পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তার ‘তৈল’ নামক বিখ্যাত ‘ব্যাঙ্গ’ প্রবন্ধে অতি আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘বাস্তবিকই তৈল সর্বশক্তিমান; যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য, তাহা একমাত্র তৈল দ্বারা সিদ্ধ হইতে পারে।’ কথাটি চিরন্তন সত্যের মতই। শিরোনামে ব্যবহৃত তৈল-কালচার শব্দটি শ্রুতিমধুর তো নয়ই বরং এ ধরণের শব্দ ব্যবহারে অনেকেরই যথেষ্ট আপত্তি থাকতে পারে। কিন্তু দেশের বর্তমান অবস্থার নাজুকতা বিবেচনায় তৈল-কালচার, তৈল মর্দন, এই শব্দগুলোই অধিকতর উপযোগী বলে মনে হচ্ছে। যাদের উদ্দেশ্যে এসব শব্দের ব্যবহার, তারা ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ও সম্মানিত লোক হলে এসব শব্দ ব্যবহারের প্রয়োজন হতো না। কালচার শব্দটি ইংরেজি হলেও বর্তমানে এটি বাংলার মতই ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেকেই আছেন যারা সংস্কৃতি শব্দটি সঠিক না বুঝলেও কালচার বললে খুব সহজেই বুঝতে পারেন। কালচারের সংজ্ঞায়ন করতে গেলে অযথাই লেখার কলেবর বৃদ্ধি পাবে তবুও বিশেষজ্ঞ প্রদত্ত সংজ্ঞাসমূহের মধ্যে অতি সংক্ষিপ্ত আকারে প্রদত্ত এবং অধিক গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞাটি বিবৃত করবার প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে। British anthropologist Edward Tylor বলেছেন, ‘’Culture is that complex whole which includes knowledge, believe, art, law, morals, custom and another capabilities and habits acquired by man as a member of society.’’ তবে এখানে habit বলতে Tylor মানুষের শুধু good habitকেই বুঝিয়েছেন কি না তা পরিষ্কার নয়। যেমন ধরা যাক, সব দেশেরই কিছু লোকের জুয়া খেলার বদভ্যাস আছে, সেটিকে কি সেই দেশের সংস্কৃতি বা কালচার বলা যাবে? কেউ কেউ অধিবাসীদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত বদভ্যাস, বাহুল্য এবং অন্য দেশ থেকে আমদানিকৃত সংস্কৃতিকে অপসংস্কৃতি নামে অভিহিত করবার প্রয়াস পেয়েছেন,আবার কেউ কেউ ‘অপসংস্কৃতি’ শব্দটিকেই প্রত্যাহার করতে পরামর্শ দিচ্ছেন। তাদের মতে একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডের অধিবাসীরা যা কিছু হৃদয়ে ধারণ ও বাস্তবে পালন করেন তার সবটাই সেই ভূখণ্ডের সংস্কৃতি বলে বিবেচিত, অপসংস্কৃতি শব্দটিই বরং অপ্রয়োজনীয়।
আচরণে শালীনতা, নম্রতা, ভদ্রতা, শিষ্টাচার, শুদ্ধাচার- এসবই প্রতিটি উন্নত জাতির কালচার বা সংস্কৃতির পরিচায়ক। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি ততই নম্র, ভদ্র,বিনয়ী ও শিষ্টাচারী। তবে আজকাল এই উপমহাদেশে বিশেষ করে আমাদের সমাজে শিষ্টাচারের নামে যে বাড়াবাড়ি চলছে তাকে শিষ্টাচার না বলে বরং তোষামোদ, চামচাগিরি, তৈলবাজি, মোসাহেবি ইত্যাদি বলাই শ্রেয়। ফেসবুকের কল্যাণে যা দেখা যাচ্ছে, অফিস-আদালত এবং রাজনীতিতে তোষামোদের বিষয়টি যেনো একটি অলিখিত সংবিধানের ধারায় পরিণত হয়েছে। সরকারি অর্থ তসরুপ করে অনৈতিকভাবে অফিস-প্রধানের জন্মদিন পালন এবং আরো ঘটা করে তার যোগদানের বর্ষপূর্তি পালনকে উন্নয়নের বর্ষপূর্তি পালন নাম দিয়ে সেগুলোকে আবার ফেসবুকে পোস্ট দেয়া হচ্ছে। একজন কর্মকর্তা বা কর্মচারী তার নিজের যোগ্যতায় পরিচিত হবেন, সালাম, শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রাপ্ত হবেন কিন্তু তাকে দেবতার মত শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণ করতে হবে কেনো? কেনো একজন অধীনস্তকে মেরুদণ্ড বাঁকা করে তার বসকে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করতে হবে? প্রতিষ্ঠানের একজন অতি দক্ষ ও অভিক্ষ কর্মচারীর জন্মদিন পালন না করলে যদি কোনো সমস্যা না হয় তবে অফিস-প্রধানের জন্মদিন অফিসে পালন করে, চা-নাস্তার আয়োজন এমনকি লাঞ্চ-ডিনারের আয়োজনসহ উপঢৌকন দিয়ে সরকারি অর্থের অপচয়ের বিধান কোন সংবিধান দিয়েছে? আমাদের ধর্ম, আমাদের সংবিধান দেশের সব নাগরিকের সমান অধিকার সংরক্ষণ করার নির্দেশ দান করে, তবে কেনো এ ব্যত্যয়, কেনো এ লঙ্ঘন? দেখা যাচ্ছে অফিস-প্রধান বা নেতা না জানলেও চামচারা খুঁজে খুঁজে তার জন্মদিন বের করে কেক, ফুলের তোড়া, উপঢৌকন ইত্যাদিসহ হাজির হয়ে তাকে সারপ্রাইজ দিচ্ছে। একদল সুবিধাবাদী সবসময় নিজেদের স্বার্থ আদায়ের লক্ষ্যে নিজেদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন না করে শুধু কর্তৃপক্ষের স্তুতি, গুণগান গাওয়াতেই ব্যস্ত। কর্তৃপক্ষ যেনো তাতেই বেজায় খুশি আর এরাই কর্তৃপক্ষের কৃপালাভে সবসময় কৃতকার্য। সৃষ্টিকর্তা মেরুদণ্ড নামক চেইনসদৃশ লম্বা একটি হাড় সংযুক্ত করেছেন প্রতিটি মানুষের পৃষ্ঠদেশে এবং একটি মস্তক দিয়েছেন যা শুধু তার কাছেই নোয়াবার, অন্য কোনো মানুষ বা প্রাণীর কাছে নয়, তা সে যতই শক্তিশালী হোক না কেনো। কিন্তু কতিপয় মানুষ নিজেদের গোপন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করবার মানসে বেমালুম ভুলে যায় তাদের পৃষ্ঠদেশের সেই মেরুদণ্ডটির কথা। তারা আচরণ করে অমেরুদণ্ডী প্রাণী কেঁচোর মত। এরাই কিলবিল করে ঢুকে যেতে পারে শুধু ঊর্ধ্বতনের কক্ষেই নয় বরং কৃমির মত ঢুকে যায় ক্ষমতাবানদের অস্থিমজ্জায়, দখল নেয় তাদের শরীর ও মনের। ক্ষমতাবানদের যত কৃপাদৃষ্টি, যত মায়ামমতা সবই এই কৃমিসম প্রাণীদের জন্য। নিজেদের আত্মসম্মান ও ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে যারা এসব হীন কাজ করে তাদের যোগ্যতায় ঘাটতি রয়েছে, আত্মবিশ্বাসের চরম অভাব রয়েছে এটা যেনো অনেক বড় বড় কর্মকর্তাই বুঝতে অক্ষম। এ ক্ষেত্রে প্রায়শই ঊর্ধ্বতনের বিবেকবুদ্ধি, বিচার-বিবেচনা সবই নিম্নগামী হয়ে আশির্বাদরূপে বর্ষিত হয় তোষামোদকারী, মেরুদণ্ডহীন এই প্রাণীদের প্রতি।
তোষামোদকারীকে ইংরেজিতে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়- Sycophant, flatterer, crawler, lackey এবং আরো ব্যাঙ্গার্থে তাদেরকে toady, parasite, leech, brown noser ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়ে থাকে। এই তোষামোদকারী বা sycophant সমাজের সাধারণ মানুষদের জন্য ক্ষতিকর। তাই এদের সম্পর্কে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলা হয়েছে , It’s a derogatory term. A sycophant is a person who tries to win favor from wealthy or influential people by flattering them. Having business (and personal) relationships with sycophants can be dangerous and can seriously harm your business. বিশিষ্ট গবেষক Ezra তার গবেষণা প্রবন্ধে বলেছেন, Where sycophancy thrives, innovation dies. It seems obvious that a team largely comprised of sycophants would be dysfunctional. And for an organization, the consequences of sycophant syndrome go much deeper and the costs are much greater. ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় তোষামোদকারী বা তৈল-মর্দনকারীদের কবলে পড়ে অনেক বিজ্ঞ নেতাই ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন অথবা বেঘোরে প্রাণ হারিয়েছেন। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি বা ব্যর্থতা হলো কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। অনেকেই বলে থাকেন চাকা যতই কঠিন বা অনড় হোক না কেনো যথাসময়ে যথোপযুক্ত তৈল প্রয়োগে সেটি ঘুরে যেতে বাধ্য। কথাটির সত্যতা আছে যা আমাদের চারপাশে খেয়াল করলেই বুঝা যায়। তেল খাওয়া এবং তেল দেয়া দু’টোই অনেকের পছন্দ, আর এই মহান কাজটি অব্যাহত রেখেছেন আমাদের বড় বড় আমলা এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। একজন চৌকশ নেতা বা কর্মকর্তার বোঝা উচিত কেনো নিজের কাজ ফেলে একজন তার চারপাশে ঘুরঘুর করে এবং প্রশংসা-গীত গায়। দুঃখজনকভাবে দেশে দুর্নীতিবাজদের তালিকা দীর্ঘ থেকে ক্রমেই দীর্ঘতর হচ্ছে। এই দুর্নীতিবাজরা দীর্ঘদিন তাদের অপকর্ম চালানোর পরও টিকে থেকেছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে তোষামোদ করে,ম্যানেজ করে অথবা আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে। অচিরেই যদি সংশ্লিষ্টদের শুভবুদ্ধি উদয় না হয়, আমাদের বর্তমান প্রজন্ম যদি এ বিষয়ে সচেতন না হয়, তবে আমাদের ভবিষ্যত খুবই অন্ধকার।
লেখক: যুগ্মপরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।