ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবের ইতিহাস | মতামত নিউজ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবের ইতিহাস

বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে সে সম্ভবনা শেষ হয়ে যায়। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জানুয়ারি ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা সফরে আসেন এবং ঘোষণা করেন যে, তিনি সরকারের কাছে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করবেন।

#ঢাবি

আজ ১ জুলাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস। এদেশের শিক্ষা বিস্তার, গবেষণা কার্যক্রম ও সকল আন্দোলন সংগ্রামে এক গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের তথা পূর্ব বাংলার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়।

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুলাই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গে ঢাকাকে রাজধানী করে নতুন ‘পূর্ব বাংলা’ ও ‘আসাম’ প্রদেশ সৃষ্টি করা হয়। বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলায় শিক্ষার সবচেয়ে উন্নতি ঘটে। কিন্তু ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দের ১ নভেম্বর দিল্লির দরবারে ঘোষণার মাধ্যমে ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়। বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বঙ্গে শিক্ষার যে জোয়ার এসেছিলো, তাতে অচিরেই ঢাকাতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অবধারিত ছিলো।

বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে সে সম্ভবনা শেষ হয়ে যায়। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ জানুয়ারি ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঢাকা সফরে আসেন এবং ঘোষণা করেন যে, তিনি সরকারের কাছে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করবেন।

১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যারিস্টার রবার্ট নাথানের নেতৃত্বে নাথান কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির ২৫টি সাবকমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে ভারত সরকার প্রস্তাবিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য রূপরেখা স্থির করে। ভারত সরকার ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে নাথান কমিটির রিপোর্ট অনুমোদন দেয়।

১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে ইমপেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী সরকারের কাছে অবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল পেশের আহ্বান জানান। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর লর্ড চেমস্ফোর্ড কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাসমূহ তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন।

সেই কমিশনের ওপরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে পরামর্শ দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়। এই কমিশনের প্রধান ছিলেন মাইকেল স্যাডলার। কমিশন ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করে। কিন্তু এ কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে সরকারি বা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয় করার নাথান কমিটির প্রস্তাব সমর্থন করেনি।

কিন্তু ঢাকা কলেজের আইন বিভাগের সহঅধ্যক্ষ ড. নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল শক্তিরূপে অভিহিত করেন। একই কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতির অধ্যাপক টি সি উইলিয়ামস অর্থনৈতিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন ঢাকা শহরের কলেজগুলোর পরিবর্তে বিভিন্ন আবাসিক হলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিটরুপে গণ্য করার সুপারিশ করে।

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সিল হাউসের পাঁচ মাইল ব্যাসার্ধ এলাকাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অওতাভুক্ত এলাকায় গণ্য করার কথাও বলা হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তেরোটি সুপারিশ করেছিলো। কিছু রদবদলসহ তা ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ভারতীয় আইন সভায় গৃহীত হয়। ভারতের তদানীন্তন গভর্ণর জেনারেল ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ মার্চ তাতে সম্মতি দেন। স্যাডলার কমিশনের অন্যতম সদস্য ছিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক রেজিস্টার পি.জে. হার্টস। তিনি ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম শুরু করে।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে কেন্দ্র করে তার পূর্ব পাশে অবস্থিত ঢাকা হল (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল), লিটন হল, কার্জন হল, বিজ্ঞান ভবন সমূহ, ঢাকা হলের পূর্ব পাশে বিরাট দীঘি, অপর পাশে ফজলুল হক মুসলিম হল। ঢাকা হলের প্রথম প্রভোস্ট ছিলেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ এফ.সি.সি. টার্নার। শুরুতে একমাত্র ঢাকা হলেরই নিজস্ব ভবনে ছিলো; কার্জন হল মিলনায়তনটি তার অধিকারভুক্ত ছিলো। সে কারণে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের শিক্ষা বহির্ভূত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ঢাকা হল ছাত্র সংসদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। দেশ বিভাগের পর ঢাকা হলই ছিলো প্রগতিশীল বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের সূতিকাগার, ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণআন্দোলন মহান গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছিলো ঢাকা হলের প্রগতিশীল ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামানের শহীদ হওয়ার মাধ্যমে ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু মুসলিম ছাত্রদের জন্য স্থাপিত প্রথম হল ‘সলিমুল্লাহ মুসলিম হল’ । এ হলের প্রথম প্রোভস্ট নিযুক্ত হন ইতিহাস বিভাগের রিডার স্যার এ এফ রহমান।

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে লীলা নাগ ইংরেজিতে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন এবং ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এমএ ডিগ্রিধারী হিসেবে বের হন যিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ছাত্রী সুষমা সেনগুপ্তা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী ছিলেন গণিত বিভাগের ফজিলতুন্নেসা।

১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকা আসেন এবং কার্জন হলে ১০ ফেব্রুয়ারি দি মিনিং অব আর্ট এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি দি বিগ এ্যান্ড দি কমপ্লেক্স বিষয়ে বক্তৃতা দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম তিনটি হল থেকে রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা জানানোর আয়োজন করা হয়েছিলো। কিন্তু অসুস্থতার কারণে রবীন্দ্রনাথ কেবল মুসলিম হলের সংবর্ধনা সভায় যোগদান করতে পেরেছিলেন। ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ জ়ানুয়ারি মুসলিম সাহিত্য সমাজ গঠিত হয়। এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন অধ্যাপক আবুল হোসেন। মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপাত্র ছিলো শিখা নামক বার্ষিকী। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম সাহিত্য সমাজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধন করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রায় ৬০০ একর জমির ওপরে গড়ে ওঠে। এই দিনটি অর্থাৎ ১ জুলাই প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি অনুষদ এবং বারোটা বিভাগ নিয়ে তার যাত্রা শুরু করে। ঢাকা কলেজ এবং জগন্নাথ কলেজ বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ডিগ্রি কলেজে অধ্যায়নরত ছাত্রদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষাক্রম শুরু করে। শুধু ছাত্র নয় শিক্ষক এবং লাইব্রেরি ও অন্যান্য উপকরণ দিয়েও এই দুটি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগতিতে সহায়তা করে। প্রথম শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো ৮৭৭ জন আর শিক্ষক ছিল ৬০ জন ।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠিত হলে, তখন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো আর তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এর ফলে এদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা আবার উজ্জীবিত হয়। নতুন উদ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে। তখনকার পূর্ববাংলায় অবস্থিত ৫৫ টি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত দেশের প্রয়োজনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী সহ অনেক শিক্ষার্থী নিহত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের গৌরবের প্রতিষ্ঠান। আমাদের সব আন্দোলন সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু।

লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক

#ঢাবি