ঢাকা শনিবার, ১৮ মে ২০২৪ , ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

nogod
nogod
bkash
bkash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
nogod
nogod
bkash
bkash

বৃক্ষ রোপণের বিকল্প নেই

মতামত

কাজী বনফুল

প্রকাশিত: ০০:০০, ৫ মে ২০২৪

সর্বশেষ

বৃক্ষ রোপণের বিকল্প নেই

তীব্র দাবদাহে পুড়ছে দেশ। সবাই বৃষ্টির জন্য হাহাকার করছে। যে যার মতো প্রার্থনায় নিমজ্জিত বৃষ্টি ও শীতলতার জন্য। আমরা আমাদের নিজেদের গলায় ইচ্ছাকৃতভাবে যে ফাঁস লাগিয়েছি সে ফাঁস আমাদের নিশ্বাসকেই চেপে ধরেছে কঠিন অবরুদ্ধতায়। আমরা এখন নিজেদের ফাঁদে নিজেরাই আটক হয়ে কান্নাকাটি করছি মাঠে-ময়দানে। অথচ কতো বড় বড় বৃক্ষ ছিলো আমাদের, সবুজের সমারোহে সমৃদ্ধ ছিলাম আমরা। সেসব প্রাণবন্ধু গাছগুলোকে কেটে আমরা উজাড় করেছি নিষ্ঠুর রসিকতায়।

যখন কোনো অঞ্চলে তাপকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো শক্তি কমে যায় ঠিক তখনই সে অঞ্চলে তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটে। বৃক্ষ হচ্ছে তাপকে প্রশমিত করার সেই আদি অস্ত্র যা আমরা ধীরে ধীরে হারাতে বসেছি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মানুষ বন-বৃক্ষ উজাড় করে ফেলছে। গত ২০ বছরে যে পরিমাণ গাছ কাটা হয়েছে তার অর্ধেকও নতুন করে রোপন করা হয়নি। আর যা রোপন করা হয়েছে সেটা বড় হতে হতে আরো অনেক বড় বড় গাছ কেটে ফেলা হবে। এই যে বৃক্ষের শূন্যতার সার্কেল এটা পূরণ করতে আমাদের বহু সময় কেটে যাবে বা অসম্ভব প্রায়। অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে গাছ কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন নতুন ঘরবাড়ি এবং আমরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করছি ইটভাটায় উত্তপ্ত চুল্লির ভেতর।

অথচ খুব বেশি আগের কথা নয় গ্রীষ্মের এমনই কোনো উত্তপ্ত দিনে দাদার সঙ্গে পিয়াজখালি হাটে যেতাম। হাটে গিয়ে নরেশ দার রসগোল্লা, কালোজাম খাওয়া প্রতিনিয়ত অভ্যাস। আমাদের অঞ্চলে পিয়াজখালি হাট ছিলো সবচেয়ে বড় হাট। বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তখন আমাদের এই পিয়াজখালি হাটে বাণিজ্য করতে আসতেন অনেক মানুষ। হাট শেষে যখন দাদার সঙ্গে বাড়ির পথে ফিরতাম তখন দেখতাম অনেকে বড় বড় গাছের নিচে তাদের পথ চলার ক্লান্তি দূর করার জন্য বিশ্রাম নিচ্ছেন। আমরাও সেখানে বসে জিরিয়ে নিতাম।

বড় বড় গাছগুলোকে ভেদ করে সূর্যের তাপিত রশ্মি মাটিকে স্পর্শ করতে পারতো না, শীতলতার এক অদৃশ্য চাদরে আচ্ছাদিত থাকতো চারপাশ। সে সময় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৬-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ভেতর থাকতো। গাছগুলো দেখে মনে হতো যেনো নিজের মায়ের মতো আঁচল বিছিয়ে সন্তানদের ক্লান্তি দূর করছে। কী দারুণ ও চমৎকার দৃশ্য ছিলো। সবাই একসঙ্গে বসে দীর্ঘ পথের ক্লান্ত হৃদয়কে গল্পে গল্পে শান্ত ও শীতল করে  বাড়ির পথে যাত্রা করতেন। সেসব গাছ এখন আর নেই, গাছগুলোর কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি গাছগুলোকে হত্যা করা হয়েছে। নতুন নতুন বাড়ি উঠেছে সেসব গাছ কেটে। তখন দূর থেকে গাছগুলো দেখলে মনে হতো সবুজের উঁচু-নিচু পাহাড়ের ঢেউ অথচ এখন দূর থেকে সে জায়গা দেখলে মনে হয় কংক্রিটের প্রাচীর আর টিনের চকচকে বাসনের থালা, যেনো সূর্যের তাপে জ্বলজ্বল করছে। গাছগুলোকে হত্যা করে গড়ে উঠেছে এসব বাড়িঘর।

