ঢাকা মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪ , ২৩ বৈশাখ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

nogod
nogod
bkash
bkash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
nogod
nogod
bkash
bkash

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

বিবিধ

আমাদের বার্তা ডেস্ক

প্রকাশিত: ০০:০০, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

সর্বশেষ

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও জননেতা এ.কে ফজলুল হক এর মৃত্যুবার্ষিকী আজ। তিনি কলকাতার মেয়র, অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী, পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের পদসহ বহু উঁচু রাজনৈতিক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। লোকপ্রিয়ভাবে ‘শেরে বাংলা’ বা হক সাহেব রূপে পরিচিত আবুল কাশেম ফজলুল হক বাকেরগঞ্জ জেলার দক্ষিণাঞ্চলের বর্ধিষ্ণু গ্রাম সাটুরিয়ায় ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তবে তার পূর্বপুরুষদের বাড়ি ছিলো বরিশাল শহর থেকে চৌদ্দ মাইল দূরে চাখার গ্রামে। তিনি ছিলেন মুহম্মদ ওয়াজিদ ও সায়িদুন্নিসা খাতুনের একমাত্র পুত্র। ফজলুল হকের পিতা বরিশাল আদালতের দীউয়ানি ও ফৌজদারি উকিল ছিলেন এবং তার পিতামহ কাজী আকরাম আলী ছিলেন আরবি ও ফারসিতে দক্ষ পন্ডিত ও বরিশালের একজন বিশিষ্ট মোক্তার।

বাড়িতে আরবি ও ফারসিতে সনাতন ইসলামি শিক্ষা গ্রহণ শেষে ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে ফজলুল হক বরিশাল জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স, ১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ এবং ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে বিএ পরীক্ষায় (রসায়ন, গণিত ও পদার্থবিদ্যা তিনটি বিষয়ে অনার্সসহ) উত্তীর্ণ হন। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি গণিত শাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন।

১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার ‘ইউনিভার্সিটি ল কলেজ’ থেকে বিএল ডিগ্রি লাভ করে ফজলুল হক স্যার আশুতোষ মুখার্জীর অধীনে শিক্ষানবিশ হিসেবে আইন ব্যবসা শুরু করেন। বহুরূপে ও বিভিন্নভাবে  অশ্বিনীকুমার দত্ত এবং  প্রফুল্লচন্দ্র রায় এর স্নেহলাভের সৌভাগ্য ফজলুল হকের হয়েছিল। পিতার মৃত্যুর পর হক বরিশাল শহরে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯০৩-১৯০৪ সময়কালে তিনি এ শহরের রাজচন্দ্র কলেজে খন্ডকালীন প্রভাষক হিসেবেও কাজ করেছিলেন। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ফজলুল হক সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকায় সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতেও তিনি সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। ১৯০৮ থেকে ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত হক ছিলেন সমবায়ের সহকারী রেজিস্ট্রার। সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি জনসেবামূলক কাজ ও আইন ব্যবসাকে বেছে নেন। স্যার আশুতোষ মুখর্জীর পরামর্শে তিনি কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন।

স্যার  খাজা সলিমুল্লাহ ও নবাব  নওয়াব আলী চৌধুরীর কাছে রাজনীতিতে তার হাতেখড়ি হয়। তাদের সহযোগিতায় ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তার শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী রায়বাহাদুর কুমার মহেন্দ্রনাথ মিত্রকে পরাজিত করে ঢাকা বিভাগ থেকে বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মাঝখানে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে দুবছর সময়কাল ছাড়া ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশবিভাগ পর্যন্ত তিনি বঙ্গীয় আইন সভার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে শেরে বাংলা ফজলুল হক বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক হন এবং ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ পদে বহাল থাকেন। সর্বভারতীয়  মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক রূপেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯১৬ থেকে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ছিলেন সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সদস্য রূপে তিনি সে সংগঠনের সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।

গ্রামীণ অভিজাতদের তার শক্তির ভিত্তিরূপে গড়ে তোলা ছিল এ.কে ফজলুল হকের রাজনৈতিক কৌশল। স্বল্পস্থায়ী কলকাতা কৃষি সমিতি এবং বেঙ্গল প্রজা পার্টি নামে আরো একটি স্বল্পস্থায়ী সংগঠন প্রতিষ্ঠায় তার উদ্যোগ থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এ পার্টিই পরবর্তীকালে  নিখিলবঙ্গ প্রজা সমিতি নামে একটি নিয়মিত আধা-রাজনৈতিক সংগঠনে রূপান্তরিত হয়েছিলো। স্যার  আবদুর রহিম এর সভাপতি এবং তিনি নিজে এবং খান বাহাদুর আবদুল মোমিন এর সহসভাপতি হয়েছিলেন। অল্পদিনের মধ্যেই দুনেতার মধ্যে ব্যক্তিত্বের বিরোধ দেখা দেয়। সমিতিতে হকের উপদল ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে এর নাম পরিবর্তন করে  কৃষক প্রজা পার্টি (কে.পি.পি) রাখে। হকের নেতৃত্বে কেপিপি এক গণ-আন্দোলন শুরু করে। কৃষকদের অধিকার পুনরুদ্ধার,  মহাজন ও  জমিদারদের অত্যাচার থেকে কৃষকদের মুক্তিদান এবং জমিদারি ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে রায়তদের জমির মালিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা ছিলো এ আন্দোলনের উদ্দেশ্যে। এ সব শ্লোগান ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের আইনের বলে ভোটাধিকার লাভকারী কৃষিজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে কে.পি.পি-কে জনপ্রিয় করে তুলেছিলো।

 

 

মুসলমান সম্প্রদায়ের পশ্চাৎপদতা দূর করার উদ্দেশ্যে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী রূপে ফজলুল হক মুসলমানদের জন্য চাকরির ৫০% সংরক্ষিত রাখার নির্দেশ দান করেন এবং বাংলা সরকারের অফিসগুলোতে এ অনুপাত কঠোরভাবে কার্যকর করেন। সরকার এ নীতি মেনে নেয় যে, যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী পাওয়া গেলে সরাসরিভাবে নিয়োগের ক্ষেত্রে ১৫% চাকরি তফশিলি সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত রাখা হবে, তবে এ সংরক্ষণ সরাসরিভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত অমুসলমানদের ৩০% এর বেশি হবে না। অবশ্য অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, ভারতীয় খ্রিষ্টান এবং বৌদ্ধদের জন্য শতাংশের হিসেবে পদের কোনো সংরক্ষণ ছিলো না। তবে সরকার যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থী পাওয়া গেলে এসব সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ বিবেচনার নিশ্চয়তা দান করেছিলো।

তার প্রথম মন্ত্রিত্বের সময়ে শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে হক মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের গতি ত্বরান্তিত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। অবশ্য প্রদেশে বসবাসকারী সকল সম্প্রদায়ের মধ্যেই শিক্ষার বিস্তার করাকে তিনি তাঁর দায়িত্বরূপে বিবেচনা করেছিলেন। এ লক্ষ্য নিয়ে তিনি বঙ্গীয় আইন সভায় ‘প্রাথমিক শিক্ষা বিল’ পেশ করেন যা প্রাথমিক শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করে আইন হিসেবে পাস করা হয়েছিলো।

১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ আগস্ট কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। সে সময় হক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধার করতে এবং কলকাতার পার্ক সার্কাসে তার হিন্দু প্রতিবেশীদের রক্ষা করতে চেষ্টা করেন। নগরীতে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি দেখে তিনি অত্যন্ত হতোদ্যম হয়ে পড়েছিলেন। লীগ-নেতৃবৃন্দের অনুরোধে হক ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে মুসলিম লীগে যোগদান করেন।

 

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ-বিভক্তির ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি লক্ষ করে হক অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন। তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস করতে শুরু করেন এবং ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের অ্যাডভোকেট জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। বিক্ষোভ প্রদর্শনকারী ছাত্রদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করলে ফজলুল হক আহত হন। হক মুসলিম লীগবিরোধী আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট নেতারূপে আবির্ভুত হন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি  ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গণ অভ্যুত্থান পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিকে এক নতুন দিকনির্দেশনা দান করে। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জুলাই ফজলুল হক ‘শ্রমিক-কৃষক দল’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে অংশ গ্রহণের জন্য হক, মওলানা  আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও সোহ্‌রাওয়ার্দী যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। হক এ জোটের নেতা নির্বাচিত হন। তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারণার পক্ষে জনগণকে সমবেত করতে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলো। শেরে বাংলার ভক্তি ও উৎসাহ সঞ্চয়ের ক্ষমতা বিপুল ভোটে ফ্রন্টের জয়লাভের একটি প্রধান কারণ ছিলো। ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনের পর এ.কে ফজলুল হক পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হন যদিও আইনসভায় তার দল আওয়ামী মুসলিম লীগের চেয়ে অনেক কম আসন লাভ করেছিলো। রাজনৈতিকভাবে এটা কৌতূহলোদ্দীপক যে, আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা না হয়েও হক দুবার বাংলার এবং আরো একবার পূর্ববাংলার মুখ্যমন্ত্রী হতে পেরেছিলেন। এটা তার রাষ্ট্রপরিচালনায় দক্ষতা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার নির্দেশক। তিনি সব সময়ই আন্তঃদলীয় আচার-আচরণ বজায় রাখতে পারতেন। অবশ্য হকের মন্ত্রিসভা ছিলো স্বল্পস্থায়ী।

পাকিস্তানে সদ্য গঠিত গণ-পরিষদে হকের যথেষ্ট সমর্থক ছিলেন। তারা চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী হিসেবে কাজ করতেন যার ফলে ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের আগস্টে হককে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগদানের আমন্ত্রণ জানানো হয়। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হন এবং ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে সে পদ থেকে অপসারিত হন। তারপর থেকেই তিনি রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়। কাজী নজরুল ইসলাম এভেনিউর দক্ষিণপ্রান্তে শিশু একাডেমির পশ্চিম পাশে তিন নেতার মাজারের মধ্যে একটি হলো তার সমাধি।

 

প্রায় অর্ধশতক ধরে ফজলুল হক ছিলেন উপমহাদেশের এক বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন এক অসাধারণ বাগ্মী। ইংরেজি, বাংলা ও উর্দুতে তিনি অনর্গল বক্তৃতা করতে পারতেন। একই সঙ্গে ইসলামি, বাঙালি ও ভারতীয় পরিচয় তার মানসকে প্রভাবিত করায় তার চিন্তা ও কর্মে পরস্পরবিরোধী উপাদান প্রকাশ পায়। পশ্চাৎপদ মুসলমান সম্প্রদায়ের উন্নয়নের কথা তাকে ভাবতে হতো, সমগ্র বাঙালি জাতির অগ্রগতির চিন্তায় তিনি ছিলেন মগ্ন এবং একই সঙ্গে যুক্ত স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন তিনি সযত্নে লালন করতেন। স্বাভাবিকভাবেই তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে একটি সঙ্গতিপূর্ণ নীতি অনুসরণ করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। ফলে তিনি বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক ব্যক্তি হয়েই রইলেন।

জনপ্রিয়