ঢাকা শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪ , ১১ শ্রাবণ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

nogod
nogod
bkash
bkash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
nogod
nogod
bkash
bkash

মিয়ানমারে সহিংসতার অবসান কতোদূর

মতামত

ব্রি. জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন (অব.)

প্রকাশিত: ২২:৪৯, ১ মার্চ ২০২৪

সর্বশেষ

মিয়ানমারে সহিংসতার অবসান কতোদূর

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে চলমান সংঘর্ষের ফলে সেনাবাহিনী সীমান্ত অঞ্চলের রাজ্যগুলোতে তাদের আধিপত্য হারাচ্ছে। সেনাবাহিনীর মনোবল নিম্নমুখী এবং তারা জনবল সংকটে ভুগছে। চলমান পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর প্রতি জনসমর্থন কমছে এবং বিভিন্ন অঞ্চলে সেনাবাহিনী ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর বিদ্রোহী বাহিনীর (ইএও) কাছে আত্মসমর্পণ করছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী প্রায় ৭০ বছর ধরে ইএওর বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে। এই দীর্ঘ সময়ে তারা নানা ধরনের কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে ইএও’গুলোর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে কিংবা কারো কারো সঙ্গে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে অন্যদের ওপর দমন পীড়ন চালিয়ে আসছিলো। 

২০২০ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে এনএলডি প্রার্থী রাখাইনে বিজয়ী হতে ব্যর্থ হয় এবং রাখাইনে ইউনাইটেড লীগ অব আরাকানের (ইউএলএ) প্রার্থীরা বিজয়ী হয়। এই দলের সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মি (এএ) রাখাইন রাজ্যের স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংগ্রাম করে চলছে। ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির (এন এল ডি) শাসনামলে এএকে  সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বর্তমানে এএ মিয়ানমারের বিদ্রোহী বাহিনীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ও সংগঠিত। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে রোহিঙ্গাদেরকে নির্যাতনের মাধ্যমে রাখাইন ছাড়া করার আগেও দীর্ঘ সময় ধরে কট্টর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সংগঠন মাবাথা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক প্রোপাগান্ডা চালায়। এসব অপপ্রচার বামারদের পাশাপাশি রাখাইনরাও এক সময় বিশ্বাস করা শুরু করে, রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাদের বৈরি সম্পর্কের সুচনা হয় এবং আস্তে আস্তে তা ঘৃণায় রূপ নেয়। পরবর্তীকালে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত নির্মম সহিংসতায় জান্তা বাহিনীর সঙ্গে রাখাইনরাও রোহিঙ্গা নিধনে অংশগ্রহণ করে। রাখাইন থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়নের পর কিছুদিন সেখানকার পরিস্থিতি শান্ত থাকলেও আবার মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে এএ’র তীব্র সংঘর্ষ শুরু হয়। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বরে এ এ মিয়ামারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাময়িক অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হয়, সেই বছর নির্বাচনের সময় আরাকানে আপাত শান্তি বিরাজ করছিলো। 

২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা গ্রহণের পর সাধারণ জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়, জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ও রাস্তায় বেরিয়ে আসে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী এই বিক্ষোভ দমনে নির্যাতনের আশ্রয় নিলে এর তীব্রতা না কমে ক্রমেই তা বাড়তে থাকে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ বামার জনগোষ্ঠীর মধ্যেও তাদের গ্রহণযোগ্যতা কমতে থাকে। মিয়ানমারের প্রায় ২৪টিরও বেশি ইএও সামরিক অভ্যুত্থানের নিন্দা জানায় এবং কোনো কোনো দল অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভকারীদের প্রতিও সমর্থন জানায়। তখন এএ জান্তাবিরোধী বিক্ষোভকারীদের সমর্থন করে এবং রাখাইন রাজ্যে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ হয়নি। জান্তার ক্ষমতা দখলের পর ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ১১ মার্চ থেকে এএকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীরতালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়।

এ এ এবং জান্তা বাহিনীর সঙ্গে ফেব্রুয়ারি মাসে চলমান সংঘর্ষে জান্তা বাহিনী বিপর্যস্ত এবং বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্ত চৌকিগুলোর প্রায় সবই এ এর নিয়ন্ত্রণে। রাখাইনে এ এ’র বিপুল সমর্থন রয়েছে, ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে যেখানে তারা রাখাইনের স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই করছে। গত নভেম্বরে রাখাইনে অভিযান শুরুর পর এ এ উত্তর রাখাইনের পাঁচটি ও প্রতিবেশী চিন রাজ্যের একটি বড় শহর দখল করে ও সরকারি সেনাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিজয় অর্জন করে। সম্প্রতি বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্তে আরাকান আর্মির আক্রমণের তীব্রতায় বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যের সীমান্ত চৌকি থেকে বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) ও অন্যান্য  সংস্থার ৩৩০ জন সদস্য পালিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে বিজিবি’র কাছে আত্মসমর্পণ করে। মাঝে মাঝেই মিয়ানমারের আভ্যন্তরীণ সংঘাতের কারণে বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্ত অঞ্চলে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলেও, এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা প্রাণভয়ে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে ১৫ ফেব্রুয়ারি তাদেরকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠায়।

রাখাইন রাজ্যে এএ’র কাছে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের পর বার্মার সংখ্যাগরিষ্ঠ ইয়াঙ্গুন ও মান্দালয় শহরগুলোর রাস্তায় জাতিগত রাখাইন বিরোধী মনোভাব প্রচারকারী লিফলেট দেখা যাচ্ছে। লিফলেটগুলোতে বার্মার জনগণকে রাখাইনদের মালিকানাধীন দোকান ও রেস্তোরাঁ বয়কট এবং রাখাইন জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজ রাজ্যে ফিরে যেতে আহ্বান জানানো হয় রাখাইন সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীদের মালিকানাধীন রেস্তোরাঁ ও দোকানগুলোর ল্যাম্পপোস্ট ও সাইনবোর্ডে রাখাইনবিরোধী মনোভাব প্রচারকারী লিফলেটগুলো লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। সেখানে বলা হচ্ছে যে, সন্ত্রাসী এএ’র নিন্দা জানাতে রাখাইনের মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো যেনো বর্জন করা হয়। এসব কারণে ইয়াঙ্গুনের জাতিগত রাখাইন বাসিন্দারা নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে রয়েছে এই বিদ্বেষ ছড়ানোর পেছনে শাসকগোষ্ঠী সমর্থিত জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠীর হাত আছে বলে অনেকে মনে করে। তবে এখন পর্যন্ত এই ঘৃণামূলক প্রচারণার দায় কেউ স্বীকার করেনি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই পরিকল্পনা ব্যর্থ হবে। কারণ, জনগণ এই কূটকৌশল বুঝতে পেরেছে এবং তাদের বিভাজনের মাধ্যমে শাসনের কৌশল সম্পর্কে এবার তারা সচেতন রয়েছে চলমান প্রেক্ষাপটে জাতিগত বিভেদের বীজ বপন করার প্রচেষ্টা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, বামার জনগণের একটা অংশ সামরিক সরকারের সমর্থকদের সঙ্গে যোগ দেবে না

২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে আগস্টে মিয়ানমারে বামার ও কাচিন জনগণের মধ্যে ঘৃণা ছড়ানোর চেষ্টা চলে। সে সময় কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মির (কেআইএ) সরবরাহ করা অস্ত্র দিয়ে বামার ও কাচিনরা একে অপরকে হত্যা করছে বলে প্রচারণা চালানো হয় ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের শেষ ভাগে শান রাজ্যে ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের কাছে শোচনীয় পরাজয়ের পর জাতিগত বিভেদকে উস্কে দেয়ার চেষ্টা করা হয় শানদের মধ্যে বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য প্রচার করা হয় যে ব্রাদারহুড এলায়েন্স জান্তা লক্ষ্যবস্তুতে হামলা না চালিয়ে জাতিগত শানদের বাড়িঘর ও সম্পত্তি দখল করার জন্য আক্রমণ করছে। তবে এবার এসব প্রচারণা কাঙ্ক্ষিত ফল লাভে ব্যর্থ হয়।

২০২১ খ্রিষ্টাব্দের অভ্যুত্থানের পর থেকে জান্তার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত গণতন্ত্রপন্থিদের দুর্বল করতে ও  জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিভাজন উসকে দেয়ার ক্ষেত্রে জান্তার সক্রিয় ভুমিকা আছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন। বর্তমানে সেনাবাহিনীর জনবল সংকট কমাতে মিয়ানমার সরকার ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী সব পুরুষ ও ১৮-২৭ বছর বয়সী নারীদের অন্তত দুই বছরের জন্য সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামুলক দায়িত্ব পালনের বিষয়ে একটি আইন কার্যকর করার পরিকল্পনা নিয়েছেবিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে ১০ ফেব্রুয়ারি একটি আইন পাস করে জান্তা সরকার এই পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের অনেক তরুণ প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানা যায় জনগণের দেশত্যাগের প্রবণতা বন্ধ করতে জান্তা সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে

এএ পুরো রাখাইন রাজ্য দখল করার ঘোষণা দিয়েছে, এবং এরই মধ্যে উত্তর রাখাইনের প্রায় পুরোটাই দখল করে নিয়েছে এই পরিস্থিতিতে মংডুর রোহিঙ্গা নেতাদের সঙ্গে মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর কমান্ডাররা বৈঠক করে তাদেরকে জান্তা বাহিনীর হয়ে কাজ করার প্রস্তাব দিচ্ছে এবং এতে তারা সম্মত হলে তাদেরকে অস্ত্র দেয়া হবে বলে জানায় জান্তা প্রতিনিধি তাদেরকে জানায় যে এএ’র  কারণে রোহিঙ্গারা দুর্ভোগে আছে এজন্য তাদের এএ’র বিরুদ্ধে মিয়ানমার জান্তার পক্ষে যোগ দেয়া উচিত। তবে এই প্রস্তাবে বেশিরভাগ নেতা রাজি হননি শতাব্দীর পর শতাব্দী আরাকানে রাখাইন ও রোহিঙ্গারা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করে আসছিলো হাজার বছরের ইতিহাসে তাদের মধ্যে কোনো ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি ও জাতিগত বিদ্বেষ ছিলো না পরস্পরের উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এই দুই সম্প্রদায় আরাকানের মাটিতে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা গড়ে তুলেছিলো আরাকানের ইতিহাস মানেই রাখাইন ও রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের হাজার বছরের সৌহার্দ, সম্প্রীতি আর ভ্রাতৃত্বের ইতিহাস অন্যদিকে বার্মিজদের সঙ্গে এ দুটি সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিলো বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা ও নির্যাতনের

মিয়ানমারে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়িয়ে ও সহিংসতার মাধ্যমে মিয়ানমারের ভাঙনরোধের যে উদ্যোগ বিগত দশকগুলোতে নেয়া হয়েছে, সেগুলোর ফলশ্রুতিতে মিয়ানমারের জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিভেদ ও সহিংসতা দূর করা সম্ভব হয়নি। মিয়ানমারের ইএওগুলোর লক্ষ্য এবং আগ্রহ আলাদা বলে ঐকমত্য অর্জন করা কঠিন। মিয়ানমারের জনগণকেই ভাবতে হবে কীভাবে তারা তাদের দেশকে গড়তে চায়। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নয়, বরং সম্প্রীতি, ধার্মিকতা, ন্যায়বিচার এবং সমান সুযোগের নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেই তা দীর্ঘমেয়াদে স্থায়ী হবে বলে অনেকে মনে করে।

রাখাইনদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়ে, কাচিন ও শানদের বিরুদ্ধে বামারদের মাঝে বিভেদ ও ঘৃণা সৃষ্টি করে এবং সবশেষে আরাকানের রোহিঙ্গাদেরকে রাখাইনদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার জন্য উসকানো এবং চাপ প্রয়োগ চলমান থাকলে মিয়ানমারের অশান্ত পরিস্থিতি আরো অস্থিতিশীল ও দীর্ঘস্থায়ী হবে। শান্তির অন্বেষায় বহু দশক ধরে চলমান সংগ্রাম ও সহিংসতার অবসান ঘটিয়ে সম্প্রীতি ও সহনশীলতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে। একটা ফেডারেল কাঠামোর আওতায় শান্তিপূর্ণ ও ঐক্যবদ্ধ মিয়ানমারের স্বপ্নের বাস্তবায়ন আর কতোদূর?

লেখক: মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক

জনপ্রিয়