পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও গবেষক চাই, ভোটার নয় | মতামত নিউজ

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও গবেষক চাই, ভোটার নয়

শিক্ষা ও গবেষণার মেরুদণ্ড হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার ও গবেষক। কিন্তু এদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে ন্যূনতম যোগ্যতা আর রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও পর্যাপ্ত লবিংয়ের ওপর নির্ভর করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা।

দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি সব সময়ই নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে এসেছে ,যা বারবার আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষার মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে। যে কারণে স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পার হলেও ভালো মানের শিক্ষক ও গবেষক বের হয় না।প্র ত্যেক বছর শিক্ষাখাতে বিপুল অর্থ ব্যয় করলেও আদতে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়না।

শিক্ষা ও গবেষণার মেরুদণ্ড হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার ও গবেষক। কিন্তু এদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে ন্যূনতম যোগ্যতা আর রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও পর্যাপ্ত লবিংয়ের ওপর নির্ভর করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা। বিগত কয়েক বছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর আবেদনকারীদের মধ্য থেকে কোথাও কেবলমাত্র নামমাত্র মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে।

আবার কোথাও সামান্য লিখিত পরীক্ষা ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে এই নিয়োগ সম্পন্ন হচ্ছে। সেইমৌখিক পরীক্ষা বোর্ডে সাধারণত সংশ্লিষ্ট বিভাগের বিভাগীয় প্রধান, অনুষদের ডিন, উপাচার্য, রেজিস্ট্রার,সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একজন বহিরাগত বিশেষজ্ঞ এবং প্রয়োজন অনুযায়ী এক বা একাধিক সিন্ডিকেট সদস্য থাকেন। তারাই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন।

সেখানে নিশ্চয়ই স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। সেখানে আবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায় যে শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে এসএসসি,এইচএসসি ন্যূনতম জিপিএ ৪ থেকে ৪.৫০ চাওয়া হয়।এটি পৃথিবীর আর কোনো দেশে এমন শর্ত দেখা যায় না। এই শর্ত কেবলমাত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে চাওয়া যেতে পারে কিন্তু শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে এমন শর্ত অনুপযুক্ত।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি ভর্তির ক্ষেত্রে এমন শর্ত না থাকে তাহলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে কেন থাকবে সেটিও প্রশ্নের জন্ম দেয়। দেশে সাধারণত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়েগের ক্ষেত্রে একাডেমিক ফলাফল, গবেষণা এবং অভিজ্ঞতার চেয়ে রাজনৈতিক পরিচয় ও তদবিরকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ যদি রাজনৈতিক প্রভাবাধীন হয় এবং সেখানে তদবিরই মুখ্য ভূমিকা পালন করে, তাহলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় জায়গা করে নেবে?

যদি মনে করে ভিন্নভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রদান করলে স্বায়ত্ত্বশাসন ক্ষুণ্ন হয় তাহলে তারা সমন্বিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ কমিশন গঠন করে সেখানে প্রিলিমিনারি, লিখিত পরীক্ষা, প্রেজেন্টেশন, ডেমো ক্লাস, গবেষণাপত্র ইত্যাদির ভিত্তিতে নম্বর প্রদান করে নিয়োগ সম্পন্ন করা যেতে পারে। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া সাধারণত স্বচ্ছ, প্রতিযোগিতামূলক এবং মেধাভিত্তিক। সেখানে প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন একাডেমিক জব পোর্টালে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।

আগ্রহী প্রার্থীরা কভার লেটার, জীবনবৃত্তান্ত, গবেষণা ও শিক্ষাদান সংক্রান্ত বিবৃতি এবং সুপারিশপত্রসহ আবেদন করেন। আবেদন যাচাই করে সার্চ কমিটি যোগ্য প্রার্থীদের শর্টলিস্ট করে। এরপর প্রাথমিকভাবে ভিডিয়ো বা ফোনে সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। যারা এ ধাপে নির্বাচিত হন, তাদের অন-ক্যাম্পাসে আমন্ত্রণ জানানো হয়, যেখানে তারা গবেষণা সেমিনার উপস্থাপন, ডেমো ক্লাস নেয়া এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সবশেষে সার্চ কমিটির মতামতের ভিত্তিতে উপযুক্ত প্রার্থীকে নিয়োগের অফার দেয়া হয়। পুরো প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব বা পক্ষপাতের সুযোগ থাকে না এবং মূল গুরুত্ব দেয়া হয় প্রার্থীর গবেষণা ও শিক্ষাদানের দক্ষতাকে। অথচ বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগে এসবের বালাই নেই। ফলশ্রুতিতে আমরা ভালো শিক্ষক ও গবেষক পাইনা অথচ তারা যেমন ভালো একাডেমিশিয়ান পাচ্ছে, তেমনি দক্ষ গবেষকও পাচ্ছে।

