মাছুম বিল্লাহ। ছবি : দৈনিক শিক্ষাডটকম
শিক্ষার সার্বিক ব্যবস্থাপনায় নতুন কোনো ধারণা পজিটিভ! তবে এ ধারণাগুলোর যাদের কাছ থেকে আসা প্রয়োজন সেটি হচ্ছেনা। যেমন শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অন্যান্য কর্মকর্তা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধান যারা বিভিন্ন ধরনের সমস্যা, অসুবিধা ও সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন শিক্ষার সার্বিক ব্যবস্থাপনায় গতি ও স্বচ্ছতা আনতে, তাদের মধ্য থেকে কোনো সমাধান বা নতুন কোনো ধারণা এলে সেটি হয় বাস্তব ও টেকসই। এর নাম ‘বটম আপ অ্যাপ্রোচ’ বা বাস্তব ক্ষেত্র থেকে ওপরের দিকে যাওয়ার ধারণা। সেটি আমরা কোথাও হতেই দেখছি না।
গত ১৭ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর শিক্ষাক্ষেত্রে একটি নতুন ধারণা নিয়ে আলোচনা করেছে। এটি প্রশংসা পেতে পারে তবে অ্যাপ্রোচটি হচেছ ‘টপ ডাউন’ যা কাজের ক্ষেত্রে সাধারণত সুফল বয়ে আনে না। কারণ এটি অনেকটা চাপিয়ে দেয়ার মতো, ফলে যে উদ্দেশ্যে এটি করা হয় সেই উদ্দেশ্য সাধন হতে সময় লেগে যায় এবং বেগ পেতে হয়। কারণ বিষয়টি স্ফতঃস্ফূর্ত নয়, বিষয়টি ফিল্ড থেকে আসেনি বরং ফিল্ডে পাঠানো হয়েছে।
আমাদের দেশে বর্তমানে ৩৫ হাজারের বেশি এমপিও ও নন এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলোর আর্থিক ও শিক্ষার পরিবেশসহ নানাদিক দেকভাল করে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর এ। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি হোক কিংবা বেসরকারি, এমপিওভুক্ত হোক আর নন-এমপিওভুক্তই হোক সর্বত্রই অর্থনৈতিক হিসেব নিকেশে একটি স্বচ্ছতা বজায় থাকা সুস্থ শিক্ষা প্রশাসনের একটি বিরাট অনুসঙ্গ।
সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের নিয়মে, বেসরকারিগুলো বেসরকারিভাবে এই অর্থনৈতিক হিসেব-নিকেশ করে থাকে। তবে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে একটি জটিল সমস্যা হলো -প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বেসরকারি, পরিচালনা করে কমিটি ব্যতিক্রম ছাড়া যাদের অধিকাংশেরই শিক্ষার চেয়ে অর্থনৈতিক বিষয়গুলো বেশি গুরুত্ব পায়।
আর তাই দুর্নীতিও হয়ে থাকে বেশি। আবার এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের একশত শতাংশ মূল বেতনসহ আরো কিছু সুবিধাদির জন্য অর্থ আসে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে এবং শিক্ষার্থীবেতনসহ অন্যান্য কিছু উৎস থেকেও অর্থ আসে প্রতিষ্ঠানের ফান্ডে। তবে, এগুলোর চেয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থ কোথায় ও কিভাবে ব্যয় করা হলো সেই হিসেবটি ভালভাবে রাখার জন্য ডিআইএ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ই-ক্যাশবুক চালু করতে যাচ্ছে। উদ্যোগটিকে ভালোই বলতে হবে।
আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে শুরু হচ্ছে ই-ক্যাশবুক। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজে এ বিষয়ে এক সেমিনারের আয়োজন করে গত ১৭ জুন। রাজধানীর ১৫টি কলেজের ৪৫ জন শিক্ষক ও কর্মকর্তা এতে অংশগ্রহণ করেন। রাজধানীর ১৫টি কলেজ থেকে প্রতিষ্ঠান প্রধান, কম্পিউটার পচিালনায় দক্ষ একজন করে শিক্ষক এবং একজন করে অফিস সহকারী বা হিসাব সহকারীকে নির্দশনা দেয় ডিআইএ।
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ই-ক্যাশবুক চালুর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের এ কর্মশালায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত সচিব বদরুন নাহার। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক মো. সাইফুল উসলামের সঞ্চালনায় সেমিনারে আলোচক ছিলেন অধিদপ্তরের যুগ্ম-পরিচলাক অধ্যাপক খন্দকার মাঞফুজুল আলম, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের উপসচিব আবু সাঈদ মো. ফজলে এলাহী এবং কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের উপসচিব মো. রাহাত মান্নান। এই কর্মশালায় ঢাকার কোতোয়ালীর শেখ বোরহানুদ্দীন কলেজে, রমনার সিদ্ধেশ্বরী কলেজ, গুলশানের গুলশান কলেজ, গুলশানের ক্যামব্রিয়ান কলেজ, লালবাগের অগ্রণী স্কুল ও কলেজ, হাতিরঝিলের শেরে বাংলা বিদ্যালয় ও কজেল, ডেমরার সামসুল হক খান উচচ মাধ্যমিক বিদ্যালয়, সূত্রাপুরের ঢাকা কারিগরি মহাবিদ্যালয়, উত্তরার মাইলস্টোন কলেজ, ডেমারার বামইল আইডিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়, বনানীর বনানী বিদ্যানিকেতন হাইস্কুল, তেজগাঁওয়ের রাজধানী উচ্চ বিদ্যালয়, গুলশানের মহাখালী দারুল উলুম হোসাইনিয়া সিনিয়র মাদরাসা এবং ধামরাইয়ের কৃষি কলেজকে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন? কেউ কেউ বলেছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ই-ক্যাশবুক চালু হলে বেশ কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে। যার মধ্যে লেনদেনের হিসাব সহজে পাওয়া যাবে, কাগজের বই, স্টেশনারি সামগ্রী, এবং পরিবহন খরচ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে। অনলাইন রিসোর্স ও শিক্ষা উপকরণ ব্যবহারে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বেড়ে যাবে। তাই কেউ কেউ এটিকে একটি এটি সময়োপযোগী উদ্যোগ বলেছেন। বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদের সভাপতি এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ট্রেজারার অধ্যাপক মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান বলেছেন ‘১৯৮০ খিষ্টাব্দে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এই দপ্তরটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম আলমগীর এই দপ্তরে বহু বছর কাজ করেন।
তিনি বলেন জিয়াউর রহমানই বেসরকারি শিক্ষকদের সরকারি বেতনস্কেলভুক্ত করেন। যেটির পরে নামকরণ হয় ‘মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার’ বা এমপিও। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেহেতু সরকারি অর্থ পাচ্ছে তাই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থাও থাকতে হবে, তাই এই উদ্যোগ।
প্রতিষ্ঠানের অর্থ নিয়ে যে নয়-ছয় চলে সেক্ষেত্রে শিক্ষাবিদদের বিষয়টিকে আশাবাদী করতেই পারে। শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ই-ক্যাশবুক চালু হলে বেশ কিছু সুবিধা পাওয়া যাবে। যার মধ্যে লেনদেনের হিসাব সহজে পাওয়া যাবে, কাগজের বই স্টেশনারি সামগ্রী, এবং পরিবহন খরচ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাবে। অনলাইন রিসোর্স ও শিক্ষা উপকরণ ব্যবহারে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বেড়ে যাওয়ার কথা। তবে, বাস্তবতা ভিন্ন বিষয়! নতুন কোনো অ্যাপ্রোচ বা পদক্ষেপ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করার জন্য আরো কিছু শর্ত থাকে যার সবগুলোই এখানে নেই।
তাছাড়া, যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তাদের মধ্যে সবগুলো নয় তবে, অধিকাংশই অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ। এসব প্রতিষ্টানে ই-ক্যাশবুক বা অন্য যেকোনো নতুন ধারণা চালু করা প্রয়োজন কারণ এগুলোর অর্থনৈতিক লেনদেন হয় বেশ বড় মাত্রার। কিন্তু দেশের অধিকাংশ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবস্থা এর ধারে কাছেও নেই, তাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। কাজেই অর্থ কিভাবে আসবে সেটি নিয়ে চিন্তিত থাকতে হয়। তাদের সীমিত ও টানাটানি অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে কোনো নতুনত্ব বোধহয় কাজ দিবেনা। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিষয়টি উপযোগী।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক