
আজ ৩১ মে। ‘বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস’। বাংলাদেশেও প্রতিবছর নানা সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিবসটি পালন হয়ে থাকে। তামাক দ্বারা তৈরি সব ধরনের পণ্য পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তামাক পণ্য বলতে সব ধরনের সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, গুল, তামাক পাতা, তামাক ডাঁটাসহ তামাক সংশ্লিষ্ট যেকোনো পণ্যকে বোঝায়।
যেহেতু তামাকপণ্য দেশজুড়ে ছেয়ে গেছে সেহেতু এসব পণ্যের ওপর মাত্রাতিরিক্ত কর বাড়িয়ে এর ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা দরকার। তামাকের সব ধরনের পণ্য স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর জেনেও তরুণ সমাজ থেকে শুরু করে সব ধরনের মানুষ এটি সেবন করে। একজনের তামাক সেবন অন্যের জন্যও ক্ষতির কারণ হচ্ছে। তামাক পণ্য সেবনে শরীরে বিভিন্ন ধরনের রোগ বাসা বাধে।
হাস্যকর হলেও সত্য, সেসব রোগ নিরাময়ে আবার সরকারকে স্বাস্থ্য খাতে বিশেষ বরাদ্দ রাখতে হয়। তাই তামাক পণ্য উৎপাদন ও ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ করা গেলে সেটা দেশ ও দশের জন্য ভালো হবে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট আসছে।
ক্ষতিকর তামাক পণ্যের ওপর জনগণকে নিরুৎসাহিত করতে আসন্ন বাজেটে এসব পণ্যে মাত্রাতিরিক্ত কর বাড়ানো দরকার। তামাকজাত পণ্য ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কোম্পানিগুলো তামাক উৎপাদনে কৃষকদেরকে ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করে থাকে। কৃষকরাও ভালো লাভ পেয়ে ধান, পাট ও সবজি চাষ না করে তামাক চাষ করছেন।
‘ডব্লিউএইচও’র (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা) ‘টোব্যাকো: থ্রেট টু আওয়ার এনভায়রনমেন্টে’র সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে দেড় কোটি প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ধূমপায়ী সিগারেট ব্যবহার করেন, বিড়ি ব্যবহার করেন ৫৩ লাখ মানুষ।
আর ২ কোটি ২০ লাখের মতো মানুষ ধোঁয়াবিহীন তামাক সেবন করেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বাংলাদেশে প্রতিদিন ১২ কোটির বেশি সিগারেট ব্যবহার করা হয়। সামগ্রিক হিসাব বিবেচনায় সিগারেট-বিড়ি মিলিয়ে মোট ১৯ কোটির বেশি অর্থাৎ সমপরিমাণ অবশিষ্টাংশ (সিগারেট-বিড়ির যে অংশ ফেলে দেয়া হয়) প্রকৃতিতে মিশছে।
সিগারেট-বিড়ির এই অবশিষ্টাংশ মাটি-পানির জন্য খুবই ক্ষতিকর। এগুলো ক্ষুদ্র অণুজীব নষ্ট করে ফেলে। তামাক চাষ পরিবেশ দূষণ, মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট, জনস্বাস্থ্য ও খাদ্যনিরাপত্তায় ঝুঁকিসহ সর্বোপরি দেশের উন্নয়নের পথে বাধাস্বরূপ। তামাক চাষের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি ধীরে ধীরে কমে যায়। পরবর্তীতে ওই ফসলি জমিতে অন্য ফসলের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়।
এভাবে ধীরে ধীরে খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি তৈরি হয়। তামাক চাষে জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হওয়াসহ তামাকচাষীদেরও স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা তৈরি হয়। একইভাবে তামাক পাতার ঝাঁজ শিশু ও বৃদ্ধদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়। চিকিৎসকদের মতে, ধূমপান তথা তামাক সেবনের কারণে হাঁপানি, শ্বাসকষ্টসহ ফুসফুসের ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে।
