তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বনাম প্রশ্নবিদ্ধ মানবতা | মতামত নিউজ

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বনাম প্রশ্নবিদ্ধ মানবতা

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র এসব যুদ্ধে অংশ নেবে না, বরং সেগুলো বন্ধ করবে। আমরা এই মূর্খ, অন্তহীন যুদ্ধ থেকে মানুষকে থামাতে যাচ্ছি। আমরা নিজেরা এতে অংশ নেবো না।

ছবি: শুভাশিস ব্যানার্জি শুভছবি: শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ

চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ফ্লোরিডার মিয়ামিতে এক সম্মেলনে বক্তৃতা দেয়ার সময় বলেছিলেন, ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ খুব বেশি দূরে নয়।’ ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম এনডিটিভির সেই সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা আশঙ্কা প্রকাশ করলেও তিনি এটাও বলেছেন যে, তার নেতৃত্ব এটি ঘটতে বাধা দেবেন।

সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ করে কারো কোনো লাভ নেই উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেছেন, ‘আপনারা এটি (বিশ্বযুদ্ধ) থেকে দূরে নন। আমি বলছি, এটি দূরে নয়। যদি আমাদের এই প্রশাসন (বাইডেন সরকার) আর এক বছর থাকতো, আপনারা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে থাকতেন। তবে এখন এটি ঘটবে না।

এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র এসব যুদ্ধে অংশ নেবে না, বরং সেগুলো বন্ধ করবে। আমরা এই মূর্খ, অন্তহীন যুদ্ধ থেকে মানুষকে থামাতে যাচ্ছি। আমরা নিজেরা এতে অংশ নেবো না। তবে আমরা যে কারও চেয়ে আরো শক্তিশালী হবো। এবং যদি কখনও যুদ্ধ শুরু হয়, এমন কেউ নেই যে আমাদের কাছাকাছি আসতে পারবে। কিন্তু আমরা মনে করি না যে এটি কখনও ঘটবে।’

ট্রাম্পের ২০ ফেব্রুয়ারিতে দেয়া বক্তৃতা সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণ হতে খুব বেশি সময় লাগেনি। এমন বাস্তবতায় চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পৃথিবীর ইতিহাসে যুক্ত হয়েছে আরো একটি কালো অধ্যায়। ইরানের ওপর ইসরায়েলের অতর্কিত এবং শতভাগ বিতর্কিত হামলায় মনুষ্যত্ব এখন প্রশ্নবিদ্ধ।

বিবিসির নিরাপত্তা বিষয়ক সংবাদদাতা ও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত রিজার্ভ অফিসার ফ্রান্সিস রোলেস্টন গার্ডনার এক প্রতিবেদনে লিখেছেন, ইসরায়েল ইরানের ওপর যে হামলা চালিয়েছে, তা এক অর্থে নজিরবিহীন। এই অভিযানের নাম তারা দিয়েছে ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’।

ইরানও পাল্টা জবাব দিয়েছে। হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলের ওপর। ইরানের সঙ্গে ইসরায়েলের গতবছর ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন বিনিময় হয়েছিলো। কিন্তু অতীতের যেকোনো সংঘাতের তুলনায় ইরানের তরফে সাম্প্রতিক এই হামলা অনেক বেশি বিস্তৃত। প্রসঙ্গত, ১৯৮০-১৯৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর এটা ইরানের ভূখণ্ডের ওপর চালানো সব চাইতে বড় হামলা বলে মনে করা হচ্ছে।

ফ্রান্সিস রোলেস্টন গার্ডনার বিবিসি-তে প্রকাশিত তার প্রতিবেদনে আরো লিখেছেন, ভোরের আলো ফোটার আগে ইসরায়েলি বিমান বাহিনী শুধুমাত্র ইরানের পরমাণু কর্মসূচির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত স্থাপনাগুলোকেই নয়, সে দেশের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিগুলোকেও নিশানা করে হামলা চালায়।

