প্রতীকী ছবি
অতীত অভিজ্ঞতা বলে দিচ্ছে, আজ দেশের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এবং টেলিভিশন টক-শো তে পরিবেশ নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা হবে, বাণী দেয়া হবে বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ হতে। বলা হবে মাটি দূষণ, পানি দূষণ, বায়ূ দূষণ, শব্দ দূষণ, আর্সেনিক দূষণ ইত্যাদির কথা এবং তার সঙ্গে যুক্ত হবে কার্বন-ডাই–অক্সাইড, কার্বন মনো অক্সাইড গ্যাসের কথা, উঠে আসবে নানা ক্ষতিকর রাসায়নিকের কথা, গ্রিনহাউস এফেক্ট, ওজোন স্তর ক্ষয় ইত্যাদির কথা এবং সবশেষে বলা হবে সরকারি ব্যবস্থাপনাসহ ব্যক্তি-সচেতনতার কথা। তারপর? রাষ্ট্র বা সরকার হয়তো কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, কিছু প্রযুক্তি আমদানি হবে উন্নত দেশ থেকে কিন্তু নাগরিক সচেতনতার অগ্রগতি কতটুকু হবে? কী বলা হলো বা কী লেখা হলো সেসব বেমালুম ভুলে গিয়ে আমরা ফিরে যাবো আমাদের চিরাচরিত অভ্যাসের দিকে।
রাস্তায় চলতে চলতে সিগারেট টানবো, পথচারিদের নাক বরাবর গলগল করে ধোঁয়া ছাড়বো, থুথু ফেলবো ডানে-বামে কারো দিকে লক্ষ্য না রেখেই অথবা পলিথিন ব্যাগে পঁচা গলা ময়লা ফেলবো একেবারে রাজপথেই। দু’দিন আগে অফিসের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে যেতে হয়েছিলো টঙ্গীর স্টেশনরোড হয়ে নরসিংদীর ওদিকে। বাসস্ট্যান্ড থেকে শুরু করে মাইলের পর মাইল নাকের ওপর ডাবল মাস্ক ঝুলিয়েও যেনো রক্ষা পেলাম না রাস্তার দু’পাশে নিক্ষেপিত বর্জ্যের উৎকট দুর্গন্ধ থেকে। মনে হলো পেটের নাড়িভুঁড়ি সব উগরে বের হয়ে আসবে। ওদিকে গাবতলী থেকে সাভার পর্যন্ত এরকম অভিজ্ঞতা কয়েকবারই হবে যদি দুর্ভাগ্যক্রমে জানালা খোলা গাড়িতে ভ্রমণ করতে হয়।
অথচ আমরা প্রায়শই চিৎকার করে বলি ‘আমরা দূষণমুক্ত পরিবেশ চাই।‘ সবাই শুধু চায় আর চায়—দেবে কে? একবার কয়েকজন সহকর্মী মিলে এসি মাইক্রোবাসে ভ্রমণে বের হলাম। গাড়ির চালক বাদে সবাই উচ্চশিক্ষিত, তারমধ্যে দু’একজন পিএইচডি ডিগ্রিধারীও বটে। একজন কিছু লিচু ও কলা নিয়ে উঠলেন এবং গাড়ির সবাইকে খাওয়ালেন। আমরা খাওয়ার পর সেগুলোর খোসা একটি পলিথিনে জমা করলাম কিন্তু দু’একজনের ঐ কষ্টটুকু করতে ইচ্ছে করলো না, তারা গাড়ির জানালা খুলেই কলা এবং লিচুর বর্জ্য জানালা দিয়ে বাইরে রোডের ওপর নিক্ষেপ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ হলো এবং তাৎক্ষণিক জবাবও পাওয়া গেলো—‘এটা বাংলাদেশ ভাই, বিদেশ নয়।’ অর্থাৎ এটা বাংলাদেশ বলে যা খুশি করা যায়, এখানকার পরিবেশ সবকিছু করতেই অনুমতি দেয়, এখানে সবকিছু জায়েজ আছে তা পরিবেশের জন্য যতই হুমকিস্বরূপ হোক না কেনো। এ যেনো এক মগের মুল্লুক, দেখার বা বলার কেউ নেই যদিও দিবস পালনের কর্মসূচির কোনো ঘাটতি নেই।
মো. নজরুল ইসলাম
এ কথা সবারই জানা যে শুধু মানুষই নয় বিশ্বের প্রতিটি প্রাণীরই রক্ষাকবচ এই পরিবেশ, আর সেটি অবশ্যই দূষণমুক্ত পরিবেশ। সেকারণেই বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতি বছর ৫ জুন পালিত হয় ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস।’ ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে সুইডেনের স্টকহোমে অনুষ্ঠিত মানব পরিবেশের ওপর প্রথম জাতিসঙ্ঘ সম্মেলনে পরিবেশ সংক্রান্ত ব্যাপক আলোচনার পর সাধারণ পরিষদের ২৭তম অধিবেশনে প্রতি বছর ৫ জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ পালনে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। কর্মসূচি পালনে আমরাও পিছিয়ে নেই, অন্তত দু’একটি গাছ লাগিয়ে অথবা ঝাড়ু হাতে পোজ দিয়ে কিছু ছবি ফেসবুকে পোস্ট করে আমরা এ কর্মসুচি বেশ ঘটা করেই পালন করি এবং সরকারি কোষাগার থেকে এই খাতে নির্ধারিত বরাদ্দ থেকে ব্যয় করতে সামান্যতম কার্পণ্য না করে বরং উদার হস্তে সবটুকু নিঃশেষ করে দিই।
বাস্তবে যা ঘটে তা হলো ব্যাপক বৃক্ষনিধন, পাহাড় কেটে আনা, নদীর পাড় কেটে বালু উত্তোলন, নদী দখল ও ভরাট করে বাড়ি অথবা কারখানা নির্মাণ, নদীগর্ভে কারখানার বর্জ্য নিক্ষেপ করে নদীর পানি দূষণ বা নদী ভরাটকরণ, যত্রতত্র পলিথিন নিক্ষেপ করে জমির উর্বরতা নষ্টকরণ, ইটভাটা অথবা কলকারখানার ধোঁয়ায় বায়ুদূষণ আর কত কী যে করি যা চার পাশে তাকালেই আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাই। গাড়িতে এখন হাইড্রলিক হর্ণ ব্যবহৃত না হলেও বাস-ট্রাক-মটর সাইকেলের সমন্বিত হর্ণ এর আক্রমণে পথচারীর কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে বড় বড় শহরের প্রতিটি রাস্তায়। এসব ব্যাপারে ট্রাফিক নির্বিকার। পরিবেশ দূষণে সম্ভবত ঢাকা নগরী সারা বিশ্বে অপ্রতিদ্বন্দ্বী, এর অন্য কোনো জুড়ি নেই। টঙ্গীর তুরাগের তীরে অথবা বুড়িগঙ্গার তীরে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই টের পাওয়া যায় আমরা কোন পর্যায়ে নেমেছি।
এই নদীদ্বয়ের পানিতে রয়েছে জৈব-আবর্জনা, রাসায়নিক পদার্থ, বিভিন্ন রোগের জীবাণুসমূহ, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, উষ্ণপানি ও কারখানার ডিজেল-মবিল-রং মিশ্রিত রাসায়নিক বর্জ্য। বুড়িগঙ্গা এবং তুরাগের পানি এখন এতোটাই বিষাক্ত যে এখানে মাছ তো দূরে থাক কাঁকড়া-কচ্ছপও বাস করতে পারে না। এ দু’টি নদীর বক্ষ বহুবছর ধরে ভূমিদস্যুদের দখলে। অবৈধভাবে নদীদখল করে তারা গড়ে তুলেছে বিভিন্ন স্থাপনা এবং নিজেরা বনে গেছে কোটি কোটি টাকার মালিক। ঢাকার চারপাশের অধিকাংশ খালের এখন চিহ্নমাত্র নেই। বিভিন্ন কলকারখানা এখন শুধু শিল্পনগরীতেই নয়, এগুলো এখন নির্মিত হচ্ছে খোদ আবাসিক এলাকায় অত্যন্ত অপরকল্পিতভাবে। যত্রতত্র হাসপাতাল এবং রাসায়নিক কারখানা গড়ে উঠায় লোকালয় বা আবাসিক এলাকায়ও মানবজীবন এখন হুমকিস্বরূপ । মানব-রচিত বিরূপ পরিবেশ এখন ঢাকা নগরীকে বাসের অযোগ্য করে তুলেছে।
একসময় গ্রামীণ জীবন ছিলো দূষণমুক্ত কিন্তু সেদিন এখন বিগত। কৃষিজমিতে অপরিকল্পিতভাবে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহার খাল-বিল-নদী-নালা এমনকি পুকুরের পানিকেও দূষিত করে তুলছে। ভূগর্ভের পানিও এখন আর নিরাপদ নয়। বিভিন্ন এলাকার হস্তচালিত নলকূপের পানিতে মিলছে ভয়াবহ মাত্রায় আর্সেনিকের উপস্থিতি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন আর্সেনিকযুক্ত পানি পানে গ্রামের সাধারণ মানুষ বিভিন্ন চর্মরোগসহ ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন। বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে আগে প্রতিটি গ্রামে যে ফলের বাগান ছিলো সেগুলো ধ্বংস করে সেখানে গড়ে উঠেছে পাকা বাড়ি এবং বিভিন্ন ছোটখাটো মিল-ফ্যাক্টরি। বেশি লাভের আশায় ধানিজমি নষ্ট করে কৃষকরা দীঘি খুঁড়ছে যেখানে রাতারাতি মাছের শরীর বৃদ্ধির লক্ষ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে রাসায়নিক মিশ্রিত সার এবং ফিশফিড। দিঘীতে এখন আর গোসল করা যায় না কারণ দিঘীর জলে গা ভেজালেই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে চুলকানিসহ বিভিন্ন চর্মরোগে। কৃত্রিম উপায়ে চাষকৃত যে মাছ আমরা বাজার থেকে কিনে খাচ্ছি তা কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত একমাত্র বিশেষজ্ঞরাই বলতে পারবেন।
আমাদের পরিবেশের সমস্যা প্রচুর কিন্তু সমাধানের উদ্যোগ সামান্যই। ওজোনস্তর ক্ষয়জনিত সূর্যের আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির ভয়াবহতার বিষয়টি নিয়ে বিশ্বনেতারা ভাববেন, সিএফসি বা ক্লোরোফ্লুরো কার্বন অথবা, কার্বন টেট্রাক্লোরাইড, মিথাইল ব্রোমাইড অথবা মিথাইল ক্লোরোফর্মের মত ক্ষতিকর পদার্থসমূহের বিষয়ে সাধারণ মানুষের তেমন কোনো ধারণা নেই বিধায় সেসব নিয়ে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা ভাববেন এবং যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারকে পরামর্শ দেবেন। কিন্তু বৃক্ষনিধন, যেখানে সেখানে গৃহস্থালির পঁচাগলা বর্জ্য নিক্ষেপ অথবা কারখানার বর্জ্যসহ পোড়া মবিলের মত ক্ষতিকর রাসায়নিক নদীগর্ভে নিঃসরণের মত অপকর্মগুলির বিষয়ে এ যুগের সব শ্রেণির নাগরিকই সম্যক অবহিত। তারা চাইলেই এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করে পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখতে পারে কিন্তু উপযুক্ত শিক্ষার অভাবে তাদের মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে না।
সরকারি উদ্যোগে বর্জ্য-ব্যবস্থাপনা, বর্জ্য-রিসাইক্লিং ইত্যাদির কথা আমরা বহু বছর ধরে শুনে আসছি কিন্তু দৃশ্যমান কোনো উন্নতি দেখছি কি? এ বিষয়ে রাজনৈতিক সরকারের সদিচ্ছার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। আমরা ব্যক্তিপর্যায়ে যদি যথেষ্ট সতর্ক হই তবে এ সমস্যার সিংহভাগই সমাধান হয়ে যায়। ঘর থেকে যখনই বের হবো তখনই প্রতিটি পদক্ষেপেই যদি নিজেরা পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে চলি তবে পরিবেশ আপনাআপনি শুদ্ধ হতে বাধ্য। নিজে শুদ্ধ তো জগত শুদ্ধ। কবিগুরুর জুতা আবিষ্কার কবিতার সেই চরণ দু’টি আরো একবার স্মরণ করা যেতে পারে, ‘নিজের চরণ দু’টি ঢাকো তবে/ ধরণীরে আর ঢাকিতে নাহি হবে।’ শুধু ৫জুন নয় আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি দিনই হোক পরিবেশ দিবস, তাহলেই আমাদের সামাজিক ও নাগরিক জীবন হয়ে উঠবে সুস্থ সুন্দর ও সুখময়।
লেখক: পরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়