ঢাকা রোববার, ১৯ মে ২০২৪ , ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

nogod
nogod
bkash
bkash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
nogod
nogod
bkash
bkash

র‌্যাঙ্কিংয়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে কেনো

মতামত

অলোক আচার্য

প্রকাশিত: ০০:১০, ৭ মে ২০২৪

সর্বশেষ

র‌্যাঙ্কিংয়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে কেনো

মাঝে মধ্যেই বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি সেরা তালিকা প্রকাশ করা হয় এবং অধিকাংশ সময়ই আমরা দেখেছি যে দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এতে প্রথম কয়েকশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেও স্থান পায়নি। প্রশ্ন ওঠে কেনো এবং এটাই স্বাভাবিক। এশিয়ার মধ্যে অন্যতম প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেনো এই তালিকার ওপরের দিকে থাকে না বা নেই সেই প্রশ্নও স্বাভাবিক। যাচাইয়ের মানদণ্ডের কথায় পরে আসছি। যদি ভারত বা পাকিস্তানের বিশ্ববিদ্যায় এসব র‌্যাঙ্কিংয়ে থাকতে পারে তবে আমরা কেনো পারবো না সেই প্রশ্ন আসে। এবার যেমন যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা সাময়িকী ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে এশিয়ার সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত এ তালিকায় এশিয়ার সেরা ৩০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম আসেনি। এই ব্যর্থতার কাদের? আমরা কেনো এই দায় নেবো না? ভারতের এতোগুলো বিশ্ববিদ্যালয় যদি সেরা ৩০০ এর মধ্যে থাকে তাহলে আমাদের একটিও কেনো থাকবে না? আমরা তো আশা করছি না যে আমাদের দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রথম ৩০০ এর মধ্যে থাকতে হবে। অন্তত একটি বা দুটি হলেও আমরা বলতে পারি। এটা কি আন্তর্জাতিকভাবে দেশের শিক্ষা নিয়ে কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না? উন্নয়নের একটি সেরা ক্ষেত্র হলো শিক্ষা এবং বিশ্ববিদ্যালয় হলো সর্বশেষ ক্ষেত্র। যেখান থেকে একজন শিক্ষার্থী পরিপূর্ণ মানুষ ও সম্পদ হয়ে দেশের হাল ধরার যোগ্যতা অর্জন করে থাকেন। এবারও সেরা ৩০০ তালিকায় ভারতের ৪০টি, পাকিস্তানের ১২টি, মালয়েশিয়ার ১১টি বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পেয়েছে। 

এশিয়ার ৩১ দেশের মোট ৭৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে র‌্যাঙ্কিং করা হয়েছে। র‌্যাঙ্কিংয়ে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রথম চীনের সিনহুয়া ইউনিভার্সিটি, দ্বিতীয় চীনের পিকিং ইউনিভার্সিটি, তৃতীয়, ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর, চতুর্থ সিঙ্গাপুরের নানিয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি এবং পঞ্চম জাপানের ইউনিভার্সিটি অব টোকিও। সেরা দশের মধ্যে আরো আছে ইউনিভার্সিটি অব হংকং, চিনের সাংহাই জিয়াও টং ইউনিভার্সিটি, ফুদান ইউনিভার্সিটি, শেজিয়াং ইউনিভার্সিটি এবং হংকংয়ের দ্য চাইনিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকং। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে বুয়েট ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৩০১-৩৫০’র মধ্যে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অবস্থান ৩৫১-৪০০’র মধ্যে। এ ছাড়া, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ৪০১-৫০০’র মধ্যে এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৫০১-৬০০’র মধ্যে। 

ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে তালিকার ৩২তম অবস্থানে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স। পাকিস্তানের সেরা কায়েদ-ই-আজম ইউনিভার্সিটির অবস্থান ১২১তম। শিক্ষাদান, গবেষণা, জ্ঞান বিতরণ এবং বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিসহ মোট ১৮টি বিষয়ে মূল্যায়ন করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাঙ্কিং করেছে টাইমস হায়ার এডুকেশন। এই তালিকা থেকে দেখা যায় যেসব দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এই তালিকায় নেই তাদের অনেক দেশের সঙ্গেই আমাদের দেশের কয়েকটি বিষয়ে পার্থক্য রয়েছে। তারা অর্থনৈতিকভাবেও আমাদের দেশের চেয়ে দুর্বল। অথচ আমরা জানি বাংলাদেশ শিক্ষা ক্ষেত্রেও এগিয়ে যাচ্ছে। অন্তত দেশে আজ অনেকগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং অসংখ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন থাকলেও অন্তত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে মানুষের ধারণা আজও বেশ স্বচ্ছ। প্রতি বছর এইচএসসি পরীক্ষার পর ছাত্রছাত্রীদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিযোগিতা দেখে সেটা অনুমান করা যায়। একটি আসনের বিপরীতে কতো অসংখ্য ছাত্রছাত্রী অংশ নেন। তালিকায় আমাদের দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থাকুক আর না থাকুক তাতে খুব বেশি কিছু যায় আসে না কিন্তু অনেক প্রশ্ন থেকে যায়। কেনো এতোগুলো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় ওপরের দিকে বা ভারত, পাকিস্তান বা মালয়েশিয়ার পাশাপাশি আমাদের দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম থাকা প্রায় দুর্লভ হয়ে গেছে। আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় তাহলে কি কোনো গলদ রয়ে গেছে। থাকলে সেটা কোথায়। তা নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে। বিষয়টি যদি আমরা ছেড়েও দেই তাহলেও প্রশ্ন বাদ যাবে না। কারণ, আমাদের কোথায় সমস্যা সেটা তো খুঁজে বের করতেই হবে। তার আগে শিক্ষা এবং শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা দরকার। সবচেয়ে বড় কথা যে, সবক্ষেত্রে যদি আমরা অন্য দেশকে ছাড়িয়ে যাই তাহলে শিক্ষায় পিছিয়ে থাকাটা কোনো শুভ লক্ষণ নয়। বরং এই ক্ষেত্রে আমাদের কোথায় ঘাটতি রয়েছে তা নিয়ে গবেষণা করা দরকার এবং তা পূরণে উদ্যোগ নিতে হবে। 

