নির্যাতন প্রতিরোধে বাঞ্ছনীয় | মতামত নিউজ

আন্তর্জাতিক নির্যাতনবিরোধী দিবস নির্যাতন প্রতিরোধে বাঞ্ছনীয়

অনেক পুরুষ লজ্জার কারণে আত্মসম্মানের ভয়ে প্রকাশ করেন না। তারা বলেন, বিভিন্ন দেশে কিছু বেসরকারি সংস্থা আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস পালন করছে।

২০২৩ খৃষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘৭৫ শতাংশ বিবাহিত পুরুষ মানসিক নির্যাতনের শিকার’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়, ‘নারী নির্যাতন আইনের মতো পুরুষ নির্যাতন আইনের দাবি জানিয়েছে জাতীয় পুরুষ নির্যাতন প্রতিরোধ ফাউন্ডেশন।

’ জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধনে এ দাবি জানানো হয়। মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে ৭৫ শতাংশ বিবাহিত পুরুষ মানসিক নির্যাতনের শিকার। সামাজিক ও লোকচক্ষুর অন্তরালে লজ্জার ভয়ে অনেক পুরুষ নির্যাতনের বিষয় লোক সমাজে প্রকাশ করতে চান না।

অনেক পুরুষ লজ্জার কারণে আত্মসম্মানের ভয়ে প্রকাশ করেন না। তারা বলেন, বিভিন্ন দেশে কিছু বেসরকারি সংস্থা আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস পালন করছে। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ নভেম্বর থেকে বাংলাদেশ মেনস্ রাইটস ফাউন্ডেশন পুরুষ দিবস পালন করছে। বাংলাদেশে পুরুষ নির্যাতন বেড়েই চলেছে। পুরুষ মুখ বুঝে সহ্য করে যাচ্ছে কারণ, তারা কোনো আইনি সহায়তা পাচ্ছে না। তাদের জন্য নেই কোনো আইন। পুরুষের শুধু বালিশ ভিজিয়ে কাঁদা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।

শিরোনাম দেখে অনেকেই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছেন। পুরো প্রতিবেদন পড়ে সেই হাসি পরিণত হয় অট্টহাসিতে। কারণ আমাদের সমাজ এমন রীতি মেনে চলে যেখানে নারী নির্যাতন, সংখ্যালঘু নির্যাতন, আদিবাসী নির্যাতন, শিক্ষক নির্যাতন, শিক্ষার্থী নির্যাতন, প্রতিবন্ধী নির্যাতন--- এগুলোকে প্রাধান্য দেয়া হয়। পুরুষ নির্যাতনের বিষয়টি অতীতে যেমন অবহেলিত হয়েছে, বর্তমানে হচ্ছে এবং অবধারিতভাবে ভবিষতেও হবে।

যেকোনো সমস্যাকে প্রাথমিক স্তরে নির্ধারণ বা শনাক্ত করা গেলে এবং সেটার সমাধান করলে, বিষয়টি ভয়াবহ আকার ধারণ করে না। আমাদের এতো জ্ঞান থাকলেও অজ্ঞাত কারণে আমরা সমাজিক রীতিতে পরিবর্তন ও পরিবর্ধণ আনি না। ফলে সমস্যাগুলো সম্প্রসারিত হয় এবং এর পরিণতি সঙ্গত কারণেই সুখকর হয় না। এমন বাস্তবতায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রতি বছরের মতো আমাদের দেশেও পালন করা হচ্ছে ‘নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের সমর্থনে আন্তর্জাতিক নির্যাতনবিরোধী দিবস।'

১৯৯৭ খৃষ্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর, ৫২/১৪৯ প্রস্তাবের মাধ্যমে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২৬ জুনকে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের সমর্থনে আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ দিবস ঘোষণা করে। যার লক্ষ্য ছিলো নির্যাতন সম্পূর্ণ নির্মূল এবং নির্যাতন বিষয়ক অন্যান্য নিষ্ঠুর আচরণের বিরুদ্ধে কনভেনশনের কার্যকর কার্যকারিতা।

দিবসটি পালনের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, দুইটি কারণকে অগ্রগণ্য করে ২৬ জুনকে মনস্থ করা হয়। ১. ১৯৪৫ খৃষ্টাব্দের ২৬ জুন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে জাতিসংঘের সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছিলো। এটিই প্রথম আন্তর্জাতিক দলিল যা জাতিসংঘের সদস্যদের মানবাধিকারকে সম্মান এবং প্রচার করতে বাধ্য করে। ২. ১৯৮৭ খৃষ্টাব্দের ২৬ জুন নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তির বিরুদ্ধে জাতিসংঘের কনভেনশন কার্যকর করা হয়।

নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের সমর্থনে আন্তর্জাতিক দিবসটি প্রতি বছর পালনের সিদ্ধান্তটি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ডেনমার্কের প্রস্তাবে গ্রহণ করে, যেখানে বিশ্বখ্যাত আন্তর্জাতিক নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের পুনর্বাসন কাউন্সিল (আইআরসিটি) অবস্থিত।

ঐ দিন ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কফি আনান বলেছিলেন, ‘এই দিনে আমরা তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই যারা অকল্পনীয় পরিস্থিতি সহ্য করেছেন। এটি বিশ্বকে অকথ্য পরিস্থিতির বিরুদ্ধে কথা বলার একটি উপলক্ষ। বিশ্বজুড়ে নির্যাতনের শিকার এবং বেঁচে যাওয়া অনেক মানুষকে স্মরণ এবং সমর্থন করার জন্য একটি দিন উৎসর্গ করা, যেটির বাস্তবনা অনেক আগেই প্রয়োজন ছিলো।’

এরপর থেকে বিশ্বের প্রায় ১০০টি সংগঠন প্রতি বছর অনুষ্ঠান, উদযাপন এবং প্রচারণার মাধ্যমে দিবসটি পালন করে। ২০০৯ খৃষ্টাব্দের ১৬ জুলাই বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের সমর্থনে আন্তর্জাতিক দিবসকে কেন্দ্র করে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট পল সিটিতে ‘সেন্টার ফর ভিক্টিমস অব টর্চার (সিভিটি)’ নামের একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ১৯৮৫ খৃষ্টাব্দ থেকে নির্যাতনের অবসানে কাজ করছে। এই সংস্থাটির আদর্শ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী মানবাধিকার সমুন্নত রাখার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া। সিভিটির সভাপতি ড. সাইমন অ্যাডামস এক প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের সমর্থনে দাঁড়াতে এবং মানবাধিকার সমুন্নত রাখার জন্য যেকোনো পদক্ষেপ মানবতার প্রতিচ্ছবি। আমরা সারা বিশ্বের সকল নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের প্রতি আমাদের সমর্থন এবং সংহতি প্রকাশ করি।

অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তির বিরুদ্ধে জাতিসংঘের কনভেনশন কার্যকর হয়েছিলো, যা স্বীকার করে যে নির্যাতন সমগ্র মানবতার বিরুদ্ধে একটি অপরাধ এবং সর্বত্র-সর্বদা অবৈধ। বিশ্বব্যাপী এই নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বিশ্বে ১১ কোটিরও বেশি মানুষ জোরপূর্বক তাদের বাড়িঘর থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। যাদের অনেকেই নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার।

এই বৈশ্বিক সংকটের মধ্যে আমরা তাদের জীবন পুনর্নির্মাণের জন্য সহায়তা করে চলেছি, যারা এখনও বেঁচে আছেন। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ সীমান্তের কাছে অ্যারিজোনায় আমরা তাদের সহায়তা করি যারা তাদের দেশ ছেড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় চেয়েছেন। আমরা সম্প্রতি আটলান্টা, জর্জিয়া এবং সেন্ট পল, মিনেসোটায় নতুন বিশেষায়িত প্রকল্পও খুলেছি, যা তালেবানের দমনমূলক শাসন থেকে পালিয়ে আসা আফগানিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের সহায়তা করার জন্য নিবেদিত।