এজন্যই তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাচ্ছে। তারা নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের দিকে ঝুঁকছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার থেকেই বের হচ্ছে সর্বশেষ প্রযুক্তির সংস্করণ। অথচ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও আমরা এখনো প্রযুক্তি কিংবা চিকিৎসা খাতে উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন করতে পারিনি। এর মূল কারণ, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দক্ষ গবেষক ও মানসম্পন্ন একাডেমিশিয়ানের অভাব।

বহির্বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষক নিয়োগ করে মূলত শিক্ষা ও গবেষণার সম্প্রসারণের জন্য। ফলে সেসব দেশের শিক্ষকরা শিক্ষা ও গবেষণায় নিবেদিত থাকেন। গত কয়েক দশকে হওয়া অধিকাংশ গবেষণা বা আবিষ্কার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগার থেকেই এসেছে। অথচ আমাদের দেশের প্রাচীন ও প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,শতবর্ষ অতিক্রম করেও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কোনো গবেষক বা প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও পরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আজ বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে।

যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের সবচেয়ে বেশি গবেষণাগার রয়েছে, তবুও আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা বা উদ্ভাবনের ইতিহাস নেই বললেই চলে। কারণ গবেষণার জন্য প্রয়োজন দক্ষ একাডেমিশিয়ান এবং গবেষক, যা আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিরল। কারণ শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে পদোন্নতি পর্যন্ত সব ধাপেই শিক্ষকদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা প্রয়োজন হয়। অনেক শিক্ষক ভালো গবেষক হওয়া সত্ত্বেও রাজনীতি না করায় পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হন। ফলে বাধ্য হয়েই শিক্ষক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

এতে গবেষণার মনোভাব নষ্ট হয়ে যায়, জন্ম নেয় প্রশাসনিক মনোভাব। এখানেই শেষ নয়। বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তাদের অনুসারী শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন এবং পরবর্তীতে তাদের নিজ দলে সক্রিয় হতে বাধ্য করেন। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ভোটার বাড়ে, দলীয় দাপটও বৃদ্ধি পায়। এরপর শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দলটি প্রশাসনিক পদ বণ্টন করে নেয়।

এতে শিক্ষকতার পরিবর্তে জন্ম নেয় প্রতিহিংসা, নষ্ট হয় গবেষণার সম্ভাবনা। এই প্রক্রিয়ায় যারা প্রকৃত শিক্ষক ও গবেষক হতে চান, তারা নানা ভাবে হয়রানির শিকার হন। ফলে যতই গবেষণাগার স্থাপন বা গবেষণা খাতে বাজেট বরাদ্দ দেয়া হোক না কেন, মানসম্মত গবেষণা আর হয় না, উদ্ভাবনও হয় না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ায় গবেষণাগারের যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে। প্রতি বছর মেরামতে অর্থ ব্যয় হয়, কিন্তু গবেষণার অগ্রগতি হয় না।

বর্তমানে দেশের পাবলিকবিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মূলত প্রশাসনিক রাজনীতি ও দলীয় স্বার্থই প্রবল। অনেক শিক্ষক দলীয় রাজনীতির কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাযথভাবে ক্লাস না নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে মনোযোগ দেন। আবার সেখানে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অনিয়ম করেও পার পেয়ে যান। যদি কেউ মনে করেন, এই বেতন তার জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট নয়, তবে তাকে জেনে-বুঝেই এই পেশায় আসা উচিত ছিলো।

এসব প্রশ্নের উত্তর কখনোই পাওয়া যাবে না,যদি না পুরাতন নিয়মে নিয়োগ পদ্ধতি ভেঙে শতভাগ স্বচ্ছ ও মেধাভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করা হয়। তখনই গবেষণা সচল হবে, উদ্ভাবন আসবে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।

দীর্ঘমেয়াদে এমন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ছাত্র-শিক্ষকের যৌথ গবেষণায় উদ্ভাবিত হবে নতুন প্রযুক্তি এবং পাওয়া যাবে নানান সমস্যার সমাধান। অন্যথায় হাজার কোটি টাকা বাজেট দিয়েও গবেষণায় উন্নতি হবে না,বরং রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ই বাড়বে। বিশ্বের অনেক দেশ বাংলাদেশের পরে স্বাধীন হলেও, তাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা শক্তির কারণে তারা আজ অনেক এগিয়ে। কিন্তু বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে মূলত দক্ষ গবেষকের অভাবে। তাই দেশের উন্নয়নের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় গুলো এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতির সংস্কার জরুরি। এখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও লবিংয়ে শিক্ষক নামে ভোটার নিয়োগ নয় বরং যোগ্যতাই হোক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে অগ্রাধিকার।

লেখক: ছাত্র, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়,রংপুর।