ঢাকা মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪ , ২৯ আশ্বিন ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

প্রসঙ্গ শিক্ষকদের জীবনযাত্রা

মতামত

উম্মে হাবিবা

প্রকাশিত: ০০:০০, ১ এপ্রিল ২০২৪

সর্বশেষ

প্রসঙ্গ শিক্ষকদের জীবনযাত্রা

ছোটবেলায় শুনেছি এবং জেনেছি শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। শিক্ষক হচ্ছেন জাতি গড়ার কারিগর। নিজে যখন শিক্ষার্থী ছিলাম তখন মনে হতো আমাদের শিক্ষকেরা কতো শক্তিশালী! মনে হতো আগের শিক্ষকেরা ইচ্ছে হলেই বকা দিতেন, বেত দিয়ে পেটাতেন, দাঁড় করিয়ে রাখতেন ইত্যাদি বহু ক্ষমতার অধিকারী। আর জ্ঞানের ভান্ডার অফুরান। 

আজ আমি শিক্ষক। পেশা সম্পর্কে জানা জিনিসগুলো অজানা মনে হয়। যখন দেখি আমি আমার যে শিক্ষকদের মহা শক্তিশালী ভাবতাম তারা এখন পেটের দায়ে কেউ কোনো মিষ্টির দোকানে কাজ করছেন, কেউ অন্যকিছু, কেউ আর্থিকভাবে খুবই খারাপ অবস্থায় আছেন। আমরাই বা কতোটুকু মানসম্মত জীবনযাপন করছি?

আমি ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে যোগদান করেছি। ২০২১ খ্রিষ্টাব্দে সিনিয়র শিক্ষক পদে আমার পদোন্নতি হয়েছে। কিন্তু এই পদোন্নতি আমার জীবনযাত্রায় কি কোনো পরিবর্তন এনেছে? আমি প্রায় ২০ বছরের কাছাকাছি সময়ে একটি টাইমস্কেলও পাইনি! আমি শিক্ষক হিসেবে যেখানে বসি সেটা একটা গোলটেবিল, ডাইনিং টেবিলের মতোই। একবার বসে উঠে গেলে আর চেয়ার আমার না। আমাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রাখার জন্য ছোট্ট একটা ড্রয়ার থাকে। এই পর্যন্তই আমাদের প্রাপ্তি। অন্যান্য যেসব যোগ্যতা বা দক্ষতা সেটি আমাদের নিজেদের প্রচেষ্টায় অর্জন করতে হয়। 

আমাদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করার চিন্তা মানে মহাবিপদ! বিএড ডিগ্রি অর্জন ছাড়া কোনো শিক্ষা ছুটি পাওয়া যায় না। এমএড ডিগ্রির জন্য ছুটি পাওয়া আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন। তারপরেও আমরা শিক্ষকেরা প্রচুর টাকা, অতিরিক্ত পরিশ্রম করে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করি। আমাদের যোগ্যতা বা দক্ষতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু আমাদের যোগ্যতা বা দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কি উন্মুক্ত সুযোগ আছে? আমাদের যা দক্ষতা তা আমাদের নিজেদের বহু কষ্টের অর্জন। 

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য ছুটি পান, গবেষণার সুযোগ পান। কিন্তু আমরা? আমরা নাকি শিক্ষার মূল ভিত্তি তৈরি করি! তাহলে আমাদের ভিত্তি কোথায়? না আমাদের বেতন বাড়ানো হচ্ছে আর না আমাদের পদোন্নতি হচ্ছে। টাইমস্কেল না পাওয়ার কারণে আমি কম বেতন পাচ্ছি। তারপরেও আমরা শিক্ষক। আমরা কিন্তু আমাদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।

আমদের পদোন্নতি অনেকটা স্বপ্ন। যাদের পদোন্নতি হয় তাদের চাকুরির বয়স থাকে খুবই অল্পদিন। একজন শিক্ষকের হাতে ১০-১২ বছর থাকলে পদোন্নতি পেয়ে তিনি একটি প্রতিষ্ঠানকে সাজাতে পারেন। ১-২ বছর কিংবা কয়েকমাসে তিনি পরিকল্পনা করতেই করতেই অবসরে চলে যান। কতো শিক্ষক মনে কষ্ট নিয়েই অবসরে চলে যান। কতো চোখের পানি, না পাওয়ার যন্ত্রণা! 

