ঢাকা রোববার, ০৫ মে ২০২৪ , ২১ বৈশাখ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

nogod
nogod
bkash
bkash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
nogod
nogod
bkash
bkash

মানবজীবনে বনভূমির গুরুত্ব

মতামত

মো. মোস্তফা মিয়া

প্রকাশিত: ০১:২০, ২৫ এপ্রিল ২০২৪

সর্বশেষ

মানবজীবনে বনভূমির গুরুত্ব

প্রকৃতিজগতের সঙ্গে মানবসভ্যতার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রকৃতি ও প্রাণী জগত পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। প্রাকৃতিক সাম্রাজ্যের এবং মানবসভ্যতার ভারসাম্য সুরক্ষায় জগতের প্রতিটি প্রজাতি পৃথকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। প্রতিটি জীবই কোনো না কোনোভাবে পরিবেশের জন্য ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে থাকে। এক্ষেত্রে বনভূমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মহান আল্লাহ কুদরতি হাতের ছোঁয়ায় আমাদের চারপাশে গড়ে উঠেছে সবুজ উদ্যানে তৈরি সৌম্য-শান্ত ও সজীব পরিবেশ। ফলদ, বনজ ও ওষুধি গাছগাছালি, রং-বেরঙের পাখিদের কলতান, নিরবধি বয়ে চলা ঝরনা-নদী এসবই বান্দার প্রতি আল্লাহর বিশেষ দান ও নেয়ামত। আমাদের বেঁচে থাকার মূল উপাদান গাছপালা ও সবুজ বনাঞ্চল। মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তুর শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে প্রয়োজন নির্মল বায়ুর। আর তার পুরোটাই আসে গাছপালা ও বনাঞ্চল থেকে। প্রাণিকুলের এই অমোঘ প্রয়োজন পূরণার্থে মহান আল্লাহতায়ালা পৃথিবীজুড়ে প্রয়োজনেরও অধিক সৃষ্টি করেছেন নানা ধরনের বৃক্ষরাজি। প্রাণিকুলের বসবাসের জন্য রেখেছেন আলাদা বনভূমি। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে থাকি পরিমাণমতো, সেগুলোকে আমি জমিনে সংরক্ষণ করি এবং আমি তা অপসারণ করতে সক্ষম। সে পানি দিয়ে তোমাদের জন্য খেজুর ও আঙুর বাগান সৃষ্টি করছি। তোমাদের জন্য এতে প্রচুর ফল আছে এবং তোমরা তা থেকে আহার করে থাকো।’

কোরআনে আরো বলা হয়েছে, আমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি এবং তাতে ফলিয়েছি সর্ব প্রকার নয়নাভিরাম উদ্ভিদ। অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি আকাশ থেকে কল্যাণময় বৃষ্টি বর্ষণ করি এবং এর দ্বারা বাগানে শস্য উৎপাদন করি। যেগুলোর ফসল আহরণ করা হয়। আল্লাহ আরো উল্লেখ করেছেন, তার নিদর্শন এই যে, তুমি ভূমিকে দেখবে অনুর্বর পড়ে আছে। আমি যখন বৃষ্টি বর্ষণ করি, তখন তা শস্য-শ্যামলতায় ভরে ওঠে ও স্ফীত হয়। নিশ্চয় যিনি একে জীবিত করেন, তিনি জীবিত করবেন মৃতদেরকেও।

উল্লেখিত আয়াতগুলোর দ্বারা মহাশক্তিশালী আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে অবগত হওয়া যায়। এর সঙ্গে এটাও বোঝা যায়, মানুষের প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ বৃক্ষরাজি তাদের কল্যাণার্থেই সৃষ্টি করেছেন। এ সম্পর্কে মহাবিজ্ঞানময় গ্রন্থ পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘তিনি পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছেন এবং তাতে পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী স্থাপন করেছেন এবং প্রত্যেক ফলের মধ্যে দু দু প্রকার সৃষ্টি করে রেখেছেন। তিনি দিনকে রাতের দ্বারা আবৃত করেন। এতে তাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে, যারা চিন্তা করে। জমিনে বিভিন্ন শস্যক্ষেত্র রয়েছে, যা একটি অপরটির সঙ্গে মিলিত আর কিছু মিলিত নয়। অথচ এগুলোকে একই পানি দ্বারা সেচ করা হয়। আর আমি স্বাদে একটিকে অপরটির চাইতে উৎকৃষ্টতর করে দিই। এগুলোর মধ্যে নিদর্শন রয়েছে তাদের জন্য, যারা চিন্তা-ভাবনা করেন।’ হাদিসেও বৃক্ষরাজির উপকারিতা সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যেকোনো মুসলমান ফলবান গাছ লাগাবে, আর তা থেকে কেউ খেয়ে ফেলবে বা চুরি করবে অথবা বন্য জন্তু বা পাখি খাবে, তা হবে দানস্বরূপ। আর কেউ বলে কিছু নিয়ে খেলেও তা তার জন্যও দানস্বরূপ হবে।’