তামাক সেবনের কারণে অগ্ন্যাশয়, কিডনি, স্বরনালি ও খাদ্যনালি ব্যাপকভবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। এ ছাড়া তামাক সেবনে দেহে স্ট্রোক, যক্ষ্মা, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, হৃদরোগসহ নানা রোগ বাসা বাধে। এক তথ্য মতে, ধূমপান ও ধোঁয়াবিহীন তামাক যেমন; জর্দা, গুল, সাদাপাতা ইত্যাদি সেবনের কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় ৫৭ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
‘তামাক’ ছোট্ট একটি শব্দ হলেও এর ক্ষতিকর প্রভাব ব্যাপক। শুধু প্রাপ্তবয়স্করা নন, শিশু-কিশোররাও পরোক্ষভাবে তামাকের সংস্পর্শে আসছে। ঘরে এবং ঘরের বাইরে শিশুরা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে। এই তামাক সেবনকারীদের বেশিরভাগই জানে না যে, প্রকাশ্যে ধূমপান করা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ। অনেক পরিবারে পুরুষ সদস্য ঘরের মধ্যেও ধূমপান করেন।
তারা জেনে-বুঝে হোক আর অজান্তেই হোক, পরিবারের শিশুসহ অন্যান্যদের ক্ষতি করছে। শহরের শিশুরা পরোক্ষ ধূমপানে শিকার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। রাস্তা-ঘাটে, যানবাহনে, দোকানে, ঘরের মধ্যে শিশু-কিশোররা ধূমপানের শিক্ষার হচ্ছে। ‘সেকেন্ডহ্যান্ড স্মোক এক্সপোজার ইন প্রাইমারি স্কুল চিলড্রেন: আ সার্ভে ইন ঢাকা, বাংলাদেশ’ শিরোনামে এক গবেষণাপত্রে বলা হয়, রাজধানী ঢাকা শহরের ৯৫ ভাগ শিশুর শরীরে নিকোটিনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
নিকোটিনের উপস্থিতির প্রধান কারণ পরোক্ষ ধূমপান। এই গবেষণা পরিচালনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ইয়র্ক, ইউনিভার্সিটি অব এডিনবার্গ এবং লিডস সিটি কাউন্সিলের জনস্বাস্থ্য বিভাগ। গবেষণাপত্রে আরো বলা হয়, ৪৩ ভাগ শিশু জানিয়েছে তাদের পরিবারে কমপক্ষে একজন ধূমপানের সঙ্গে জড়িত। ৮৭ শতাংশ শিশু বলেছে, তারা জনসমাগম স্থানে অন্যের ধূমপানের শিকার হয়েছে।
নিকোটিনের আরেক নাম বিষ। এই বিষ খুব ছোটবেলা থেকে শিশুর শরীর ধারাবাহিকভাবে গ্রহণ করতে থাকলে একসময় তার পরিমাণ ভয়াবহ হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। ধূমপায়ী ব্যক্তি শুধু নিজের ক্ষতি করছেন না, ক্ষতি করছেন আশপাশের শিশু ও অন্যান্য অধূমপায়ী ব্যক্তিদের।
ঘরের মধ্যে ধূমপানের ধোঁয়ার কারণে শিশুর তো ক্ষতি হচ্ছেই। তা ছাড়া সিগারেট, বিড়ির সূক্ষ্ম ছাই ঘরে থাকা আসবাবপত্র ও জামাকাপড়ে জমা হচ্ছে। শিশুরা কোনো না কোনোভাবে এসব জিনিসপত্রের সংস্পর্শে আসছে। শিশুদের হাত থেকে মুখে প্রবেশ করে এসব ছাই। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, সিগারেট, বিড়ির ছাইয়ের মধ্যে প্রায় ২৫০ ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক থাকে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে নিকোটিন, ফর্ম্যালডিহাইড, ন্যাপথালিন ও ক্যানসার তৈরির বিভিন্ন উপাদান।
পুরো বিশ্বে প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হলেও বাংলাদেশে শহরাঞ্চলে এই হার প্রায় দ্বিগুণ। এর কারণ হলো বাংলাদেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা বেশি। এ ছাড়া রয়েছে অসচেতনতা ও বিদ্যমান তামাক আইন প্রয়োগে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনীহা। তামাক থেকে দূরে থাকার অধিকার শিশুদের অবশ্যই রয়েছে। তবে সে অধিকারটুকু শিশুরা পাচ্ছে তো?