শিক্ষা মানুষের মধ্যেকার অন্তর্নিহিত শক্তি জাগ্রত করার কাজ করলে বাস্তবিক ক্ষেত্রে এর প্রয়োগ সঠিকভাবে হচ্ছে না। শিক্ষা তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সফল হচ্ছে না। প্রয়োগের উদ্দেশ্য এবং ধরনেই এমনটা হচ্ছে বলাই যায়। দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমাদের আজকের শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল চাকরি পাওয়া। একটা সার্টিফিকেট আর চাকরি। তারপর জীবনে আর কোনো দুঃশ্চিন্তা থাকে না। আমাদের দেশে চলে আসা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে বহুবার ঘষামাজা করা হয়েছে। কখনো কোনো বিষয় বাতিল করা হয়েছে আবার প্রয়োজনের খাতিরে কোনো বিষয় বাদ দেয়া হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা প্রসারে ভূমিকা রেখেছিলো ব্রিটিশরা। মূলত ব্রিটিশদের তৈরি করা শিক্ষাব্যবস্থাতেই কিছুটা পরিবর্তন করে আজও আমাদের দেশে চলছে। ইংরেজদের সে ইচ্ছার প্রতিফলন আজও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় দেখতে পাই। আমাদের পোশাকে, আমাদের চালচলনে আমরা সর্বদাই সেই ইংরেজদের অনুসরণ করি। নিজেদের সংস্কৃতিকে গুলিয়ে আমরা পর সংস্কৃতির শিক্ষাই লাভ করতে শিখেছি। 

পাবলিক পরীক্ষাগুলোতে দেশে রীতিমত যুদ্ধ হয়। আমাদের দেশে অনেক জিনিসই কিনতে পাওয়া যায়। সার্টিফিকেট কেনা বেচা তো হয়ই। রেজাল্ট, সার্টিফিকেট এমনকি মনুষত্ব পর্যন্ত বিক্রি হয়ে যায় এদেশে। আবার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস করেও শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেন কেউ কেউ। ভাবা যায় একটি দেশের সর্বোচ্চ মানুষ যারা তৈরি করবে তারা নিজেরাই মুনষ্যত্বহীন! তারা টাকা দিয়ে প্রশ্ন কিনে তারপর শিক্ষক হতে চায়। এরা ছাত্রছাত্রীদের কী শেভাতে পারে? শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার ভুয়া সার্টিফিকেটধারী কতো শিক্ষক তো চাকরি হারিয়েছেন। যাদের নিজেদেরই মনুষ্যত্ব নেই তারা আবার ছাত্রদের শেখাবেন। আজকাল তো কতো নামজাদা শিক্ষকের গবেষণাও নকল প্রমাণিত হচ্ছে! মানে ধার করা আরকি। মনুষ্যত্ব বিক্রি করে দিব্বি চোখ বুঁজে চাকরি করে যাচ্ছে সারাজীবন। প্রশ্ন ফাঁস করে যারা এতোকাল ভালো রেজাল্ট করেছে তারা তো বহাল তবিয়তে দেশের বড় আদৌ দেশের উন্নয়ন চায় বলে মনে হয় না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় সবেমাত্র পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। সেই পরিবর্তন হচ্ছে সময়ের সঙ্গে সংগতি রেখেই। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে আমাদের সেই পরিবর্তনকে মেনে নিতে হবে বা গ্রহণ করতেই হবে। প্রচলিত পরীক্ষা, নম্বর পাওয়া এবং পাস-ফেল এই করতে করতে আমাদের একটি প্রজন্মকে আমরা প্রায় পঙ্গু করে রেখেছি। মেধা শব্দটিকে ইংরেজি, গণিত বা বিজ্ঞানের মতো কঠিন বিষযে দক্ষতার মধ্যে আটকে রেখেছি। মনের সুপ্ত ইচ্ছাগুলো মনের ভেতরেই মরে গেছে। সত্যি বলতে, আমরা প্রচলিত শিক্ষা দিয়ে কিন্তু মানুষ করতে পারিনি। তাই এই পরিবর্তন আবশ্যক ছিলো। একদিন তা সকলের জন্যই শুভ ফল বয়ে আনবে। তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও বাইরের দেশের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় এগিয়ে যাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অন্যান্য দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমান মান বজায় রেখে এগিয়ে যাবে এটাই প্রত্যাশা। 

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
 

জনপ্রিয়