আমাদের একান্নবর্তী পরিবারগুলো যখন স্বার্থ এবং অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করলো ঠিক তখন থেকেই আমরা গাছগুলোকে উপড়ে গড়তে লাগলাম নতুন ঘর। আমরা একদিকে যেমন একা হতে লাগলাম তেমনি একইভাবে আমাদের চারপাশের গাছগুলোর পরিমাণও কমতে লাগলো। এ এক জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্কের বিচ্ছেদ। আমরা যেনো নিজেরাই নিজেদের বিপদকে বরণ করেছি প্রচণ্ড আগ্রহভরে। বৃক্ষহীন পৃথিবী আর নরকের মাঝে খুব বেশি তফাৎ থাকার কথা নয়।

এই হলো আমার তৎকালীন ও বর্তমান গ্রামের অবস্থা এবার আসি শহরের কথায়। ছোট বেলা থেকেই একটা প্রবাদ অনেকবার শুনেছি সেই চিরচেনা প্রবাদটি এখানে বেশ কার্যকর বটে। ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর বলেছিলে, ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়? আসলেই এড়ায় না আমরা আজ পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছি গাছগুলোর নিভৃত অভিশাপের প্রায়শ্চিত্তে। এমন স্নিগ্ধ বন্ধুত্বের আশ্রয়কে নিজেরাই গলা টিপে হত্যা করে এখন গরমের প্রচণ্ড তাপদাহে চিৎকার করি একটু শীতল পরশের আশায়।

আমার গ্রামের যদি এমন করুণ অবস্থা হয় তাহলে শহরের অবস্থা তো আরো বেশি ভয়ানক। গ্রাম যদি এভাবে বৃক্ষ শূন্য হতে থাকে তাহলে তার প্রভাব শহরে পড়বে না এটা তো হতে পারে না, সে প্রভাব আমরা এখন প্রত্যক্ষ করছি। চারপাশে শুধু কংক্রিটের প্রাণহীন আবদ্ধ খাঁচা, সে খাঁচায় তীব্র তাপে ছটফট করছে কোটি কোটি মানুষের ঝাঁক। কোথাও তেমন সবুজের রংতুলির আঁচড় নেই, কেবলই চারপাশে ইট-পাথরের ঝকঝকে মৃত্যুর আস্বাদন। যেখানে সবুজ নেই সেখানে মমতা, প্রণয়, স্নেহ, মানবিকতা থাকবে সেটা আমি কোনোভাবেই বিশ্বাস করি না। তাই হয়তো এ শহর এতো বেশি রুক্ষ, শুষ্ক, মরুভূমির মতো দয়াহীন, মমতাহীন শূন্যতার সাগর। চারপাশে এতো এতো মানুষের ঝাঁক, অথচ কেউ কারো নয় কেউ কারো সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলে না। কেউ কাউকে ভালোবাসে না। মানুষ হয়ে উঠেছে মানুষের ভয়ের কারণ। কেউ কারো সঙ্গে উপর্যুপরি কথা বললে অপরজন ভাবে নিশ্চিত কোনো খারাপ মতলব আছে। অথচ এমন পৃথিবী কি আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আমরা কোথায় রেখে যাবো, কাদের কাছে রেখে যাবো। এমন শুষ্ক, মমতাহীন মরুভূমির প্রান্তরে? 

বন্ধুদের মধ্যে গাছ আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু অথচ গাছগুলোকে আমরা কী অবলীলায় কেটে ফেলছি। একটি বৃক্ষ কেটে ফেলা যতোটা সহজ তা রোপণ করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা একটা আস্ত মানুষের জীবনের আয়ুকে অতিক্রম করেও সম্ভব হয় না। আমাদের অঞ্চলে এমন কিছু গাছ আছে যাদের বয়স দেড়শ থেকে দুইশ বছর। সে গাছগুলোকে কাটার জন্য অনেকভাবে বৃক্ষ রাক্ষসেরা চেষ্টা করেছে, কিন্তু গাছকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হওয়া কিছু মিথ, কিছু গল্প গাছগুলোকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে। এই বৃক্ষ রাক্ষসেরা চেষ্টা কখনোই ছাড়বে না। নানা কৌশল অবলম্বন করে তারা গাছগুলোকে ভক্ষণ করতে মরিয়া হয়ে আছে এবং হয়তো ভক্ষণ করেও ফেলবে।

আমরা যদি এখনো গাছের ব্যাপারে সচেতন না হই তাহলে সাহারা মরুভূমির উত্তপ্তের তীব্র আঁচ আমাদের গায়ে লাগতে খুব বেশি সময় লাগবে না, যা ইতোমধ্যে কিছুটা হলেও আমরা অনুভব করছি। আমাদের এই অস্তিত্ব সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হতে হতে আমরা ছাইয়ের স্তূপে পরিণত হয়ে যাবো হয়তো খুব দ্রুতই। যার জন্য আমাদের যথার্থ পদক্ষেপ এখনই গ্রহণ করার সর্বোত্তম সময়। তা না হলে আমাদের এই অপসিদ্ধান্তের খেসারত হিসেবে ভয়ানক পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
পৃথিবীর সব অঞ্চলে নতুন নতুন সিস্টেম চালু করে বৃক্ষ রোপণসহ সবুজায়নের দিকে বিশেষ মনযোগ দেয়া হচ্ছে। আর আমরা আমাদের সবচেয়ে উপকারী বন্ধু গাছকে নিধন করতে সর্বদা ব্যস্ত। আমাদের এই অপরাধের শাস্তিই হচ্ছে এই তীব্র তাপপ্রবাহ ও এই উচ্চ তাপমাত্রা বৃদ্ধি।

এখন তাপমাত্রা ৪২-৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যদি এখনো আমরা সচেতন না হই তাহলে এই তাপমাত্রা আগামী ১০ বছরে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছাবে, যেটা অনেক বেশি সংকটময় মুহূর্ত হবে। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, গাছ আছে বলেই আমরা আছি, যেদিন তারা আমাদের মাঝ থেকে নিশ্চিহ্ন হবে সেদিন আমরাও বিলুপ্ত হয়ে যাবো। আমাদের টিকে থাকাটা সম্পূর্ণভাবেই গাছেদের টিকে থাকার ওপর নির্ভর করছে। 

গাছগুলো আজ বড্ড অভিমানে মুখ ফিরিয়েছে আমাদের থেকে। অনেক বেশি অপ্রয়োজনীয় নির্যাতন করেছি ওপর। তাদের সেই কষ্টের অশ্রু আজ তীব্র দাবদাহের ন্যায় ঝরে পড়ছে পৃথিবীর বুকে। যদি তাদের এ ক্ষতের এবং কষ্টের দাগ মুছে দিতে না পারি তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম খুব দ্রুতই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। একমাত্র গাছই পারে এই ভবিষ্যৎ সংকট থেকে আমাদের রক্ষা করতে। যতো বেশি গাছ রোপণ করা হবে ততো বেশি শীতলতায় পরিপূর্ণ হবে আমাদের জীবন। 

তাদের এ কষ্ট দূর করার একমাত্র উপায় হচ্ছে বেশি বেশি গাছ রোপণ করা। এই উচ্চ তাপমাত্রা কে রুখে দেয়ার জন্য আমাদের সকলের প্রচুর পরিমাণে গাছ রোপণ করতে হবে। গাছ রোপণ ছাড়া টিকে থাকার কোনো বিকল্প নাই। একটা মানুষের অক্সিজেনের প্রতিদানের বিপরীতে কমপক্ষে ৫০-১০০টি করে গাছ লাগানো উচিত। এই গাছই হচ্ছে আমাদের পৃথিবীর প্রথম ফুসফুস ও আমাদের ফুসফুসের জ্বালানি। তাই আসুন আমরা গাছ কাটা থেকে বিরত থাকি এবং যেখানে যতোটুকু ফাঁকা জায়গা আছে সেখানে বৃক্ষ রোপণ করি। সবুজ ও মানুষ একে অপরের প্রতিপক্ষ না  হয়ে, হয়ে উঠুক একে-অপরের প্রাণের বন্ধু ও প্রাণের স্বজন। 

লেখক: লেখক ও কলামিস্ট

জনপ্রিয়