লেখকদের জীবন ও সংগ্রাম প্রচণ্ড আশাবাদের ও স্বপ্নমাখা হয়৷ স্বপ্ন দেখতে না পারলে লেখক হওয়া যায় না৷ তারা স্বপ্ন দেখেন সবুজ এক পৃথিবীর, চারপাশ রঙিন প্রজাপতিতে ঘেরা৷ কোনো অনাচার থাকবে না, ঝগড়া থাকবে না, বিবাদ থাকবে না। তরুণের হৃদয় হবে কোমল, তরুণীরা হবে প্রাণোচ্ছল ও রিনিঝিনি হাসিময়। পরিবর্তনের স্বপ্নও একজন লেখক দেখেন৷ লেখকের সবচেয়ে বড়গুণ হচ্ছে, স্বপ্ন দেখার অসীম ধৈর্য্য ও সেই আশায় লাগামহীন অপেক্ষা।
এমনই একজন লেখক তার পান্ডুলিপি নিয়ে গেলেন প্রকাশকের কাছে। তিনি বই ছাপাতে চান।
প্রকাশক বললেন, এ কী! এই পাণ্ডুলিপি তো আমি তিন বছর আগেই বাতিল করে দিয়েছিলাম।
লেখক: জ্বী, দিয়েছিলেন।
প্রকাশক: তা হলে আবার নিয়ে এসেছেন যে!
লেখক: ভাবলাম তিন বছরে আপনার বুদ্ধিশুদ্ধির কিছুটা উন্নতিও তো ঘটে থাকতে পারে।
এই বলে লেখক কাচুমাচু চোখে তাকালেন। এটা নিতান্তই একটি কৌতুক বা এটি একটি নিষ্ঠুর সত্য ঘটনা হতে পারে৷ কেনোনা প্রায় লেখকের জীবনে এমন ঘটনা ঘটে। তারা অনেকেই হয়তো সামনাসামনি কৌতুকের পাঞ্চলাইনটি বলতে গিয়েও বলতে পারেন না বা বলেন না। কারণ, একজন লেখক নরম মনের হন। বিপরীতে প্রকাশক রূঢ়ই হন। কারণ, তাদের বাণিজ্য বুঝতে হয়৷
তরুণ কবি পান্ডুলিপি এনে বললেন, কিছু দুর্দান্ত কবিতা লিখে এনেছি, একটা বই যদি প্রকাশ করতেন।
প্রকাশক বললেন, বিয়ে করেছেন?
না।
বিয়ে করে তারপর আসেন।
কেনো। বিয়ে করতে হবে কেনো?
আপনার বইয়ের অন্তত একজন পাঠক তো চাই।
প্রকাশকদেরও কাছে এমন হাজারো স্বপ্নবাজ তরুণ আসেন যারা ভাবেন তাদের একেকটি লেখা বিশ্বজয়ী হয়েছে৷ তাদের সাহিত্য কালোত্তীর্ণ হবে, মানোত্তীর্ণ তো বটেই।
একযুগে প্রকাশক প্রত্যাখান করে দিলে লেখক হতাশ হতেন। এখন অবশ্যি প্রকাশক ‘রিজেক্ট’ করলেও সমস্যা নেই৷ কারণ, বই ছাপানো সহজ৷ শুধু বইমেলা উপলক্ষে হাজার হাজার বিজ্ঞাপন দেখা যায়, যেখানে একদল মানুষ সুলভে বই ছাপাতে সাহায্য করেন। শুধু তাই নয়, এখন বই লিখে দেয়ার লোকও আছে! গল্প, উপন্যাস, কবিতাও ভাড়া লেখা হয় এখন! বিনিময়ে শুধু টাকা দিতে হবে। টাকাওয়ালার দরকার ‘সৃষ্টিশীল’ খেতাবের, সৃষ্টিশীল লেখকের দরকার টাকার! এ দুই চাহিদার দ্বন্দে প্রতিভা ও টাকার মধ্যে বিনিময় প্রথা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কে মেতে উঠেছে। টাকা দিয়ে অনেকে প্রতিভা কেনেন। টাকা থাকলে লেখকের নাম ছাপিয়ে খ্যাতিমান হতে চেষ্টা করেন। এবারের গল্পটা নির্দোষ, কিন্তু নাম বিভ্রাটের৷
এক ব্যক্তি গেলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হেমিংওয়ে ভবন পরিদর্শনে। তিনি ভেবেছেন লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ের নামে হবে হয়তো৷ কিন্তু তেমন কিছুই না৷ বিস্তারিত পরিচয়ে দেখলেন এই ভদ্রলোকের নাম যশোহা হেমিংওয়ে।
তিনি একজনকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা এই হেমিংওয়ে কি একজন লেখক?
- জ্বী লেখকও বলা যায় তাকে।
- বাহ, বেশ তো! তা তিনি কী লিখেছেন?
ভদ্রলোক বললেন, তিনি হেমিংওয়ে ভবনের চেক লিখেছেন!
এটা পুরনো জোকস! হেমিংওয়ে একজন ‘রাইটার’ বলেই গল্পটা এখানে বলা গেলো।
রাইটার শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ কেরানিও৷ বঙ্কিম-শরৎ যুগে যিনি গদ্য লিখতেন বা যিনি দলিল লিখতেন দুটোকেই ইংরেজরা ‘রাইটার’ হিসেবে সম্বোধন করতেন। রাবিন্দ্রিক শহর কলকাতায় ‘রাইটার্স বিল্ডিং’ নামে যে ভবনে মমতা চট্টোপধ্যায় বসেন তা লেখকদের সম্মানে করা হয়েছে বলে এ যুগে অনেকে ভুল করেন। মূলত ঊনিশটি কেরানি পরিবারের বসবাসের জন্য ইংরেজরা এই ভবন বানিয়েছিলো। সেই থেকে এর নাম রাইটার্স বিল্ডিং, বাংলায় যার নাম হতো কেরানি ঘর। লেখকের সঙ্গে এর সম্বন্ধ নেই।
লেখকরা আর যাই হউন কেরানি হতে চাননা। তারা নিজের মতো করে থাকতে চান। বাঁচতে চান৷ সৃষ্টিশীলতা পছন্দ করেন। সীমার মাঝে অসীমকে খোঁজেন। পাথরে ফুল সঞ্চার করতে চান। একজন লেখক ভাবলেন, গল্প লেখা অনেক তো হলো, এবার তিনি একটি পাখিকে কথা বলা শেখাবেন। তিনি জন্মদিনে একটি কথা-বলা তোতাপাখি উপহার পান। কিন্ত পাখিটির শব্দভান্ডার ছিলো অশ্লীল ও মেজাজ ছিলো খুব কড়া।
লেখক তোতাপাখির আচরণ পরিবর্তন করার জন্য কঠোর চেষ্টা করেন: তিনি সুন্দর শব্দে কথা বলেন, গুনগুন করে গান শোনান। কিন্তু কিছুতেই কিছু কাজ করে না। তিনি পাখিকে ধমক দিলে, পাখি আরো উচ্চশব্দে চিৎকার করে। খাঁচায় ঝাঁকুনি দিয়ে শাসালে পাখিটি আরো রেগে যায়। চরম বিরক্ত হয়ে একদিন তিনি তোতাটিকে ফ্রিজে ঢুকিয়ে আটকে রাখলেন। কয়েক মুহূর্ত পরে লেখক ভয় পেয়েছেন, পাখিটি না মরেই গেলো। দ্রুত ফ্রিজের দরজা খুলে দিলেন।
তোতা শান্তভাবে বেরিয়ে এসে বললো, স্যার, আমি খুব লজ্জিত। আমি অশ্লীল গালি গালাজ করি। আর করবো না৷ আপনাকে বিরক্ত করি, আর করবো না৷ আমি নিজেও ভেবেছি, আমার নিজেকে সংশোধন করা উচিত। আমি সত্যিই দুঃখিত। আমি ক্ষমা চাচ্ছি।
পাখির মনোভাবের নাটকীয় পরিবর্তনে লেখক বিস্মিত! কিন্তু কিছু বলার আগেই তোতাপাখি বলে উঠল, কিন্তু স্যার একটি জিনিস মাথায় ঢুকছে না, মুরগিটা কী এতো বড় অপরাধ করেছিলো?