মানবকল্যাণের প্রয়োজনে বৃক্ষ ও বনাঞ্চলের গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষের জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বৃক্ষরাজি। মানুষ ও পশুপাখির আহার্য উৎপাদন হয় গাছপালা থেকে। ফলদ গাছগুলো থেকে আমরা পুরো বছরই পাই নানা ধরনের সুমিষ্ট ফল। মানুষ ও পাখিরা সে ফল খেয়ে জীবন ধারণ করে। পশুপাখি ও কীটপতঙ্গের নিরাপদ বসবাসের জন্য চাই ঘন ও গভীর বনাঞ্চল। গাছপালা-তরুলতা পরিবেশকে সজীব ও সুন্দর রাখে। গাছপালা না থাকলে জমিন হয়ে পড়ে রুক্ষ। একসময় তা মরুভূমিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। বন গভীর হলে জীবজন্তু ও পাখিদের বসবাস বৃদ্ধি পায়। নির্ভয়ে তারা বিচরণ করতে পারে বনে। ঘর নির্মাণ, আসবাবপত্র তৈরিতে প্রয়োজন শক্ত ও মজবুত কাঠের। বিভিন্ন কাঠের গাছ আমাদের সে প্রয়োজন পূরণ করে। প্রতিদিনের জ্বালানির চাহিদা মেটাচ্ছে বনাঞ্চল। শিলকড়ই, মেহগনি, শাল এর মধ্যে প্রধান। প্রতিবছর সুন্দরবন থেকে আসে খাঁটি মধু। নিরাপদ বনভূমি না থাকলে খাঁটি মধুর কল্পনাও করা যেতো না।

জীবজন্তু এবং প্রাকৃতিক বিপর্যায় রোধে বৃক্ষ ও বনভূমির বিকল্প নেই। গাছপাল নিয়মিত কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে বিনিময়ে অক্সিজেন ত্যাগ করে প্রাণী জগতের প্রভূত উপকার করছে। একটি বৃক্ষ নিয়মিত প্রায় ১৩ কেজি কার্বন-ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখে। এর সঙ্গে বৃক্ষরাজি আমাদের জীবন ধারণের জন্য ৬ কেজি বিশুদ্ধ অক্সিজেন বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে আমাদের বেঁচে থাকতে সহায়তা করে। বৃক্ষ আমাদের দৈনন্দিন জীবনধারণ, গৃহস্থালি, আসবাবপত্র, যানবাহন, শিল্প-কারখানা, কৃষি যন্ত্রপাতি, ওষুধ, জ্বালানি ও প্রাকৃতিক শোভাবর্ধন ইত্যাদির জোগান দিয়ে অনেক উপকার করছে। বনাঞ্চল ভূমি ক্ষয়রোধ, পরিবেশ রক্ষা, মাটির উর্বরতা ও শক্তি বৃদ্ধি, বৃক্ষ সমৃদ্ধ এলাকাতে বৃষ্টিপাত, বানভাসি, ঝড়-ঝঞ্জা ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধসহ মানব সম্প্রদায়কে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় হতে রক্ষা করে। সমগ্র বিশ্বের ভৌগোলিক আয়তনের এক-তৃতীয়াংশই বনাঞ্চল। বিভিন্ন প্রকারের উদ্ভিদ, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীটপতঙ্গ থেকে শুরু করে বৃহদাকার জীবজন্তুর আবাসভূমি এ বনাঞ্চলসমূহ। মানব সমাজকে অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভবান হওয়ার ক্ষেত্রে নানাভাবে সহায়তা করা ছাড়াও তা পরিবেশকে রাখে দূষণমুক্ত। এর সঙ্গে জলবায়ুর উপাদান যেমন উষ্ণতা, বৃষ্টি বর্ষণ, আর্দ্রতা ইত্যাদির ওপর প্রভাব বিস্তার করে বৃক্ষরাজি আবহাওয়া ও জলবায়ুকে বহু পরিমাণে মানবসমাজের অনুকূল করে তোলে।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, কিছু স্বার্থান্বেষী ও লোভী মানুষের লালসার মুখে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বৃক্ষরাজি ও বনাঞ্চল। যে পরিমাণে বৃক্ষ নিধন হচ্ছে, সে তুলনায় রোপণ হচ্ছে না। যার ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, অনাবৃষ্টি ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এসব দুর্যোগে ক্ষয় হচ্ছে ভূমি। জাতিসংঘের প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে বিভিন্ন কারণে এক কোটি সত্তর লাখ হেক্টর বনাঞ্চল ভূপৃষ্ঠ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বনভূমি, পাহাড়, হ্রদ, নদী ইত্যাদি বনাঞ্চলের ধ্বংসযজ্ঞে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে মানবসমাজ। বর্তমানে বিশ্ব ভূখণ্ডের মাত্র ত্রিশ শতাংশে বনভূমি রয়েছে। বিশ্বে প্রতিবছর এক কোটি হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হয়। প্রকৃতির ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য কোনো দেশের মোট ভূমির ৩৩ শতাংশ বনভূমি থাকা উচিত। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশের আয়তনের ২৪ শতাংশ বনভূমি ছিলো। ১৯৮০-৮১ খ্রিষ্টাব্দে তা কমে হয় ১৭ দশমিক ২২ শতাংশ এবং বর্তমানে মাত্র ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ বনভূমি রয়েছে। এ আশঙ্কাজনক ঘাটতির কারণ হলো ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার বিবিধ প্রয়োজন মেটানো। এর মধ্যে কৃষিজমির সম্প্রসারণ, বসতবাড়ি স্থাপন, শিল্পে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার, গৃহ নির্মাণসামগ্রী ও আসবাবপত্রের ব্যবহার, রাস্তা, বাঁধসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ, জ্বালানি হিসেবে ব্যাপক ব্যবহার, নগরায়ণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। উল্লিখিত কারণগুলোর মধ্যে জ্বালানি হিসেবে বনজসম্পদের ব্যবহার ৯৫ শতাংশ দায়ভার বহন করে। এ ছাড়া নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন-বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস বৃক্ষের ব্যাপক ক্ষতি করে। অদূর ভবিষ্যতে সাধারণ প্রয়োজনে বৃক্ষ সংকট এক প্রকট সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। যেকোনো দেশের ভৌগোলিক আয়তনের ৩৩ শতাংশ বনাঞ্চল থাকা যদিও প্রয়োজন, সেখানে বাংলাদেশে আছে মাত্র সাত-আট শতাংশ। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় দেশে প্রায় ১ লাখ গাছ ধ্বংস হয় বলে এক সমীক্ষায় প্রকাশ পেয়েছে।

জাতিসংঘের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্রতিনিয়ত বৃক্ষ নিধনের প্রভাব পুরো পৃথিবীতে পড়ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দুই মেরুর বরফ গলে যাচ্ছে। বৃষ্টিপাতর মাত্রা কমে যাচ্ছে। সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি পেয়ে একসময় উপকূলেরর অঞ্চলগুলো চলে যাবে সমুদ্রের গভীরে। এগুলো নিশ্চয় চিন্তার বিষয়। এভাবে প্রতিনিয়ত বৃক্ষ নিধন হলে দেশ একসময় মরুভূমিতে রূপান্তরিত হবে। বিলীন হয়ে পড়বে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা বনাঞ্চল ও তাতে বসবাসরত প্রাণিকুল। তাই আসুন, পরিবেশবান্ধবে আমরা প্রত্যয়ী হয়ে বৃক্ষ নিধন রোধ করি এবং বৃক্ষ রোপণে জনমত তৈরি করি।

বাংলাদেশের সংরক্ষিত বনভূমি যেভাবে দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে, তা জাতির জন্য অশনিসংকেত। সংরক্ষিত বনভূমি সুরক্ষার দায়িত্বে সরকারি কর্ম কর্তাদের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ! তাই এই বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি দেয়া আবশ্যক। হাজার কোটি নতুন চারা গাছ লাগিয়ে কোন সুফল পাওয়া যাবে না, যদি না সংরক্ষিত বনভূমিকে যথাযথভাবে সুরক্ষা করা না যায়। কারণ, চারাগাজ রোপণের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য সুরক্ষা করা সম্ভব হয় না। তাই মানবসভ্যতার স্বার্থে পরিবেশের টেকসই উন্নয়ন এবং জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য সুরক্ষার জন্য সংরক্ষিত বনভূমির সুরক্ষা এবং টেকসই উন্নয়ন সুনিশ্চিত করা আবশ্যক।
লেখক: অধ্যক্ষ ও কলামিস্ট

জনপ্রিয়