তরুণদের নৈতিকতা ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের প্রভাব | মতামত নিউজ

তরুণদের নৈতিকতা ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের প্রভাব

২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৭ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছেন, যার অধিকাংশই তরুণ।

#নৈতিকতা

বিশ্বজুড়ে সামাজিক মাধ্যমের অভাবনীয় প্রসার ও প্রভাব চোখে পড়ার মতো। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মেরও দৈনন্দিন জীবনে এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোর প্রভাব ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। তবে যত দ্রুত এগোচ্ছে এই প্রযুক্তির ব্যবহার, তত দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছে নৈতিক অবক্ষয় এবং অশ্লীলতার ছোঁয়া।

২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৭ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছেন, যার অধিকাংশই তরুণ। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তারা জ্ঞান অর্জন থেকে শুরু করে বিনোদন পর্যন্ত পায়।

কিন্তু এই সুবিধার সঙ্গে এসেছে অনিয়ন্ত্রিত অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ ভিডিয়ো ও ছবি। যা তরুণদের মানসিক ও নৈতিক বিকাশে মারাত্মক বাধা সৃষ্টি করছে। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয় সাংবাদিক সমিতি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা বিভাগ যৌথভাবে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বাংলাদেশে সামাজিক মাধ্যমে অশ্লীলতার বিষয়বস্তু শতকরা প্রায় ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। তরুণদের মধ্যে মানসিক চাপ, অস্থিরতা ও অপরাধ প্রবণতার হারও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে তরুণ সমাজ আজ সহজেই প্রবেশ করছে বিভিন্ন অশ্লীল ভিডিয়ো ও বিকৃত ধারণার জগতে। শিক্ষাবিদরা মনে করেন, কিশোর-কিশোরীরা যখন মানসিক ও শারীরিক বিকাশের পর্যায়ে থাকে, তখন এ ধরনের বিষয়বস্তু তাদের জন্য বিষাক্ত। এর ফলে বেড়ে যায় বিকৃত যৌনতা, সম্পর্কের প্রতি অবজ্ঞা, মানসিক উদ্বেগ এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতা।

তরুণরা নিজেদের মধ্য থেকে আদর্শ হারিয়ে ফেলে। পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়, শ্রদ্ধাবোধ ক্ষুণ্ন হয়, ও শিক্ষার প্রতি আগ্রহ কমে যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহার ও অশ্লীলতা মানসিক রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি করে।

আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতা : বাংলাদেশ সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ প্রণয়ন করলেও এর কার্যকর প্রয়োগ এখনো অনেকটাই সীমিত। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো নিজেদের নিয়মাবলী দেয়, তবে বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রণের কাঠামো অনেকটাই অপ্রতুল। অশ্লীল কনটেন্ট নির্মাতা ও প্রচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।

বিটিআরসি ও সাইবার ক্রাইম ইউনিটের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করলেও, বড় প্ল্যাটফর্মগুলো আন্তর্জাতিকভাবে পরিচালিত হওয়ায় আইনগত জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। অনেক সময় এগুলো বন্ধ বা সেন্সর করার পরিবর্তে বিকল্প পেজ ও চ্যানেল তৈরি হচ্ছে, যা সমস্যাকে আরো জটিল করে তোলে।

বিশ্বের অনেক দেশই সামাজিক মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিংয়ে কড়াকড়ি বজায় রেখেছে। যেমন দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানি, সিঙ্গাপুর প্রভৃতি দেশে অশ্লীল কনটেন্ট সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ হয় এবং সাইবার নিরাপত্তা বজায় রাখতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। এই দেশগুলোতে সামাজিক শিক্ষার মাধ্যমে তরুণদের সচেতনতা বৃদ্ধি, স্কুল পর্যায়ে ডিজিটাল মিডিয়া শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি এবং অভিভাবকদের জন্য নিয়মিত কর্মশালা পরিচালনা করা হয়।

এর ফলে তারা প্রযুক্তির ইতিবাচক দিকগুলো কাজে লাগাতে পারছে। বাংলাদেশের জন্য প্রাসঙ্গিক সুপারিশসমূহ : ১. কঠোর আইন প্রয়োগ ও নজরদারি বৃদ্ধি: সামাজিক মাধ্যম ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অশ্লীল কনটেন্ট নির্মাতা ও প্রচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিটিআরসি ও সাইবার নিরাপত্তা ইউনিটের আধুনিক প্রযুক্তি ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে তা সম্ভব।

২. মিডিয়া শিক্ষার কার্যক্রম জোরদার: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল মিডিয়া সচেতনতা ও নৈতিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্তি অপরিহার্য। ৩. অভিভাবকদের ডিজিটাল প্রশিক্ষণ: অভিভাবকরা যেনো সন্তানদের অনলাইন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও পরামর্শ দিতে পারে সে জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

৪. সৃজনশীল কনটেন্ট নির্মাণ: সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে শিক্ষামূলক, মনোরম ও নৈতিক বিনোদনের প্রচার ও উন্নয়ন করতে হবে। ৫. সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি: গণমাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে যাতে পুরো সমাজ একযোগে সমস্যার মোকাবিলা করতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম একদিকে যেমন আমাদের জন্য আধুনিক জ্ঞানের দরজা খুলেছে, অন্যদিকে তেমনই তা বিপদের জায়গায় পরিণত হয়েছে তরুণ প্রজন্মের নৈতিকতা ও মানসিকতার জন্য। আমাদের উচিত এই আধুনিক প্রযুক্তিকে সঠিক নিয়ন্ত্রণ ও দিকনির্দেশনা প্রদান করে জাতির মেধা ও মননশীলতা রক্ষা করা। তরুণদের সঠিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও প্রযুক্তি ব্যবহারের সঠিক পথ দেখানো এখন সময়ের দাবি। না হলে আমরা হারাবো এক পুরো প্রজন্মকে- যারা আমাদের ভবিষ্যৎ।

লেখক: শিক্ষার্থী ফুলছড়ি সরকারি কলেজ, সাঘাটা, গাইবান্ধা।

#নৈতিকতা