পরিবারের যে আপনজন ঘরের মধ্যে ধূমপান করছেন তিনি কী ধূমপানে শিশুর ক্ষতি সম্পর্কে অবগত? রাস্তায় প্রকাশ্যে যিনি ধূমপান করছেন তিনি কী প্রকাশ্যে ধূমপানের শাস্তি সম্পর্কে জানেন? ধূমপান এমনিতেই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর-এ কথা কমবেশি সবাই জানে। যিনি ধূমপান করছেন তিনি তো নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কেই সচেতন নন। তাহলে একজন ধূমপায়ী ব্যক্তি শিশুর পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতির কথা কীভাবে ভাববে? ফুসফুসের ক্যানসারের জন্য ৯০ ভাগ দায়ী তামাক। তাই পরোক্ষ ধূমপান থেকে অবশ্যই সবার আগে শিশুদেরকে রক্ষা করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
বাংলাদেশে তামাকজাত পণ্য উৎপাদন, প্রচার-প্রসারের পেছনে তামাক কোম্পানিগুলোর ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। কোম্পানিগুলো নিজেদের ব্যবসার স্বার্থে সমাজের ক্ষতির কথা চিন্তা করে না। কোম্পানিগুলো তামাক উৎপাদনও করে আবার তার ক্ষতির কথাও বলে। কৃষকদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কোম্পানিগুলো দেদারছে তামাক উৎপাদন করে যাচ্ছে। কৃষকরা ধান, পাট বাদ দিয়ে অতিরিক্ত লাভের জন্য জমিতে তামাক চাষ করছেন।
তামাক কোম্পানিগুলো বিভিন্ন কৌশলে কিশোরদের টার্গেট করে। কেনোনা শিশু-কিশোরদের তামাক ধরিয়ে দিতে পারলে নিশ্চিতে বহু বছর তাদের ক্রেতা হিসেবে পাওয়া যাবে। একদিকে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা তামাকের কুফল তুলে ধরে দেশের সবাইকে তামাক থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানাচ্ছে অন্যদিকে তামাক কোম্পানিগুলোকে প্রকাশে ব্যবসার সুযোগ দিচ্ছে। সিগারেট, বিড়ি ও অন্যান্য তামাকপণ্যের নেশা এমন একটি ব্যাপার যেটা শুধু পণ্যের কর বাড়িয়ে প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।
তামাকের বিরুদ্ধে এতো প্রচার থাকলেও তামাকের চাষাবাদ ও ব্যবহার কমানো যাচ্ছে না কেনো? বাস্তবে এসব প্রচার দায়সারা। তামাকের উৎপাদন যেমন বাড়ছে, তেমনি ব্যবকারকারীর সংখ্যাও বাড়ছে। সর্বশেষ ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০১৫’ প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু তাতে কার কী যায় আসে! তামাকের উৎপাদন ও ব্যবহার চলছেই।
সত্যি বলতে, আইন ও বিধিমালার কোনো প্রয়োগ নেই। একদিকে দেশে তামাকের উৎপাদন হচ্ছে অপরদিকে বিদেশ থেকে তামাক পণ্য আমদানিও করা হচ্ছে। তাহলে বলা যায়, তামাক উৎপাদন ও আমদানিতে রাষ্ট্রের সম্মতি আছে। এভাবে কি তামাকমুক্ত দেশ গড়া সম্ভব? সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে ও স্বাস্থ্যকর জীবনের জন্য তরুণদের ধূমপানসহ ক্ষতিকর তামাকজাত পণ্য থেকে দূরে থাকা উচিত। টেকসই খাদ্যনিরাপত্তা ও উন্নয়নের পথে তামাক অন্যতম বাধা।
সুখী, সুন্দর, দীর্ঘায়ু ও স্বাস্থ্যবান জীবনযাপনের জন্য তামাকজাত পণ্য ত্যাগ করতে হবে। ধীরে ধীরে তামাক পণ্য নিষিদ্ধের পথে যেতেই হবে। ২০৪০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। শিশুদের ওপর তামাকের আগ্রাসন বন্ধ করতে এবং পর্যায়ক্রমে দেশকে তামাকমুক্ত করতে হলে প্রথমেই তামাক চাষ বন্ধ করতে হবে। ঘরে কিংবা ঘরের বাইরে শিশুদের সামনে ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০০৫ এর যথাযথ প্রয়োগের পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। সদিচ্ছা ও জনসচেতনতাই পারে ক্ষতিকর তামাক থেকে সবাইকে নিরাপদ রাখতে।
লেখক: শিক্ষক