যার ফলে ইরানের পাল্টা আঘাতের ক্ষমতা কমেছে। জানা গেছে, ইরানের সামরিক কমান্ড এবং পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রধান ব্যক্তিদের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করতে সাহায্য করেছিলো ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের নেটওয়ার্ক। ইসরায়েলের তরফে চালানো এই অভিযানে ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (আইআরজিসি) প্রধান, মূলধারার সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান এবং আইআরজিসি-র বিমান বাহিনীর প্রধানের মৃত্যু হয়েছে। আইআরজিসি ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে শাহের শাসনকে উৎখাতকারী ইসলামি বিপ্লবের মূলে ছিলো।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স-এর সংবাদে জানানো হয়েছে, ইরানে কমপক্ষে সে দেশের ছয়জন বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয়েছে। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা সফলভাবে ইরানের নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের একেবারে কেন্দ্রস্থলে প্রবেশ করে আঘাত হেনেছে এবং প্রমাণ করে দিয়েছে যে সেখানে কেউই আর নিরাপদ নয়। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের সংবাদে ৭৮ জনের মৃত্যুর কথা জানানো হয়েছে।

নিহতদের মধ্যে শিশুসহ বেসামরিক নাগরিক রয়েছেন বলেও জানানো হয়েছে। (এই সংখ্যা অনানুষ্ঠানিক। স্বাধীনভাবে এই তথ্য যাচাই করা হয়নি।) মোসাদ ইরানের ভেতর থেকেই ড্রোন হামলা চালাতে সক্ষম হয়েছে বলেও জানা গেছে। এই পুরো অভিযানের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিলো পারমাণবিক স্থাপনা এবং আইআরজিসির ঘাঁটি। দীর্ঘ সময় ধরেই ইসরায়েল ঠিক এই কাজটাই করতে চেয়েছিলো।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেছেন, ‘ইসরায়েলের বর্তমান সরকার বিশেষত প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর নীতি আসলে দ্বিমুখী। একদিকে তিনি আমেরিকাকে টানার চেষ্টা করছেন, অন্যদিকে ইরান যেনো নিউক্লিয়ার পাওয়ার হয়ে ওঠে—সেই পথও সুগম করছেন। এই পলিসি যেনো ‘দুষ্টু লোকের কৌশল’—অন্যের ক্ষতি করে নিজের লাভ। ইসরায়েল অনেকটাই টিকে আছে আমেরিকার কারণে।

প্রতি বছর প্রায় চার বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা পায় তারা। কিন্তু ইরানের সামর্থ্য এবং বাজার অনেক বড়। ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছিলো, এবং সেটার ধারাবাহিকতায় এখনও কিছু নেগোশিয়েশন চলছে। যদি আমেরিকা-ইরান সম্পর্ক ভালো হয়ে যায়, তাহলে ইসরায়েলের জন্য তা হবে কৌশলগত বড় ক্ষতি।

তাই নেতানিয়াহু চাইছেন ইরানকে এমনভাবে আক্রমণ করতে, যাতে ইরান বাধ্য হয় নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরি করতে। তখন আমেরিকাকে দেখিয়ে তিনি বলবেন, ‘দেখুন, আমি তো বলেই এসেছি!’ এতে আমেরিকার আরো কঠোর স্যাংশনের সম্ভাবনা তৈরি হবে।’

স্টকহোম আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউট সিপ্রির তথ্য অনুসারে, বর্তমানে বিশ্বের নয়টি দেশের কাছে ১৬ হাজার ৩০০টি পারমাণবিক বোমা আছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দখলেই রয়েছে প্রায় ১৪ হাজার। রাশিয়ার কাছে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি আণবিক বোমা রয়েছে। দেশটিতে এ ধরনের বোমার সংখ্যা ৭ হাজার ৫০০-এর বেশি। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম পারমাণবিক বোমা বানিয়েছে এবং একমাত্র দেশ যারা এটা যুদ্ধে ব্যবহারও করেছে। দেশটির এখন ৭ হাজারের বেশি পারমাণবিক বোমা রয়েছে। বাকিগুলো সাতটি অন্যান্য পারমাণবিক অস্ত্রধর দেশের মধ্যে বিভক্ত। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য আছে ২১৫, ফ্রান্স ৩০০, চীন ২৭০, ভারত ১২০, পাকিস্তান ১২০, ইসরায়েল ৮০ এবং উত্তর কোরিয়া ১০টি।

পারমাণবিক অস্ত্রের সম্প্রসারণ না করার মধ্যস্থতার চুক্তিপত্র অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে চিহ্নিত পৃথিবীর ৫টি পারমাণবিক অস্ত্রধর রাষ্ট্রসমূহ হচ্ছে চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র। এই চুক্তি তাদের অস্ত্রাগার সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখে এবং সেটিকে বৈধতা দেয়, কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী উল্লিখিত রাষ্ট্রসমূহ এগুলোকে চিরন্তনভাবে সংরক্ষণ কিংবা প্রস্তুতির মান্যতা দেয় না। উল্লিখিত রাষ্ট্রসমূহ অস্ত্রগুলোকে নির্মূল করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পাকিস্তান, ভারত, ইসরায়েল ও উত্তর কোরিয়া এই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেনি। দেশগুলোর কাছে থাকা মোট পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ৩৪০টি।

খুব সাধারণ একটি প্রশ্ন হতে পারে ‘যুদ্ধ’ কি? বিংশ শতাব্দীর ফরাসি দার্শনিক জাক দেরিদা এই প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘যুদ্ধ হলো একটি সশস্ত্র সংঘাত। যা রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে অথবা সরকারি বাহিনী এবং একটি নির্দিষ্ট কমান্ড কাঠামোর অধীনে সংগঠিত এবং সামরিক অভিযান পরিচালনা করার ক্ষমতা সম্পন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে অথবা এই ধরনের সংগঠিত গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘটিত হয়। এটি সাধারণত নিয়মিত বা অনিয়মিত সামরিক বাহিনীর ব্যবহারে ব্যাপক সহিংসতা, ধ্বংস এবং মৃত্যুহার দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। যুদ্ধ বলতে যুদ্ধের ধরন, অথবা সাধারণভাবে যুদ্ধের সাধারণ কার্যকলাপ এবং বৈশিষ্ট্যগুলিকে বোঝায়। সম্পূর্ণ যুদ্ধ হলো এমন যুদ্ধ যা কেবল বৈধ সামরিক লক্ষ্যবস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় এবং এর ফলে ব্যাপক বেসামরিক বা অন্যান্য অযোদ্ধাদের দুর্ভোগ এবং হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে।’

গ্লোবাল পিস ইনডেক্সের সর্বশেষ তথ্য মতে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। তারা বলছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সমস্যা দেখা গিয়েছিলো। বর্তমানেও সেসব লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। উইকিপিডিয়া থেকে জানা গেছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-১৯৪৫) পরবর্তী একটি কাল্পনিক ভবিষ্যত বৈশ্বিক সংঘাত ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ’। এটা ব্যাপকভাবে অনুমান করা হচ্ছে যে, এই ধরনের যুদ্ধের সঙ্গে তার পূর্বসূরিদের মতো সব মহান শক্তি জড়িত হবে। পাশাপাশি পারমাণবিক অস্ত্র বা গণবিধ্বংসী অন্যান্য অস্ত্রের ব্যবহার করা হবে, যা ভৌগোলিক সুযোগ, ধ্বংসযজ্ঞ এবং প্রাণহানির ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী দ্বন্দ্বগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে।

এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের অবস্থা বা অবস্থান কি হতে পারে? আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেছেন, আমরা এখনো সেই কাঠামো তৈরি করতে পারিনি যেটা দোহা বা তুরস্ক করতে পেরেছে। যদি বাংলাদেশ ওআইসি, আরব বিশ্ব এবং দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে একটি যৌথ কূটনৈতিক কাঠামো তৈরি করে, তাহলে শান্তি উদ্যোগে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানেই আত্মহত্যা। এটা কেউ জেনে শুনে চায় না বলে মন্তব্য করেছেন তিনি। ড. ইমতিয়াজ বলেছেন, ‘এখন দেখার বিষয়, ইসরায়েলের জনগণ কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানায় এবং আমেরিকা-ইউরোপের জনগণ এই আগ্রাসী কৌশলকে মেনে নেয় কিনা। কারণ শান্তির পথ বন্ধ হলে ক্ষতি হবে সবারই।’

আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। আমাদের উচ্চারণ হোক- যুদ্ধ নয়, শান্তি হোক মানবতার পথচলা। যুদ্ধ বন্ধে বিশ্ব নেতাদের এখনই সজাগ হওয়া জরুরি। শুধু বিবৃতি দিয়ে নয়, কার্যকর উদ্যোগ নিয়ে এই সংঘাত থামাতে হবে। ইরান-ইসরায়েলের মধ্যে চলমান উত্তেজনা শুধু ওই অঞ্চল নয়, গোটা মানবজাতির অস্তিত্বের হুমকি। এই আগুন যদি অবিলম্বে নেভানো না যায়, তাহলে মানবতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে, যা কারও কাম্য নয়।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক