বাংলাদেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তমানে এক নৈতিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মুখোমুখি। যেখানে একদিকে শিক্ষার্থীদের দলীয় অথবা দলীয়মনা ছাত্র রাজনীতিতে যুক্ত হতে উৎসাহিত করা হয়, অন্যদিকে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় সেই রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা হয়ে ওঠে কালো দাগ। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যম্পাসে ছাত্র রাজনীতির চালুর পক্ষে আমরা অনেকেই সাফাই গাই আর সরকারযন্ত্র রাজনীতির দোহাই দিয়ে চাকরি থেকে বাদ দেয়।
মেধা ও মননের চর্চার কেন্দ্র শিক্ষাঙ্গন আজ দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হচ্ছে, ফলশ্রুতিতে শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক ‘ব্র্যান্ডিং’ এর শিকার এবং শিক্ষক সমাজ বিভক্ত। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের শিক্ষাঙ্গন রাজনৈতিক উত্তাপের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়সহ কমবেশি ৩৩টি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়েছে ।
একটি অনলাইন জরিপে দেখা গেছে যে, দেশের ৯৩ শতাংশ মানুষ ছাত্ররাজনীতি বন্ধের পক্ষে মত প্রকাশ করেছে । বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যম্পাসগুলোতে শিক্ষার্থীরা পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক ভালো আছে এবং তারা নির্বিঘ্নে পড়ালেখা করতে পারছেন ।
এসব দেখে স্পষ্ট যে, দলীয় প্রভাবমুক্ত একটি শিক্ষাঙ্গন গড়ে তোলার দাবি জোরালো হয়ে উঠেছে । শিক্ষাঙ্গন কীভাবে অরাজনৈতিক থেকেও গণতন্ত্রচর্চার সূতিকাগার হতে পারে, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের দায়িত্ব কী হওয়া উচিত, এবং উন্নত বিশ্বের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি— এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতেই এই বিশ্লেষণ ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের প্রকৃত দায়িত্ব-দ্বৈতনীতির ফাঁদে এক প্রজন্ম
একজন শিক্ষার্থীর প্রধান এবং মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে জ্ঞান অর্জন, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং আত্ম-উন্নয়নের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য প্রস্তুত হওয়া । বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এই দায়িত্ব শুধু পাঠ্যবইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না বরং গবেষণা, বিতর্ক, খেলাধুলা, সমাজসেবা এবং সংস্কৃতি চর্চার মতো গঠনমূলক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষার্থী হয়ে ওঠে পরিপূর্ণ মানুষ এবং ভবিষ্যতের নাগরিক-নেতা ।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন এই গঠনমূলক কর্মকাণ্ডের জায়গা দখল করে নিয়েছে লেজুড়বৃত্তিক দলীয় ছাত্ররাজনীতি। ছাত্রসংগঠনগুলো অধিকাংশই কোনো না কোনো জাতীয় রাজনৈতিক দলের ছায়াতলে পরিচালিত হয় ।
প্রশাসনের নীরব সমর্থন, কিছু শিক্ষকের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা এবং অতিরিক্ত সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশকে ছাত্ররাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে দেখা যায় । অনেক ক্ষেত্রে এটি হয় অপারগতামূলক (পরিবেশ ও সিনিয়রদের চাপে, হলে সিট পাওয়ার আশায়), কখনো স্বেচ্ছায়, আর কখনো সুযোগ-সুবিধার লোভে । মেধাবী শিক্ষার্থীদেরও শিক্ষক হওয়ার জন্য ছাত্ররাজনীতিতে সরব হতে দেখা যায়।
আর এখানেই শুরু হয় শিক্ষার্থীদের জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন। শিক্ষাজীবনের শুরুতে যেসব শিক্ষার্থীকে ভবিষ্যতের নেতৃত্ব গঠনের কথা বলে রাজনীতির দিকে ঠেলে দেয়া হয়, শিক্ষাজীবন শেষে যখন তারা সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুত হয়, তখন সেই রাজনীতি তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায় (সরকার ও রাজনীতির পট পরিবর্তনের ফলে) । পুলিশ ভেরিফিকেশন, গোয়েন্দা প্রতিবেদন এবং নিয়োগ বোর্ডের ‘রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার’ মূল্যায়নে তারা চাকরির তালিকা থেকে বাদ পড়েন । অতীতের সেই মিছিল, ব্যানার ধরা, সংগঠনের সদস্য হওয়া বা ফেসবুকে কোনো পোস্ট — সবই তখন চাকরি পাওয়ার পথে ‘নেগেটিভ রেকর্ড’।
অদ্ভুত দ্বিচারিতা! একদিকে শিক্ষাজীবনে তাদের রাজনীতিতে অংশ নিতে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করা হয়, এমনকি অনেক সময় রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় সুযোগও দেয়া হয়। আর অন্যদিকে, চাকরি বা ক্যারিয়ারের সময় সেই অংশগ্রহণকে বানিয়ে দেয়া হয় ‘অযোগ্যতার’ প্রমাণ । এর ফলে শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্ত হয়, আত্মবিশ্বাস হারায়, এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য ‘মানবসম্পদ গঠন’ ব্যর্থ হয় ।
উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব, যুক্তি ও মত প্রকাশের চর্চা করে ক্লাব, ইউনিয়ন ও সেমিনারের মাধ্যমে। হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড, টোকিও বা সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির মতো প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন, কোনো জাতীয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত নয় ।
সেখানে মূল লক্ষ্য থাকে ছাত্র কল্যাণ, একাডেমিক নীতি সংস্কার, এবং নেতৃত্বের দক্ষতা তৈরি । অন্যদিকে, বাংলাদেশে অনেক সময় ছাত্ররাজনীতি হয়ে দাঁড়ায় শিক্ষার প্রতিবন্ধক, দখলবাজি ও সহিংসতার উৎস । শিক্ষাঙ্গন হয়ে ওঠে বিভক্ত ও উত্তেজনাপূর্ণ, যার ফলে ঝরে পড়ে অনেক শিক্ষার্থীর প্রাণ । যারা নিরপেক্ষ থাকতে চায়, তারাও নিরাপদে থাকতে পারেন না । যেখানে পাঠ্যবইয়ের জ্ঞান নয় বরং ক্যাম্পাস দখল, হল দখল, সিট বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, মিটিং-মিছিল, গেস্টরুম কালচার অথবা পোস্টার-ব্যানার টানানোই হয়ে ওঠে ‘রাজনীতি শেখা’ এবং ‘লিডারশিপ’ এর মূল মাপকাঠি । এতে শুধু শিক্ষার্থীর জীবন নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুরো জাতি ।
এই বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে আসার এখনই সময় । আমরা চাই একটি রাজনীতিমুক্ত, কিন্তু গণতন্ত্রচর্চায় সক্ষম শিক্ষাঙ্গন— যেখানে শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব শিখবে, মত প্রকাশ করবে, কিন্তু সেটি হবে দলনিরপেক্ষ ও নৈতিক ভিত্তিতে । আমরা চাই শিক্ষা হোক আলোচনার, সহাবস্থানের এবং সম্মানজনক ভিন্নমতের চর্চার জায়গা।
শিক্ষক সমাজ ও রাজনৈতিক সংযোজন- এক আত্মঘাতী প্রবণতা
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সমাজের সবচেয়ে সম্মানিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণির প্রতিনিধি। তাদের প্রধান দায়িত্ব শিক্ষাদান, গবেষণা এবং জ্ঞান সম্প্রসারণ। একইসঙ্গে তারা জাতির নীতিনির্ধারক পর্যায়ে বিশ্লেষণধর্মী পরামর্শদাতা হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন । কিন্তু দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের একটি বড় অংশ সরাসরি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন । এই সংযোজন এখন শুধু মতাদর্শিক অবস্থান নয় বরং নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রশাসনিক সুবিধা লাভের প্রধান চাবিকাঠি হয়ে উঠেছে ।
বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য গবেষণা ও সংবাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, অধিকাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, ডিন, এমনকি হল প্রভোস্ট পদেও এমন ব্যক্তিদের বসানো হয়, যারা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আনুগত্য প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছেন । আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, শিক্ষক নিয়োগে ‘মেধা’ নয়, ‘নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ঘরানার’ প্রতি আনুগত্যকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় । এমনও হয় যখন কোন মেধাবী শিক্ষার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতেই হয় তখন তাকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অনুগত শিক্ষক সংগঠনের সদস্য হতে হয় ।
এই প্রবণতার সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক হলো — শিক্ষার গুণগত মানের অবনতি । যারা প্রকৃত অর্থে গবেষণানির্ভর, পঠনপাঠনে দক্ষ এবং শিক্ষার্থীদের মানস গঠনে সক্ষম, তারা পেছনে পড়ে থাকেন শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় । এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একদিকে যেমন ‘যোগ্যতাসম্পন্ন’ শিক্ষক সংকট বাড়ছে, অন্যদিকে দলীয় মতভেদে শিক্ষকদের মধ্যে বিভাজন দিন দিন প্রকট হচ্ছে ।
চিত্র আরো ভয়াবহ হয়, যখন দেখা যায় কিছু শিক্ষক, রাজনৈতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় বিশেষ সুবিধা দেন কিংবা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেন। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের আস্থা কমে যাচ্ছে এবং প্রকৃত মেধাবীরা দুর্বিসহ এক পরিবেশে পড়ালেখা করতে বাধ্য হচ্ছে । সম্প্রতি, জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতা অভ্যুথানের পর অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু শিক্ষকদের হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে, যা নিঃসন্দেহে খারাপ ঘটনা; কিন্তু কেন এমন হলো তা থেকে আমাদের শিক্ষকদের শিক্ষা নিতে হবে। এটা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে আমাদের রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকতে হবে, হতে হবে নিরপেক্ষ ।
এখন সময় এসেছে, শিক্ষক সমাজকে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে সত্যিকার জ্ঞানচর্চার ধ্যান-ধারণায় ফিরে যেতে। কারণ, শিক্ষকদের রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের বলয়ে আবদ্ধ রেখে কোনো জাতিই মুক্ত চিন্তার নেতৃত্ব গঠন করতে পারে না ।
সমাধানের উপায় ও প্রস্তাবনা
১. শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেজুড়বৃত্তিক রাজনৈতিক দল কিংবা দলীয় চিন্তাধারাসম্পন্ন ছাত্র ও শিক্ষক সংগঠনের কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করতে হবে ।
২. বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে বৃহত্তর অংশীজন—বিশেষ করে শিক্ষার্থী ও সাধারণ শিক্ষকদের সঙ্গে মতবিনিময়ের ভিত্তিতে প্রার্থী তালিকা প্রণয়ন করতে হবে। প্রার্থী নির্বাচনের পূর্বে একটি নির্দিষ্ট দিনে উন্মুক্ত আলোচনা বা ডিবেটের আয়োজন করতে হবে, যেখানে প্রত্যেক প্রার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও পরিচালনার বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করবেন। এই প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে উপাচার্য নিয়োগ সংক্রান্ত একটি স্বচ্ছ ও নির্ধারিত নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন ।
৩. শিক্ষার্থীদের আবাসিক হলে মেধাভিত্তিক সিট বরাদ্দের ব্যবস্থা পুনরায় চালু করতে হবে । শিক্ষার্থীদের জন্য শতভাগ আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে ।
৪. ক্যাম্পাসে অরাজনৈতিক কিন্তু গণতান্ত্রিক কাঠামোর ছাত্র সংসদ গঠন করতে হবে । এ লক্ষ্যে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সংস্কার জরুরি। ছাত্র সংসদের প্রতিটি পদে প্রার্থীকে ব্যক্তিগতভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে; কোনো দলীয় বা সমন্বিত প্যানেল প্রার্থী থাকবে না। নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পরিবর্তে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত করতে হবে, যারা সকল পদে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটগ্রহণ নিশ্চিত করবে ।
৫. শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় পরিষদ গঠনের নির্বাচন প্রক্রিয়াতেও সংস্কার প্রয়োজন। এখানে দলীয় আনুগত্য বা রাজনৈতিক প্রভাব পরিহার করে প্রার্থীদের এককভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে। নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষেত্রে শিক্ষকের ব্যক্তিগত সততা, পেশাদারিত্ব এবং শিক্ষা-গবেষণার প্রতি দায়বদ্ধতা প্রধান বিবেচ্য হবে। এর মাধ্যমে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতি আস্থা পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে।
ছাত্র সংসদ ও শিক্ষক সমিতি— উভয় সংগঠনই হবে সম্পূর্ণ পেশাদার, শিক্ষাবান্ধব এবং স্বচ্ছ; এখানে রাজনৈতিক দল বা দলীয় আদর্শভিত্তিক সংগঠনের কোনো স্থান থাকবে না ।
৬. শিক্ষার্থীদের নেতৃত্ব ও দক্ষতা বিকাশের লক্ষ্যে ডিবেট ক্লাব, ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাব, স্পোর্টস ক্লাব, ইনোভেশন গ্রুপ, সেবা সংগঠন ও দক্ষতা-ভিত্তিক লিডারশিপ প্ল্যাটফর্ম গঠন ও সক্রিয় রাখতে হবে। প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলকভাবে ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাবসহ কমপক্ষে আরো একটি ক্লাব বা গ্রুপের সঙ্গে শিক্ষাজীবনের পুরো সময় যুক্ত থেকে কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে হবে ।
৭. শিক্ষক,কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের প্রকাশ্য লেজুড়বৃত্তিক রাজনৈতিক অংশগ্রহণ/বহিঃপ্রকাশ শৃঙ্খলা ভঙ্গের শামিল বলে বিবেচিত হবে এবং এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান সংশ্লিষ্ট চাকরি ও শৃঙ্খলা বিধিমালায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে ।
৮. একইভাবে, শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও শৃঙ্খলা নীতিমালা, ভর্তি নীতিমালা ও আন্ডারগ্র্যাজুয়েট অর্ডিন্যান্সে লেজুড়বৃত্তিক রাজনৈতিক অংশগ্রহণ/বহিঃপ্রকাশকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের আচরণ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে ।
৯. শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পেশাদার কাউন্সেলিং সেবা এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে; পাশাপাশি মানসিক সচেতনতা ও প্রেরণামূলক (মোটিভেশনাল) সেমিনার ও ওয়ার্কশপের নিয়মিত আয়োজন করতে হবে ।
এক সময় স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র ও শিক্ষকরা আজকের বাংলাদেশে একটি নতুন, মুক্ত ও প্রগতিশীল শিক্ষাঙ্গন গড়ে তুলতে পারেন । এ লক্ষ্যে, শিক্ষকদের উচিত হবে একান্তভাবে পাঠদান ও গবেষণায় মনোনিবেশ করা, আর শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ শিক্ষাজীবনের পাশাপাশি গঠনমূলক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকবে— কোনো রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির মধ্যে নয়।
উন্নত বিশ্বের আদলে আমাদের উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করতে হলে ছাত্র ও শিক্ষক উভয়ের কল্যাণে দলনিরপেক্ষ, নীতিনিষ্ঠ এবং কার্যকর পরিষদ ও সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজন একটি নিরপেক্ষ, মূল্যবোধনির্ভর এবং কল্যাণমুখী শিক্ষার পরিবেশ, যেখানে শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক বিভাজনের বাইরে থেকে জ্ঞানার্জন, দক্ষতা বৃদ্ধি ও নেতৃত্ব গঠনের শিক্ষা লাভ করবে সমাজের কল্যাণে অবদান রাখার জন্য— না যেকোনো দলীয় পতাকার জন্য। সর্বোপরি, বিশ্ববিদ্যালয় হতে হবে একটি অরাজনৈতিক কিন্তু প্রাণবন্ত গণতান্ত্রিক চর্চার কেন্দ্র, যেখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থী মুক্তভাবে মত প্রকাশ করতে পারে, নেতৃত্ব দিতে পারে, এবং ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনায়ক হয়ে উঠতে পারে— জ্ঞানে, নৈতিকতায় ও উদ্ভাবনী চিন্তায় সমৃদ্ধ এক আলোকিত নাগরিক হিসেবে ।
লেখক: অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়