এ গল্পটা বুঝতে আমার অনেক সময় লেগেছিলো। আপনাদের নিশ্চয়ই বেশি সময় লাগার কথা নয়। আবার এই গল্পটি ঠিক লেখকেরও নয়, বরং তোতাপাখিরইও বেশি। বইমেলার মাস, তাই লেখকদের গল্প বলতে চাচ্ছিলাম।
লেখকদের এখন নিজস্ব গল্প হয় না। তারা নিজেদের গল্প বলেনও না। একসময় সমসাময়িক লেখকদের খুনসুটি আর বুদ্ধির খেলা নিয়ে টুকরো গল্প লেখা হতো বেশ। এখন লেখকরা বোধহয় নিজেদের মধ্যেও রসরসিকতা বা খুনসুটি করেন না৷ অনলাইনে লেখকের পেজ মানে জ্বালাময়ী পোস্টের সম্ভার অথবা দুঃখে লীন হওয়ার গল্প। জীবনানন্দ বা সুকান্তের কাব্যময় দুঃখ নয়৷ ব্যক্তিগত বিশুদ্ধ দুঃখ। পাবলিক কেনো বই পড়ে না এই দুঃখ, মেলায় কেনো ষাটোর্ধ্ব পৌঢ় ষোড়শী স্ত্রীকে নিয়ে গল্প লিখবে সেই দুঃখ, অন্য কবি কেনো নারী সঙ্গতে ব্যাকুল সেই দুঃখ, কে কেনো কোন পুরস্কার পাওয়া উচিত নয় সেই দুঃখ। দুঃখের মাঝে একটি দুঃখের গল্প বলা যাক।
বিদেশে এক বই মেলায় তিন লেখক হোটেল রুমে ফিরছিলেন। যাবেন একটি হোটেলের ত্রিশ তলায়। লিফট বন্ধ। সিদ্ধান্ত নিলেন তারা একে অপরের গল্প শুনতে শুনতে হেঁটে উপরে উঠে যাবেন। প্রথম দশ তলা রোমান্টিক গল্পকার তার একটি প্রেমের গল্প শোনাবেন। পরের দশতলায় আরেক জন্য রম্য গল্প শোনাবেন। শেষ দশতলায় তৃতীয় লেখকের দুঃখের গল্প শুনতে শুনতে উপরে উঠবেন। মার্ক নামেই লেখক স্যাডিস্ট গল্প লিখে ব্যাপক নাম করেছেন।
পরিকল্পনা মতো প্রথম দশতলা প্রেমের গল্প শুনলো। পরের দশ তলা রম্য গল্প শুনতে শুনতে কুড়ি তলায় পৌঁছে গেলো। এবার তৃতীয় লেখকের পালা। তিনি বললেন, আমি একজন স্যাডিস্ট লেখকের দুঃখের গল্প বলবো। লেখকের নাম মার্ক। মার্ক হেঁটে হেঁটে একটি ভবনের কুড়ি তলায় উঠার পর খেয়াল করলেন তার হোটেল রুমের চাবি গাড়িতে রেখে এসেছেন।
মার্ক বলল, আমার গল্প শেষ।
বাকী দুই লেখক গভীর বেদনায় ডুবে গেলেন।
সিঁড়ি দিয়ে চাবির জন্য নামতে নামতে তারা মুগ্ধও হলেন। এভাবেও দুঃখের গল্প হয়! হয় বটে, লেখকরা নানাভাবে আবেগে ভাসাতে পারেন।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট