—সেসব বিষয়ে অভিভাবকদের উদাসীনতা, সহপাঠ্যক্রম কার্যক্রম থেকে দূরে থাকা, মাদক ও খারাপ আড্ডাসহ নানা কারণে নৃশংস অপরাধ সংঘটিত হয়। এসব অপরাধের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ে পুলিশ সচেতনতামূলক সভা করে। সভায় ওইসব অপরাধসংশ্লিষ্ট আইন ও শাস্তির বিষয়ে সবাইকে অবহিত করা হয়। তবে পুলিশের পাশাপাশি সমাজের ভূমিকায় গুরুত্ব দেয়া এক্ষেত্রে বেশি জরুরি।’