বিভিন্ন মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, অধিকাংশ ক্ষেত্রে অসচ্ছল ও প্রান্তিক মানুষ নির্যাতনের শিকার হন। বিচারিক শারীরিক শাস্তি ও মৃত্যুদণ্ডকে কখনও কখনও নির্যাতনের রূপ হিসেবে দেখা হয়। নির্যাতনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। নির্যাতনের সবচেয়ে সাধারণ রূপ হলো প্রহার। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে অনেক নির্যাতনকারী অস্বীকারযোগ্যতা বজায় রাখার জন্য মানসিক পদ্ধতি পছন্দ করেছেন। নির্যাতনকারীরা সাধারণত ভয়ের বশে অথবা সীমিত সম্পদের কারণে, দুঃখের পরিবর্তে কাজ করে। যদিও বেশিরভাগ নির্যাতনকারী নির্যাতনের কৌশল সম্পর্কে অনানুষ্ঠানিকভাবে শেখে এবং খুব কমই স্পষ্ট আদেশ পায় বলে মনে করা হয়।

নির্যাতনের লক্ষ্য হলো ভুক্তভোগীর ইচ্ছা ভঙ্গ করা। তাদের কর্তৃত্ব এবং ব্যক্তিত্ব ধ্বংস করা। নির্যাতিতদের নিয়ে এক গবেষণায় দেখা গেছে, একজন মানুষের সবচেয়ে ক্ষতিকারক অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে প্রধান হচ্ছে, তাদের কর্তৃত্ব এবং ব্যক্তিত্ব ধ্বংস করা। অনেক ভুক্তভোগী শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হন, দীর্ঘস্থায়ী ব্যাথা (বিশেষভাবে শারীরিক এবং মানসিক) পরিণতি উভয়ই।

নির্যাতন থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আঘাত-পরবর্তী স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের সর্বোচ্চ হার থাকে এবং অনেকেই মানসিকভাবে ভীষণভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। এই ধরনের মানুষদের জন্য প্রয়োজন যত্ন। চিকিৎসা বিদ্যায় শারীরিক ক্ষত সারানো গেলেও মানসিক ক্ষতি থেকেই যায়। মানসিক ক্ষতি এতোটাই তীব্র থাকে যে, আক্রান্ত ব্যক্তি তার আশেপাশের মানুষদের বুঝতে না দিলেও ভেতরে ভেতরে ক্রমশ বিপর্যস্ত হতে থাকেন। এই মানুষগুলোর আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে, যা চুড়ান্ত পরাস্থতার সংকেত।

চলতি বছরের মার্চ মাসে জার্মান ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম ডয়চে ভেলে ‘বাংলাদেশে দুই মাসে নির্যাতিত ২৯৪ নারী, ধর্ষণের শিকার ৯৬’ শিরোনামে এক সংবাদ প্রকাশ করে। সংবাদটিতে নির্যাতনের বিভৎস চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

প্রাচীনকাল থেকেই নির্যাতন পরিচালিত হয়ে আসছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রক্রিয়ায় পার্থক্য আসলেও নির্যাতন চলমান রয়েছে। যে কোনো ধরনের নির্যাতনকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে গণ্য করা হয়। এর প্রতিকার নিয়ে আলোচনাও করা হয়। কিন্তু প্রতিরোধের বলয় বলিষ্ঠ হয়নি আজও। সুতরাং একথা সর্বজনবিদিত যে, মানবাধিকার রক্ষার্থে নির্যাতন প্রতিরোধ বাঞ্ছনীয়। বাঞ্ছনীয় এই কাজটির বাস্তবায়ন জরুরি।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক