ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ , ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

nogod
nogod
bkash
bkash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
nogod
nogod
bkash
bkash

একাত্তরের বীজ রোপিত ৪৮-এ

মতামত

সন্তোষ দাস

প্রকাশিত: ০০:০০, ২৭ মার্চ ২০২৪

সর্বশেষ

একাত্তরের বীজ রোপিত ৪৮-এ

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ২১ মার্চ পাকিস্তানের প্রথম গর্ভনর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেবেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর এটাই তার প্রথম ঢাকা সফর। লাখ লাখ বাঙালি সেদিন রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়েছিলো তাদের প্রিয় নেতাকে এক নজর দেখতে বা তার কথা শুনতে। কারণ, পাকিন্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বাঙালিদেরও অবদান ছিলো। জিন্নাহর নেতৃত্বে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয় থাকার কারণেই জিন্নাহর প্রতি বাঙালিদের শ্রদ্ধা ছিলো, আবেগ ছিলো। কিন্তু আনন্দে উদ্বেলিত হাস্যোজ্জ্বল লাখ লাখ বাঙালির মুখে চপেটাঘাত লাগলো যখন তিনি ঘোষণা করলেন, ‘উর্দু অ্যান্ড ওয়ানলি উর্দু শ্যাল বি দ্য স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান’।

বাঙালিদের মাঝে এই ঘোষণা ছিলো বজ্রাঘাতের মতো। তারা হতবিহ্বল, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কিন্তু মুহূর্তের বিহ্বলতা কাটিয়ে সে সময়কার ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ছাত্ররা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। তারা ‘নো নেভার’ ধ্বনিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তোলে। তিন দিন পর ২৪ মার্চ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই ছাত্ররা ‘নো নেভার’ বলে প্রতিবাদ করেন। সেখানেও ছাত্রদের নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিব।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘১৯ মার্চ জিন্নাহ ঢাকা আসলে হাজার হাজার লোক তাকে অভিন্দন জানাতে তেজগাঁও হাওয়াই জাহাজের আড্ডায় হাজির হয়েছিলো। আমার মনে আছে, ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিলো। সেদিন আমরা সকলেই ভিজে গিয়েছিলাম, তবুও ভিজে কাপড় নিয়ে তাকে অভ্যর্থনা করার জন্য এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করছিলাম। জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তানে এসে ঘোড় দৌড় মাঠে বিরাট সভায় ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হবে’। আমরা প্রায় চার পাঁচশত ছাত্র একজায়গায় ছিলাম সেই সভায়। অনেকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিল, ‘মানি না’। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে বক্তৃতা করতে উঠে তিনি যখন আবার বললেন, ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হবে’-তখন ছাত্ররা তার সামনেই বসে চিৎকার করে বলল, ‘না, না, না’।

জিন্নাহ প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করে ছিলেন, তারপর বক্তৃতা করেছিলেন। আমার মনে হয়, এই প্রথম তার মুখের ওপরে তার কথার প্রতিবাদ করলো বাংলার ছাত্ররা। এরপর জিন্নাহ যতদিন বেঁচে ছিলেন আর কোনোদিন বলেন নাই, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হবে’।    

সেদিনের মুষ্টিমেয় ছাত্রের প্রতিবাদ ক্রমান্বয়ে সর্বজনীন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে রূপ নেয় এবং দিনে দিনে আন্দোলন বেগবান হয়ে চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি। ততোদিনে পাকিস্তানের প্রতি বাঙালিদের মোহ টুটে যায়। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় পাকিস্তানের প্রতি অনিহার আর একটি ধাপ। শিক্ষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে বৈষম্য যতোই স্পষ্ট হতে থাকে, এদেশের সচেতন ছাত্রসমাজ, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদদের কাছে পাকিস্তান ততোই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের সর্বজনীন শিক্ষা অধিকারের জন্য ছাত্র আন্দোলন হয়। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধীরে ধীরে বাঙালি জাতিকে সংঘটিত করে স্বাধিকার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার পথে নিয়ে যান। তিনি ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা প্রণয়ন করেন। ছয় দফার প্রতি বাঙালিদের নজিরবিহীন সমর্থন প্রমাণ করে ছয় দফার মধ্যেই বাঙালির প্রকৃত মুক্তি নিহীত। 

পাকিস্তানের সঙ্গে একত্রে থাকার দিন ফুরানোর বিষয়টি স্পষ্ট হয় যখন বঙ্গবন্ধু ও তার সহযোগীদের মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক আগরতলা মামলায় বন্দি করা হয় এবং প্রহসনের বিচারে তাদের ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। এই ঘটনায় বাঙালি জাতি ফুঁসে ওঠে, সৃষ্টি হয় গণঅভ্যুত্থানের। পাকিস্তানের জান্তা সরকার বঙ্গবন্ধুসহ সব রাজবন্দিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে লাখো ছাত্রজনতার সমাবেশে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন বাঙালির ভাগ্যনিয়ন্তা। তার নির্দেশেই তখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সবকিছু চলতে থাকে। এরপর ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভূমিধস বিজয় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের যৌক্তিকতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত করে। 

ঘটনা পরিক্রমায় এলো ঐতিহাসিক সাত মার্চ। বঙ্গবন্ধু দাঁড়ালেন রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার মাঝে। দিলেন কালজয়ী ভাষণ। শোনালেন তার অমর বাণী, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। একটি জাতির মুক্তির জন্যে, তাদের স্বাধীনতার জন্যে সেই জাতিকে পরিপূর্ণরূপে মুক্তিযুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করতে যাবতীয় দিকনির্দেশনা দিলেন। যুদ্ধ শুরু হলে কী করতে হবে তার দিক নির্দেশনা দিলেন। উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট বিস্তারিত বর্ণনা করলেন। এই ভাষণের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি তাদের করণীয় সম্পর্কে অবহিত হলো। তারা পূর্ণ প্রস্তুত। এখন শুধু চূড়ান্ত ডাকের অপেক্ষা। 

১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে সেই চূড়ান্ত ডাক এলো। ২৫ মার্চ কালরাতে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো, শুরু করলো নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। পাকিস্তানিরা যেহেতু আক্রমণ করেছে, এবার বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা ছাড়া গত্যন্তর দেখলেন না। গ্রেফতারের পূর্বে তিনি স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘোষণা দিলেন, সঙ্গে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন দেশের গর্বিত নাগরিক। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ভাষার প্রশ্নে যে প্রতিবাদ শুরু হয়েছিলো বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে। অনেক রক্তের বিনিময়ে তারই চূড়ান্ত পরিণতি ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের স্বাধীনতা অর্জন।

লেখক: প্রভাষক, সরকারি ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা ডিগ্রি কলেজ, বাগেরহাট

জনপ্রিয়