না, আমি কোনো প্রতিবাদ জানাচ্ছি না। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি আমাদের মাধ্যমিক স্তরকে গড়ে তোলার আহ্বান জানাচ্ছি। শিক্ষক যদি আর্থিক, সামাজিকভাবে সচ্ছল না হন, যদি যথাযথ মর্যাদা না পান তাহলে তিনি মানসিকভাবে এমনিতেই দুর্বল হয়ে যান। কীভাবে তিনি পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাবেন?

এখন শিক্ষককেও প্রতিদিন বাজারে যেতে হয়, তার সন্তানকে স্কুলে পড়াতে হয়, চিকিৎসার পেছনে টাকা খরচ করতে হয়। বাসাভাড়া দিতে হয়, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল দিতে হয়। তাই হয়তো বাধ্য হয়েই জীবনের প্রয়োজনে শিক্ষক প্রাইভেট পড়ান, কোচিং করান। শিক্ষকদের ওপর যখন যে দায়িত্ব দেয়া হয়, প্রজ্ঞাপন জারি হয় তখন আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করি অর্পিত দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে। 

আমি কোনো আন্দোলনের পক্ষে নই বা বিরূপ মন্তব্য করতে চাই না। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি চাই আমাদের শিক্ষকদের মানসম্মত বেতন প্রদানের ব্যবস্থা করা হোক। আমাদের পদোন্নতির ব্যবস্থা করে আমাদের কাজ করার সুযোগ দেয়া হোক। আমাদের থাকার জায়গা থাকুক। আমাদের প্রাপ্য টাইমস্কেল আমাদের দেয়া হোক।

আমরা স্বেচ্ছায় শিক্ষকতা পেশায় এসেছি। আমরা আমাদের দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ চাই। আমরা আমাদের পদোন্নতি চাই। অন্তত চাকরির ১২ বছর হলেই পদোন্নতি প্রয়োজন। শিক্ষক মানে শুধু ক্লাস নেয়া না, শিক্ষক মানে সম্মান ও মর্যাদা প্রাপ্তিও। একজন শিক্ষককে যোগ্য সম্মান দিলে তিনি মানসিকভাবে শক্তিশালী হয়ে আরো কাজ করার তাগিদ অনুভব করেন।

আমরা নতুনকে গ্রহণ করতে, চ্যালেঞ্জ নিতে পারি। আমরাই পারি। আমাদের শিক্ষকদের দ্বারাই সকল কাজ বাস্তবায়ন হয়। আমাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হলে আমাদের কাজের ক্ষেত্রে সফলতা ১০০ ভাগ। আমি বলছি না যে আমার জীবনের মানোন্নয়নে আমার বেতন বাড়ানো না হলে আমি কাজ করবো না কিংবা পদোন্নতি না হলে আমি চুপচাপ বসে থাকবো। আমি যেহেতু শিক্ষক তাই আমার ওপর যখন যে দায়িত্ব অর্পণ করা হবে আমি সেটিই পালন করবো। আমি দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য।

কিন্তু ভেবে দেখার বিষয়, আমাদের শিক্ষকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন প্রয়োজন কি না। শিক্ষকের কণ্ঠই তার সম্পদ। যদি তিনি জীবনের অন্যান্য প্রয়োজনের ভারে নুয়ে পড়েন তখন তার কণ্ঠস্বরও অকেজো হয়ে যেতে থাকে। শিক্ষাব্যবস্থায় মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের নিয়ে একটু ভাবুন। শিক্ষকদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন না হলে তাদের দক্ষতা কতোটা বৃদ্ধি পাবে এটা ভাবার বিষয়। 

লেখক: সিনিয়র শিক্ষক, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুল, ঢাকা

জনপ্রিয়