জুলাই অভ্যুত্থানের পর এনটিআরসিএতে নানা দাবিতে ভিড় জমান শিক্ষক পদপ্রার্থীরা। মব সৃষ্টি করা হয় বারবার। ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদে বদলি হয়ে চলে যান চেয়ারম্যান সাইফুল্লাহিল আজম।
২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে চেয়ারম্যান পদে আসার আগে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন বহু বছর।
তিনমাস আগে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদ থেকে চাকরি থেকে স্বাভাবিক অবসরে যান অতিরিক্ত সচিব সাইফুল্লাহিল আজম। তবে, যাওয়ার আগে গ্রেড ১ পেয়েছিলেন।
গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর এনটিআরসিএর চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ পান অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মাদ মফিজুর রহমান। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড প্রশাসনের সদস্য পদে দাপটের সঙ্গে কর্মরত ছিলেন তিনি।
আরো পড়ুন:লক্ষাধিক শিক্ষক নিয়োগের শূন্যপদের তালিকা প্রকাশ
নতুন পাস : শিক্ষক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের সংশোধিত বিজ্ঞপ্তি জারি
শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় নতুন করে পাস ১১৩, নানা প্রশ্ন
ফেল করা অষ্টাদশ শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে সাতজন আটক
ভুক্তভুগীরা দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, গত ১৫ বছরে যারাই নতুন চেয়ারম্যান এসেছেন তাদের প্রায় প্রত্যেককে চালাতেন আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী (বর্তমানে কারাগারে) শাহজাহান খান-এর ভাগ্নি পরিচয়দানকারী একজন শিক্ষা ক্যাডারের অধ্যাপক। যিনি বিভিন্ন পদে এনটিআরসিএতে ১৭ বছর ধরে রয়েছেন। বর্তমানে তার পদ উপপরিচালক। নাম তার দীনা পারভীন।
ভুক্তভুগীরা আরো জানান, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এন্ট্রি লেভেলে শিক্ষক পদে নিয়োগের জন্য প্রার্থী বাছাইয়ের একমাত্র প্রতিষ্ঠান এনটিআরসিএ। প্রশাসন ও শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারাই ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে চালুর সময় থেকেই প্রেষণে নিয়োগ পেয়ে নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন।
এনটিআরসিএতে প্রেষণে আসা কতিপয় সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার অদক্ষতা, দুর্নীতি ও একশ্রেণির নামধারী আইনজীবী ও বিচারপতির হঠকারিতায় প্রায় মুখ থুবড়ে পড়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বড় ধরনের জট লেগেছে। হযবরল অবস্থা দেখে শিক্ষক পদে আগ্রহীদের অনেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন।অষ্টাদশ শিক্ষক নিবন্ধনের ভাইভা শুরু হয় গত বছরের অক্টোবরে শেষ হয় চলতি বছরের ৩১ মে। প্রায় ৮৪ হাজার প্রার্থীর ভাইভার জন্য অনেক বেশি বোর্ড গঠন করার মৌখিক নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ।
কিন্তু মোহাম্মদ মফিজুর রহমান ও দীনা পারভীনসহ কয়েকজনের সিদ্ধান্তে প্রতিদিন মাত্র ১০টি বোর্ডে মাত্র ৬০০ জনের ভাইভা নেওয়া হয়। ভাইভা বোর্ডে এক্সর্টার্নাল ডাকা হতো চেয়ারম্যান ও দীনার পছন্দে। এমন অভিযোগ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কয়েকজন পরিচালক ও উপপরিচালকের।ভুক্তভুগীরা দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, এত দীর্ঘ সময় ধরে ভাইভা নেওয়ায় অনেক প্রার্থীর বয়স ৩৫এর সীমা পার হয়ে গেছে।
তাড়াতাড়ি ভাইভা নেওয়ার তাদের আকুতি পৌঁছেনি ‘বেশি বোর্ড বেশি সম্মানী’ আশায় থাকা প্রশাসন ও শিক্ষা ক্যাডারের তিন কর্মকর্তার কর্ণকুহরে। পাত্তা পায়নি শিক্ষা উপদেষ্টার নির্দেশ। আমলাদের অসহযোগীতায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।
ভুক্তভুগীরা আরো বলেন, কোনোদিন দেখিনি ফল প্রকাশের আগেই প্রার্থীরা চেয়ারম্যান বা সচিবের সঙ্গে দহরমমহরম যোগাযোগ। ফল প্রকাশের আগেই কেউ কেউ সংগঠন বানিয়ে রেখেছেন। নেতা পরিচয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে দহরম মহরম।
নাম না প্রকাশের শর্তে একাধিক প্রার্থী দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, গত ৪ জুন অষ্টাদশ পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পরের দিন থেকে ২৮ জুন অব্দি ছুটিতে রয়েছেন চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান। এরই মধ্যে ফল প্রকাশের পর গত ১০ ও ১১ জুন দুই দফায় প্রায় দুই শতাধিক প্রার্থী চেয়ারম্যানের গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন।
অষ্টাদশ শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে ‘অনুত্তীর্ণ’ বা ‘ফেল করা’ প্রার্থীরা তাদের উত্তীর্ণ ঘোষণা করে ই-সনদ দেওয়ার দাবিতে মানবন্ধন শুরু করেন ১৫ জুন। এরপর এনটিআরসিএ অফিসে গিয়ে স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন। ঘেরাও করেছেন।
গতকাল রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জলকামানের জলে ছোঁয়া পেয়েছেন। সোমবার (২৩ জুন) রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সকাল থেকে তারা একই দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।
এর আগে, রোববার সড়ক অবরোধ করে অবস্থান করলে জলকামানের পানি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। গতকাল রোবার পুলিশের রমনা জোনের সহকারী কমিশনার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, তারা সড়কের দুইপাশেই অবস্থান নিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়।
আমরা তাদেরকে সরে যেতে অনুরোধ করেছিলাম, তাদের প্রতিনিধি সচিবালয়ে পাঠিয়ে আলোচনার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা অবস্থান অব্যাহত রাখে। তারা চেয়েছিল রাস্তা বন্ধ করে রাখবে, পরে উপদেষ্টা এসে তাদের সঙ্গে দেখা করবে। বার বার অনুরোধ করার পরেও তারা সড়ক না ছাড়ায় আমরা তাদেরকে সরিয়ে দিয়েছি।
বিক্ষোভকারীরা বলছেন, তারা প্রিলিমিনারি ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভাইভায় ভালো করলেও তাদের ‘ফেল করানো হয়েছে’। তাই তারা শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার সনদ দাবি করছেন।
পুলিশ বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দিলেও এরপর প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে বার বার সড়কে জমায়েত হওয়ার চেষ্টা করেন তারা। কিন্তু পুলিশ তাদেরকে ধাওয়া দিয়ে সরিয়ে দেয়।
আজ সোমবার ২৩ জুন বিকেলে হঠাৎ করে এনটিআরসিএ দাবি করে ভুলক্রমে অনেক পাসকরা প্রার্থীর নাম বাদ পড়েছে। তাই আবার ১১৩জনকে পাস ঘোষণা করে সংশোধিত ফল প্রকাশ করে এনটিআরসিএ। এনটিআরসিএ দাবি করে কারিগরি ত্রুটির কারণে বাদ পড়েছিলেন তারা।
এরপরই সামনে চলে আসে কারা চেয়ারম্যান মফিজের বাড়িতে গিয়েছিলেন। কারিগরি ত্রুটিতে মোট কতজন বাদ পড়েছেন? কতজন তদবির করেছেন? চেয়ারম্যান যে আর এনটিআরসিএতে আসবেন না। তিনি যে বাংলাদেশ সরকারের সচিব হওয়ার সংক্ষিপ্ত তালিকায় রয়েছেন। এসব আলোচনা।
সোমবার বিকেলে সাড়ে পাঁচটার দিকে তাদেরকে দেখা যায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবনের দিকে এগিয়ে আসতে। এসময় প্রথমে পুলিশি বাধার মুখে পড়েন তারা। পরে সেখান থেকে অন্তত ৪-৫ জনকে আটক করে নিয়ে যেতে দেখা গেছে বলে অভিযোগ আন্দোলনরতদের। তবে আটকদের নাম পরিচয় জানায়নি তারা।
এসময় তারা বলাবলি করছিলেন তারা প্রধান উপদেষ্টাকে জানাবেন যে ফল প্রকাশের ১৮ দিন পর নতুন করে ১১৩জনকে কীভাবে পাস করানো হলো। কারা চেয়ারম্যানের সঙ্গে ফল প্রকাশের আগেই অফিসে যাতায়াত করতেন। কারা ফল প্রকাশের পর গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলেন।
জানা যায়, অষ্টাদশ শিক্ষক নিবন্ধনের প্রিলিমিনারি ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভাইভা বা মৌখিক পরীক্ষায় বসার জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন ৮৩ হাজার ৮৬৫ জন প্রার্থী। গত ৪ জুন চূড়ান্ত ফল প্রকাশিত হলে তাদের মধ্য থেকে ৬০ হাজার ৫২১ জন প্রার্থী উত্তীর্ণ হন।
২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ২ নভেম্বর ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে এনটিআরসিএ। এ পর্যায়ে রেকর্ডসংখ্যক প্রায় ১৯ লাখ প্রার্থী আবেদন করেন। প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হয় ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ মার্চ।
এরপর গত বছরের ১৪ অক্টোবর লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। তাতে ৮৩ হাজার ৮৬৫ জন উত্তীর্ণ হন, পাসের হার ছিল ২৪ শতাংশ। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এনটিআরসিএ শিক্ষক নিবন্ধন সনদ দিচ্ছে। তবে শুরুর ১০ বছর শিক্ষক নিয়োগের ক্ষমতা ছিল সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি বা ম্যানেজিং কমিটির হাতে।
২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর সরকার এনটিআরসিএকে সনদ দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষক নিয়োগের সুপারিশের ক্ষমতাও দেয়। এরপর পাঁচটি গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে চলতি বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ১ লাখ ৩২ হাজার ৮৯৮ জন শিক্ষক নিয়োগের চূড়ান্ত সুপারিশ করেছে এনটিআরসিএ।
শিক্ষাসহ সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলের সঙ্গেই থাকুন। ভিডিয়োগুলো মিস করতে না চাইলে এখনই দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBEকরতে ক্লিক করুন।