২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে ‘জটের কবলে প্রাথমিক শিক্ষা’ শিরোনামে নিবন্ধ লিখেছিলাম। বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তি তথা ইন্টারনেট ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হওয়ার পরেও সে জটের কবল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা আজও মুক্ত হতে পারেনি।
বর্তমানে প্রাথমিকের মহাপরিচালকের অফিস থেকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন,অর্থ, প্রধান উপদেষ্টা তথা প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেতে, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কালক্ষেপণ হয়ে থাকে। অনেক সময় মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘ সময় ফাইল পড়ে থাকতে থাকতে সচিব, মন্ত্রী অন্যত্র বা অবসরে চলে যান।
কোনো কোনো সময় সরকারও পরিবর্তন হয়ে থাকে। তাদের নতুনভাবে বিষয়টি বুঝতে কালক্ষেপণ প্রক্রিয়া দীর্ঘ হয়ে থাকে।
বর্তমান কালক্ষেপণ প্রক্রিয়া আমলাতান্ত্রিক জট। প্রাথমিকের উপদেষ্টা অধ্যাপক বিধান চন্দ্র রঞ্জন পোদ্দার গত ৪ মে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে তৃণমূলের সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও শিক্ষকদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে গুরুত্বারোপ করেছেন। এ জবাবদিহিতা সর্বস্তরে না থাকলে প্রাথমিক শিক্ষার কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হতে পারেনা।
মন্ত্রী তথা উপদেষ্টাসহ সবাইকে জবাবদিহিতার আওতায় থাকতে হবে। তাহলে শিশুশিক্ষা সফলতার সঙ্গে এগিয়ে যাবে। বক্তৃতা তথা অফিস আদেশ বা পাহারাদার নিয়োগ করে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব নয়। এজন্য সর্বস্তরে সুশৃঙ্খল জবাবদিহিতা কাম্য। সাবেক সরকারের আমলের মন্ত্রী বর্তমান উপদেষ্টা, সচিব, মহাপরিচালক, সবাই প্রাথমিকের শিক্ষকদের শতভাগ পদোন্নতির আশ্বাস দীর্ঘ ১ যুগেরও বেশি সময় ধরে দিয়ে আসছেন। তাদের এ কৃত্রিম আশ্বাস মাঝে মাঝে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক, অনলাইন মিডিয়ায় ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঝড় তোলে।
শিক্ষকেরা আশায়-আশায় অনেকে কবরে, চিতায় আবার কেউ অবসরে চলে যান। আর যারা কর্মরত তারা শুধু অন্যদের পদোন্নতি চেয়ে চেয়ে দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিবসহ যিনিই আসেন, সবাই যেনো নেগেটিভ তথা বিয়োগের মানসিকতার ভাবনা নিয়ে প্রাথমিকে আসেন। প্রাইমারি ডিপার্টমেন্টে এসে উচ্চ শিক্ষিতসহ সবারই যেনো প্রায় মরি-মরি মানসিকতা দৃশ্যমান হচ্ছে।
প্রধান শিক্ষকদের ২য় শ্রেণি মর্যাদা ঘোষণা হওয়ার পর হতে সহকারী শিক্ষকদের সঙ্গে তাদের বেতন বৈষম্য বাড়তে থাকে। যার ফলে তাদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। সংগঠন ভিন্ন ভিন্ন হলেও যৌক্তিক প্রত্যাশা এক ও অভিন্ন। সমযোগ্যতা নিয়ে অনান্য কর্মরত সরকারি কর্মচারীদের মতো তাদেরও ১০ম গ্রেড ও মর্যাদা প্রাপ্যের যৌক্তিক প্রত্যাশা।
এটা কোনো বাড়তি আবদার নয়। অথচ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব, মহাপরিচালক সবাই যেনো একই মানসিকতা ও সুরে গান গেয়ে বেড়াচ্ছেন। সবাই কীভাবে কালক্ষেপণ করা যায়, বিষয়টি নিয়ে ভাবেন। ছাত্র জনতার আন্দোলনের পরও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নতুন কিছু সৃষ্টি করতে পারেনি। তারা শুধু বিগত আওয়ামী সরকারের প্রাথমিক শিক্ষাকে পর্যুদস্ত করার কার্যক্রম বাস্তবায়ন নিয়ে ভাবছেন।
সহকারী শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবি ১০ম গ্রেড। এ প্রাপ্য না দেয়ার হীন চক্রান্তের মানসিকতায় নগন্যসংখক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক পদ সৃষ্টি করা হয়। যাতে বড়শিতে সামান্য খাবারের লোভ দেখিয়ে সহকারী শিক্ষকদের আকৃষ্ট করে, যত পারে নিচের ধাপে বেতন গ্রেড নামাতে। সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন মন্ত্রীত্বের শেষ সময় কীসের মোহে জানিনা, ব্র্যাকের ভালোবাসায় মগ্ন হয়ে প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যা দূরীকরণের ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে প্রাথমিক শিক্ষার বদনামে রত ছিলেন।
এ বদনামের সামগ্রিক দায়ভার যে তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর বর্তায়। বিষয়টি নিয়ে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। তাদের ভাবনা একই দৃশ্যমান দেখা যাচ্ছে। সকলে যেনো, ক্ষণিকের জন্য এসে প্রাথমিক শিক্ষার বাস্তবভিত্তিক উন্নয়ন না করে কিছুটা শীতল বাতাস উপভোগ করে যাচ্ছেন। প্রকৃতপক্ষে তাদেরও দোষারোপ করার যৌক্তিক কারণ নেই। মন্ত্রী, উপদেষ্টারা তাদের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন। অন্যদিকে সচিব, মহাপরিচালকসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্তকর্তারা শিক্ষা-দীক্ষায় মহাজ্ঞানী হলেও তাদের প্রাথমিকের পুরো ব্যবস্থা নিয়ে অভিজ্ঞতা অনেকটা শূন্য।
মন্ত্রী, উপদেষ্টাসহ নীতিনির্ধারণীরা শূন্য অভিজ্ঞতা নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রাথমিকের বেহাল দশার অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ দূরীকরণে শিক্ষক পদ থেকে শতভাগ পদোন্নতি দিয়ে প্রাথমিকের আলাদা ক্যাডার সার্ভিস সৃষ্টি করে নীতিনির্ধারনী পর্যায়ে নিয়ে অভিজ্ঞ জনবলে প্রাথমিক শিক্ষা সমৃদ্ধ করা। মন্ত্রী, উপদেষ্টা নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষানুরাগী, বিশেষ করে শিশু মনোবিজ্ঞানে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অভিভাববক হিসেবে কাম্য।
বেসরকারি, সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ও কিন্ডারগার্টেন স্কুলের অভিন্ন সময়সূচি না করে শিক্ষার্থী সংকটের জন্য শিক্ষকদের দায়ী করা অযৌক্তিক। এ জন্য দায়ী মন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব, মহাপরিচালকসহ নীতিনির্ধারকবৃন্দ। বিষয়টির জন্য সাবেক ও বর্তমান সবাইকে জবাবাদিহিতার আওতায় আনা জরুরি। একই দেশে শিক্ষার একাধিক সমূয়সূচি তথা কার্যক্রম চলতে পারেনা। বর্তমানেও একই সুরে গান গেয়ে বেড়াচ্ছে প্রাথমিকের উপদেষ্টাসহ কর্মকর্তাবৃন্দ। বরং প্রাথমিকের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত এনজিও বা কনসালটেশন কমিটি কোনো সমস্যা দূরীকরণের বাস্তবভিত্তিক সুপারিশ করেন নাই। বরং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেসরকারি ট্রেনিংবিহীন প্যারাশিক্ষক নিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছেন।
বর্তমান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারসহ এনজিও তথা কনসালটেশন কমিটির সুপারিশ বাস্তাবায়ন হলে প্রাথমিক শিক্ষা আরো খারাপ অবস্থা নিয়ে যাবে। সে অবস্থায় নিজেরা সাধু সন্নাসী সেজে ‘যত দোষ নন্দ ঘোষের মত’ প্রাথমিক শিক্ষকদের ওপর দিয়ে শুরু করবে এবং বেসরকারিভাবে খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্র তৈরি করবে। কনসালটেশন কমিটির আহবায়ক নিঃসন্দেহে একজন শিক্ষাবিদ।
তবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষায় তার অভিজ্ঞতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারদের চেয়ে বেশি নয়। অসংখ্য প্রাথমিকের অভিজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত মহাপরিচালক, সচিবকে উপেক্ষা করে প্রাথমিকের কনসালটেশন কমিটি এনজিওদের দিয়ে গঠন করা প্রাথমিক শিক্ষা বেসরকারিকরণের ষড়যন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ। যেখানে প্রাথমিকের ৪০ হাজার প্রধান ও সহকারী শিক্ষক পদ দীর্ঘদিন থেকে শূন্য। সেখানে প্রধান শিক্ষকের শতভাগ পদোন্নতির বিষয়টি কালক্ষেপণ করে বার বার আশ্বাস দিয়ে নিছক প্রাথমিক শিক্ষা ধ্বংস বা পর্যুদস্ত করার আলামত।
প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকদের যৌক্তিক প্রাপ্ত ১০ম গ্রেড, প্রধান শিক্ষকদের নিয়ে মহামান্য আপিল বিভাগের রায়, সব শিশুর জন্য অভিন্ন শিশুবান্ধব সময়সূচি, শতভাগ পদোন্নতিসহ অসংখ্য বিরাজমান সমস্যা শুধু আশ্বাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে কালক্ষেপণ কাম্য নয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও খুব বেশি সময় থাকার কোনো অবকাশ নেই। সে প্রেক্ষাপটে শ্রীঘই পূরণ হোক প্রাথমিকের প্রত্যাশা।
লেখক: শিক্ষাবিদ