‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’ গানের স্রষ্টা তারুণ্য ও সংগ্রামের দীপ্ত প্রতীক কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর মৃত্যুবার্ষিকী আজ।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ অক্টোবর বরিশাল রেডক্রস হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন। তার মায়ের নাম শিরিয়া বেগম, বাবার নাম শেখ ওয়ালিউল্লাহ। তাদের স্থায়ী নিবাস বাগেরহাট জেলার মংলা থানার অন্তর্গত সাহেবের মেঠ গ্রামে। তবে পিতার কর্মস্থল ছিলো বরিশাল।
তার বাবা ছিলেন চিকিৎসক। দশ ভাই বোনের মাঝে তিনিই ছিলেন সবার বড়। বাড়ির পাশেই ছিল নানা বাড়ি, তাই ছোটবেলার অধিংকাশ সময়টাই কবি তার নানাবাড়িতে কাটিয়েছেন। আর সেই নানাবাড়ির পাঠশালাতেই তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। এমনকি লেখালেখির আগ্রহও সৃষ্টি ঐ নানাবাড়ি থেকেই। নানাবাড়িতে সেসময় ‘বেগম’ আর কলকাতার ‘শিশুভারতী’ পত্রিকা আসত নিয়মিত। বলাই বাহুল্য যে শিশুমনে সাহিত্য প্রেমি একটা সত্ত্বা তৈরি হয়েছিলো।
ঢাকা ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুল থেকে ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে এসএসসি পাস করেন তিনি। ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন মেধাবী। চার বিষয়ে পেয়েছিলেন লেটার মার্কস এবং প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে এইচএসসি পাস করেন ঢাকা কলেজ থেকে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন তিনি।
১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে বিএ (সম্মান) এবং ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবনে রুদ্র ছিলেন প্রাণবন্ত এবং কিছুটা উচ্ছন্ন। সবসময় আড্ডা দিতে ভালোবাসতেন। তবে কবিতার ক্ষেত্রে তিনি অনেক মনোযোগী থাকতেন। তার এই অস্থির ভাব নিয়ে কবি শামসুল হক বলেছিলেন, ‘তার মধ্যে যে বাউন্ডুলেপনা ছিলো তা তাকে সুস্থির হতে দেয়নি।’
খ্যাতিমান এই কবি আধুনিক বাংলার অবিস্মরণীয় শিল্পমগ্ন উচ্চারণে তুলে ধরেছেন মাটি ও মানুষের প্রতি আমূল দায়বদ্ধতা। তাই সত্তর দশকের অন্যতম কবির স্বীকৃতি পেয়েছেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। তার জনপ্রিয় কবিতার মধ্যে অন্যতম ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’।
অকালপ্রয়াত এই কবি নিজেকে মিলিয়ে নিয়েছিলেন আপামর নির্যাতিত মানুষের আত্মার সঙ্গে। সাম্যবাদ, মুক্তিযুদ্ধ, ঐতিহ্য চেতনা ও অসাম্প্রদায়িকবোধে উজ্জ্বল তার কবিতা। ‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন’ এই নির্মম সত্য অবলোকনের পাশাপাশি উচ্চারণ করেছেন অবিনাশী স্বপ্ন ‘দিন আসবেই দিন সমতার’।
যাবতীয় অসাম্য, শোষণ ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অনমনীয় অবস্থান তাকে দিয়েছে ‘তারুণ্যের দীপ্ত প্রতীক’-এর খেতাব। একই সঙ্গে তার কাব্যের আরেক প্রান্তর জুড়ে রয়েছে স্বপ্ন, প্রেম ও সুন্দরের মগ্নতা। রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মূলত কবি হলেও কাব্য চর্চার পাশাপাশি সংগীত, নাটক, ছোটগল্পের ক্ষেত্রেও ছিলেন সমান উৎসাহী। রুদ্র চেয়েছিলেন বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠুক। ফলে ব্যক্তি রুদ্র ও কবি রুদ্রের সমগ্র শিল্প সাধনা ছিলো দেশ, মানুষ ও মানুষ্যত্বের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ।
স্বল্পায়ু জীবনে তিনি সাতটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও গল্প, কাব্য নাট্য ও ‘ভালো আছি ভালো থেকো’ সহ অর্ধ শতাধিক গান রচনা করেছেন। এমনকি একাধিক গানে সুরারোপও করেছেন। পরবর্তীকালে এ গানটির জন্য তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি প্রদত্ত ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দের শ্রেষ্ঠ গীতিকারের (মরণোত্তর) সম্মাননা লাভ করেন।
‘উপদ্রুত উপকূল’ ও ‘ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম’ কাব্যগ্রন্থ দুটির জন্য ‘সংস্কৃতি সংসদ’ থেকে পরপর দু’বছর ‘মুনীর চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেন। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ও জাতীয় কবিতা পরিষদ গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ ছিলেন জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্মসম্পাদক, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের প্রথম আহ্বায়ক কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশ সংগীত পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও প্রকাশনা সচিব। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন ।