ঢাকা শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ , ১৩ বৈশাখ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

nogod
nogod
bkash
bkash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
nogod
nogod
bkash
bkash

ভাষার চেতনা থেকে স্বাধীনতা

মতামত

মো. মোস্তফা মিয়া

প্রকাশিত: ০০:০০, ২৭ মার্চ ২০২৪

সর্বশেষ

ভাষার চেতনা থেকে স্বাধীনতা

মহান ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। বাঙালির পরবর্তী ইতিহাস বিশেষ করে আমাদের ভাষা সংগ্রাম থেকে স্বাধিকারের চেতনা, এই চেতনা থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হয়ে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে শেষ হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শেষ হলেও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন এবং আমাদের জাতীয় জীবনে ভাষা আন্দোলনের চেতনা আজও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। এ কাজটি বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের স্বার্থকতা ফিরে আসবে। মানুষ মননশীল ও সামাজিক জীব। মানুষের সব স্বপ্ন, কল্পনা, ভাবনা, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ হয়। ভাষা মানুষের ইচ্ছা-মনোভাব অন্যের কাছে প্রকাশ করার এবং ভাব বিনিময়ের জন্য কণ্ঠধ্বনির সাহায্য গ্রহণ করে। 

প্রখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভাষার জন্ম নিয়ে চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ভাষার জন্ম জীবের জন্মের মতো নয়। অমুক সন-তারিখে অমুক ভাষার জন্ম হইয়াছে; এইরূপ কথা বলিতে পারি নাই। ভাষা নদী প্রবাহের ন্যায়। বিভিন্ন স্থানে তাহার বিভিন্ন নাম। যখন একটি ভাষা প্রবাহের মধ্যে কোনো সময়ের তাহার পরবর্তী ভাষাভাষীদিগের নিকট একটি নতুন ভাষা বলিয়া বোধ হয় তখন তাহার নামকরণ হইয়া থাকে।’ 

পৃথিবীতে অনেক ভাষা আছে। পৃথিবীর সব মানুষ একই বাক-প্রত্যঙ্গের সাহায্যে ধ্বনি সৃষ্টি করে, তবু এক এক গোষ্ঠীর ভাষা শৃঙ্খলা ও ভাষাবৈশিষ্ট্য বিভিন্ন রকম হয়। তাই একেক জাতি ও দেশের ভাষা একেক রকম হয়। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। আমাদের জন্মের পর আমরা প্রথম মায়ের কাছ থেকে এই ভাষার কথা বলে আসছি। পৃথিবীর ভাষাগুলোর মধ্যে আমাদের মাতৃভাষা অর্থাৎ বাংলা ভাষার একটি বিশিষ্ট স্থান ও মর্যাদা বিদ্যমান। বিশ্বের প্রায় ২০ কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। বাংলা ভাষা পৃথিবীর বড় ভাষাগুলোর একটি। এই ভাষা সারা বিশ্বে সপ্তম বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে স্বীকৃত।

মাতৃভাষা বাংলার ওপর বিভিন্ন সময় নেমে আসে দুর্যোগ। এ দেশের আপামর জনসাধারণ বাংলা ভাষায়ই বলেছে। তারা বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাকে মাতৃভাষা রূপে মেনে নেয়নি। বাংলা ভাষার জন্য বাঙালি মুসলমানদের গভীর মমত্ববোধ থাকলেও বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে একটি প্রশ্ন উঠেছিলো ‘বাংলা কী বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা’ বাঙালি মুসলমানদের উচ্চবিত্ত অংশটিই এই বিতর্কের সৃষ্টি করেছিলো। তাদের মানসিকতা ছিলো ‘আশরাফ’ অর্থাৎ উচ্চ শ্রেণির মুসলমানদের ভাষা উর্দু আর ‘আতরাফ’ অর্থাৎ নিম্ন শ্রেণির মুসলমানদের ভাষা বাংলা। 

রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত বাংলা ভাষারই বিজয় সূচিত হয়েছে। সব বাগবিতণ্ডার অবসান ঘটিয়ে বাংলা ভাষা মাতৃভাষারূপে স্থান করে নিয়েছে। সমকালীন কবি-সাহিত্যিকদের বৈপ্লবিক আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে এ ভাষা পেয়েছেন নতুন গতি। বিদেশি ভাষা ও সাংস্কৃতিক চর্চা করে আমরা যতোই দক্ষতা লাভ করি না কেনো আসলে প্রত্যেক মানুষকে প্রথমে মাতৃভাষারই সহায়তা গ্রহণ করতে হয়। মাতৃভাষায় চিন্তা করেই প্রত্যেক মানুষকে বিদেশি ভাষায় তার অনুবাদ কিংবা রূপান্তর করতে হয়। মাতৃভাষার অবলম্বন ছাড়া এই রূপান্তর সম্ভম নয়। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা আমাদের সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে। আমাদের হৃদয়ের গভীরে এর স্থান। বাংলা ভাষা আমাদের প্রথম ঠিকানা, আমাদের শেকড়, আমাদের জীবন। আমাদের কাছে এই ভাষা মাতৃস্তন্যস্বরূপ। এই ভাষার রস পান করেই আমরা প্রাণবান মানুষ হয়ে বেড়ে উঠছি। অতএব মাতৃভাষা চর্চা ছাড়া আমাদের উন্নতি ও বিকাশ সম্ভব নয়।

একটি দেশের রাষ্ট্রভাষা সে দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, গণতন্ত্র, রাজনীতি, জাতীয়তা, স্বতন্ত্রবোধসহ সব পরিচয় ফুটে ওঠে। এই ভাষার মাধ্যমে অফিস-আদালতের কাজ চলবে, শিক্ষা, শিল্প-বাণিজ্য, সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান, দর্শনসহ সব বিষয়ে প্রতিভা বিকাশের সুযোগ থাকবে। যেকোনো দেশের রাষ্ট্রভাষা সে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং অস্তিত্বের প্রহরী হিসেবে কাজ করে। মাতৃভাষা যেমন জাতির অতুলনীয় সম্পদ, তেমনি রাষ্ট্রভাষাও জাতির শ্রেষ্ঠ সম্পদ। কাজেই কোনো দেশের মাতৃভাষার দাবিই সে দেশের রাষ্ট্রভাষা হওয়াটা অধিক যুক্তিসংগত এবং বাস্তব সত্য।

রাষ্ট্রভাষা বিতর্কটি ব্যাপকতা পায় ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ আগস্টে পাকিস্তান স্বাধীনতা হওয়ার পর থেকে। কিন্তু এই বিতর্কের শুরু আরো অনেক পূর্ব থেকেই। বাংলা ভাষাভাষীদের মাতৃভাষা যাতে রাষ্ট্রভাষার আসনে সমাসীন হতে না পারে সে জন্য ষড়যন্ত্র চলেছে দীর্ঘদিনব্যাপী। বিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ-ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলন ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে উঠতে থাকলে নতুন করে বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকেই স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দেন, ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে যাই হোক বাংলাদেশে বাংলাই হবে সরকারি ভাষা।

ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ একদিনে হয় না। নদী যেমন বাঁকে বাঁক মোড় নিয়ে এঁকেবেঁকে পাহাড়, প্রান্তর, বনাঞ্চল পেরিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হয়, বাংলা ভাষাও তেমন চলমান নদী প্রবাহের মতোই ইতিহাসের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে। বাংলা ভাষার উৎপত্তিকাল নিয়ে নানামত প্রচলিত আছে। বাংলা ভাষা কোন ভাষা থেকে এসেছে তা নিয়েও মতভেদ লক্ষ করা যায়। একসময় একটা ধারণা প্রচিলত ছিলো, সংস্কৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার উৎপত্তি। কথাটি বলার কারণ হলো, বাংলা ভাষায় আমরা যেসব শব্দ ব্যবহার করি তার অধিকাংশ শব্দ সংস্কৃত ভাষার। কিন্তু পরে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, এ তথ্য সঠিক নয়। 

ভাষা পণ্ডিতদের মতে, প্রাকৃত জনসাধারণের আদিম প্রাকৃত ভাষা থেকে বাংলা ভাষার জন্ম। প্রকৃত অর্থে বাংলা ভাষা প্রাকৃত ভাষা, প্রাকৃতজনের ভাষা। বাংলা ভাষার আদি জননী হলো প্রাকৃত ভাষা। এই প্রাকৃত বা প্রাকৃতজনের ভাষা ছিলো অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন। পূর্বাঞ্চলের ভাষা-পূর্বী প্রাকৃত থেকে গৌড়ীর প্রাকৃত ও তারপর নানা ভাষার সংস্পর্শে এসে ও শব্দ আহরণ করে বর্তমানকালের বাংলায় পরিণত হয়েছে। সংস্কৃতজ্ঞ অভিজাত শ্রেণির চোখে যারা ছিলো নিচ শ্রেণির সাধারণ লোক তাদেরই ওরা নাম দিয়েছিলেন ‘প্রাকৃতজন’। প্রাকৃত কথাটির অর্থ হলো স্বাভাবিক বা প্রকৃতি থেকে আগত। অর্থাৎ জনসাধারণের ভাষা। এই প্রাকৃত ভাষাটি কালক্রমে আরো ‘প্রাকৃত’ হয়ে গিয়েছিলো সাধারণ লোকের মুখে মুখে বিবর্তন লাভ করে। তার সেই পরবর্তী রূপের বেশ মানানসই এক নাম ‘অপভ্রংশ’। এই অপভ্রংশের পূর্বী অর্থাৎ মাগধী রূপ থেকে বাংলা ভাষার জন্ম। 

বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ লাভ করে বৌদ্ধযুগে পালবংশের রাজত্বকালে ৭৫০-১১৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বৌদ্ধ শাসকদের রাজত্বকালে বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটতে থাকে। বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন হলো চর্যাপদ। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে পণ্ডিত হল প্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের মিউজিয়াম থেকে চর্যাপদ উদ্ধার করেন। চর্যাপদ রচনা করেছিলেন বৌদ্ধ ধর্মযাজকরা। এগুলো বাংলা ভাষার ও বাংলা সাহিত্যে আদিমরূপে অতি মূল্যবান নিদর্শন হিসেবে ইতিহাসের পাতায় চিহ্নিত হয়ে আছে। চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পর আমরা হাজার বছর আগের বাংলা ও বাঙালির কথা জানতে পারি। বাংলা ভাষা বিকাশে বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক যেমন- মহাকবি আলাওল, সৈয়দ সুলতান, শাহ গরীবুল্লাহ, নিধুগুপ্ত, রামমোহন রায়, আবদুল হাকিম, দৌলত উজীর, শাহ মুহম্মদ সগীর, সৈয়দ হামজা, শেখ সাদী, লালন শাহ প্রমুখের অবদানের কথাও স্মরণীয়। 

দেশ বিভাগের পর বাংলা ভাষার চরম বিপর্যয়ের মুখে এ দেশের ভাংলা ভাষাপ্রেমী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাংলা ভাষার অস্তিত্ব রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় অধ্যায় ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের একুশে ফেব্রুয়ারি শহিদদের রক্তস্নাত আত্মত্যাগের মাধ্যমে বাংলা ভাষার পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করতে সক্ষম হয়। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পেয়েছে। 

ভাষা সংগ্রামের প্রথম পথযাত্রা থেকে শুরু করে জাতীয় চেতনার যে বৈপ্লবিক মাটি তারা আমাদের জন্য উর্বর করে তুলেছেন, সেই মাটিতে ক্রমাগত রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের যে বীজ বপন করা হয়েছিলো তার ফসল হচ্ছে স্বাধীনতা। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন থেকে সৃষ্ট বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিণতি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম জাতিরাষ্ট্র। যে রাষ্ট্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিলো ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি। ভাষার চেতনা থেকে রচিত হয় স্বাধীকার, আর স্বাধীকার থেকে উদ্ভূত হয় স্বাধীনতা। তাই জাতীয়ভাবে তৃণমূল থেকে উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার চর্চা সবার ওপর গুরুত্বারোপ করা দরকার।

লেখক: অধ্যক্ষ ও কলামিস্ট

জনপ্রিয়