ব্রিটিশ আইন অনুসরন করে পুলিশ এখনো সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে তারই ঢাল হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে বাহিনীটি। এই ঢাল হতে গিয়ে পুলিশ কতটা নিষ্ঠুরতম বাহিনীতে পরিণত হয়েছে- সেটির সবচেয়ে বড় প্রমাণ গণঅভ্যুত্থানের সময় পুলিশের নির্বিচারে গুলি ও লাশ পুড়িয়ে দেয়ার মতো ঘটনা দেখলেই বোঝা যায়।
কিন্তু ক্ষমতার পটপরিবর্তনে বর্তমানে সময় এসেছে রাষ্ট্র সংস্কারের সঙ্গে পুলিশ সংস্কার করে মানবিক বাহিনী করার। এজন্য সবার আগে পুলিশ বদলে নাম ‘নিরাপত্তা সেবা বাহিনী’ করতে হবে। কারণ পুলিশ শব্দের মধ্যেই মানুষ ভীতি খুঁজবে। পাশাপাশি পুলিশের পোশাক পরিবর্তন, নিয়োগে বদল আনা, প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো, বর্তমানে যেসব পুলিশ রয়েছে তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, ওসি নিয়োগে আলাদা প্রশিক্ষণ চালু করা, দলীয় বিবেচনায় পদোন্নতি ও পদক দেয়ার পরিবর্তে জনসমর্থনে জোর দেয়া, স্ট্রাইকিং ফোর্সের অপারেশনের সময় ক্যামেরা সংযুক্ত করাসহ বিভিন্ন প্রস্তাব করা হয়েছে।
মঙ্গলবার (১ অক্টোবর) বিকেলে জাতীয় প্রেসক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষায় পুলিশি ব্যবস্থার সংস্কার’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসব প্রস্তাব করা হয়। ‘রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন’ এই আলোচনা সভার আয়োজন করে।
আয়োজক সংগঠনের অর্থ বিষয়ক সমন্বয়ক দিদারুল ইসলামের উপস্থাপনায় উক্ত সভায় বক্তব্য রাখেন- পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ূম, মানবাধিকারকর্মী সিআর আবরার, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ নিজার, আলাপনের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ওয়ালিউল্লাহ বাশার, আইন গবেষক রাশেদ রাহম, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান প্রমুখ।
সভায় গণঅভ্যুত্থানের সময় শহীদ হওয়া কয়েকজনের পরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত ছিলেন। গণঅভ্যুত্থানের সময় শহীদদের স্মরণে একমিনিট নীরবতাও পালন করা হয়।
সভার শুরুতে পুলিশ সংস্কারে প্রস্তাবনা তুলে ধরেন উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক সামজীর আহমেদ। প্রস্তাবনায় বলা হয়, বাংলাদেশ পুলিশ এখন আতঙ্কের নাম হয়ে গেছে। নামের পরিবর্তন জরুরি। এমন নাম হতে হবে যাতে সেবক বোঝায়। সেক্ষেত্রে নিরাপত্তা সেবা বাহিনী নাম হতে পারে। পোশাক পরিবর্তন করতে হবে। পুলিশে ৫২ শতাংশ কনস্টেবলসহ ৭০ শতাংশ সদস্য মামলা জিডিসহ পুলিশিং কাজে কোনো অবদান রাখে না। তাদের একটাই কাজ অর্ডার মানা। এই বড় সংখ্যক পুলিশকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পুলিশিং কার্যক্রমে নিয়ে আসতে হবে। কনস্টেবল নিয়োগ বাতিল করতে হবে। আমেরিকাতে কোনো কনস্টেবল নিয়োগ হয় না। পদোন্নতি ও পদকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। কমিউনিটি পুলিশিংয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। পুলিশ হেফাজতে নির্যাতন কমাতে ‘কেন্দ্রীয় তদন্ত সেল’ গঠন করতে হবে। পুলিশের কর্মঘন্টা কমিয়ে একটি সহনীয় পর্যায়ে নিতে হবে।
পুলিশের সাবেক আইজিপি ড. এনামুল হকের কয়েকটি সুপারিশ সভায় তুলে ধরেন এডভোকেট আবেদা। সুপারিশে বলা হয়, গ্রেফতারের ২৪ ঘন্টার মধ্যে আদালতে তোলা না হলে শাস্তির বিধান করতে হবে, ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে আইন ও পিআরবি’র (পুলিশ রেগুলেশন অব বেঙ্গল) অসঙ্গতি দূর করতে হবে। এছাড়াও পুলিশের চাঁদাবাজি দূর করতে ভ্রাম্যমান আদালত বন্ধ, পুলিশের ব্যবহৃত প্রতিটি গুলির হিসাব স্বচ্ছ করা ও জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে ফাঁড়ি বাড়াতে হবে।
ঢাবির অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলাম বলেন, পুলিশ কর্মকর্তাদের নিজেরই গানম্যান প্রয়োজন হয়। যে নিজের সুরক্ষা নিজে দিতে পারে না, সে অন্যের সুরক্ষা কিভাবে দিবে? এ জায়গায় পরিবর্তন করা উচিত।
পুলিশের সাবেক ডিআইজি খান সাঈদ হাসান বলেন, ক্ষমতায় আসার আগে ক্ষমতাসীনরা পুলিশ সংস্কারের অনেক আশ্বাস দেন। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলের পরেও ক্ষমতাধরদের চিন্তা আগের ক্ষমতাধরদের মতোই থেকে যায়। যার কারণে পুলিশের কোনো সংস্কার হয় না। এই ক্ষমতাশীলরা না চাইলে পুলিশের সংস্কার সহজে হবে না।