দেশের অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলছে সরকারের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে। কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার প্রয়োজনীয় পরিবেশ না থাকায় বিরাজ করছে বিশৃঙ্খল পরিবেশ। শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দেশের ৩৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে উপাচার্য (ভিসি) নেই। আর কোষাধ্যক্ষ (ট্রেজারার) নেই ৩১টিতে। এ ছাড়া শিক্ষার নামে সার্টিফিকেট বাণিজ্য, শীর্ষ কর্তাব্যক্তি নিয়োগে উদাসীনতা, নির্দিষ্ট সময়ে স্থায়ী ক্যাম্পাসে না যাওয়া, ট্রাস্টি বোর্ড নিয়ে দ্বন্দ্ব-মামলা, বছরের পর বছর আর্থিক প্রতিবেদন জমা না দেওয়া, অননুমোদিত কোর্স পরিচালনাসহ নানা অভিযোগ অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা নিয়েও রয়েছে দ্বন্দ্ব। সব মিলে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বেসরকারি উচ্চ শিক্ষা খাতে। সরকার চেষ্টা করেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বৃহস্পতিবার (১৮ এপ্রিল) বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন আকতারুজ্জামান।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায় ইউজিসির তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে অনুমোদিত ১১৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ১০৪টিতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অরাজক পরিস্থিতি নিয়ে বলছেন, শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা করাই কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানা সমস্যায় জর্জরিত বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা কিছু বিশ্ববিদ্যালয় একের পর এক অনিয়মে পরিচালিত হচ্ছে। নিয়ম না মানা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবিলম্বে লাগাম টানার পরামর্শ শিক্ষাবিদদের।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান (অতি. দায়িত্ব) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ভিসি ও ট্রেজারার বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ। এই দুই পদ শূন্য থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিধিবহির্ভূত অনেক কাজ হয়। এসব পদে নিয়োগের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডকে তৎপর হতে হবে। মেয়াদ শেষ হওয়ার ছয় মাস আগেই নতুন নিয়োগের প্রস্তাব পাঠাতে হবে। শুধু ট্রাস্টি বোর্ডকে এজন্য দোষ দিলে হবে না। অনেক সময় ট্রাস্টি বোর্ড যথাসময়ে প্রস্তাব পাঠালেও মন্ত্রণালয়ের কারণে দেরি হয়। মন্ত্রণালয়কেও এ নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুততম সময়ে করতে হবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব সিন্ডিকেটের। আর শিক্ষার্থী ভর্তি, পরীক্ষার মান উন্নয়ন করবে একাডেমিক কাউন্সিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ এই সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সভাপতি হবেন উপাচার্য। উপাচার্যের পদ শূন্য থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব কর্মকাণ্ডের অনেক নিয়ম বিঘ্নিত হচ্ছে।
ইউজিসির তথ্যমতে, উপাচার্য নেই এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে, আহছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি, স্টেট ইউনিভার্সিটি, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি, প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটি। এ ছাড়া এই তালিকায় আরও রয়েছে- বরেন্দ্র ইউনিভার্সিটি, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি, খাজা ইউনুস আলী বিশ্ববিদ্যালয়, চিটাগং ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটি, জার্মান ইউনিভার্সিটি, সিসিএন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, এনপিআই ইউনিভার্সিটি, বান্দরবান বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েক বিশ্ববিদ্যালয়। সূত্রমতে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সনদপত্র বিতরণের ক্ষেত্রে উপাচার্যই সনদে স্বাক্ষর করবেন। অভিযোগ রয়েছে, অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য বা অন্য কেউ উপাচার্যের স্বাক্ষর করে সনদ তুলে দিচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীদের হাতে।
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি বলেন, সার্টিফিকেটে স্বাক্ষর করার এখতিয়ার নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যের। উপাচার্যের নাম করে যারা সনদে স্বাক্ষর করছেন সেগুলো আইনগতভাবে বৈধ হচ্ছে না। আইন অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ কমিটির সদস্য হবেন ট্রেজারার। এই অর্থ কমিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট প্রণয়ন করবে এবং আর্থিক সব বিষয়ে সিন্ডিকেট ও বোর্ড অব ট্রাস্টিজের কাছে সুপারিশ করবে। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই পদ শূন্য রয়েছে ৩১ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
ট্রেজারার নেই এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় রয়েছে- সেন্ট্রাল উইমেনস ইউনিভার্সিটি, দি পিপলস ইউনিভার্সিটি, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি, দি মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস, রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা, নর্থ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও কয়েক বিশ্ববিদ্যালয়। আর ভিসি ও ট্রেজারার উভয় পদ বর্তমানে শূন্য এমন বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় রয়েছে- আহছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি, চিটাগং ইন্ডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, এনপিআই ইউনিভার্সিটি, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিসহ আরও কয়েক বিশ্ববিদ্যালয়। এদিকে সম্প্রতি এক গণবিজ্ঞপ্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের যাচাই-বাছাই করে ভর্তি হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইউজিসি। ইউজিসি গণবিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, আইন অমান্য করা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ঝামেলায় পড়লে ইউজিসি এর দায় নেবে না। ইউজিসি জানায়, অবৈধ ক্যাম্পাস ও অবৈধভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা ইবাইস ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি ও দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লার আইনগত কোনো বৈধতা নেই। এ ছাড়া ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ও সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অ্যান্ড টেকনোলজিতে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রয়েছে।