ঢাকা মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪ , ৩০ বৈশাখ ১৪৩১ আর্কাইভস ই পেপার

nogod
nogod
bkash
bkash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
nogod
nogod
bkash
bkash

নতুন শিক্ষাক্রম ও আমার ভাবনা 

মতামত

জালাল আহমেদ

প্রকাশিত: ০০:৫০, ২৯ এপ্রিল ২০২৪

সর্বশেষ

নতুন শিক্ষাক্রম ও আমার ভাবনা 

বর্তমান নতুন শিক্ষাক্রম দিয়েই শুরু হয়েছে বাংলাদেশের শিক্ষার নতুনভাবে পথা চলা। মাঝে মধ্যেই নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে লিখতে চাই, তবে সময়-সূযোগ আর বিষয়ভিত্তিক লেখনী সবসময় হয়ে ওঠে না। যা মাথায় আসে তাই একটু কলমের আঁচড় টেনে হিজিবিজি দিয়েই যা হয়। এখন আবার একটু বিস্তারিত বলি। ভোট, আন্দোলন, শীতের পিঠা আর নববর্ষের এই পটকা ফোটার মৌসুমে আশা করছি কারো ভালো লেগে যেতে পারে। আর ভালো না লাগলে এড়িয়ে যেতে বাধা না করে বরং বলবো নতুন শিক্ষাক্রম বিষয়ক পর্যালোচনায় অংশগ্রহণ করতে। আসল কথা আসা যাক, বাচ্চারা নতুন বই হাতে পেয়েছে। নতুন বইয়ের সঙ্গে মা-বাবার মাথায় নতুন চিন্তার ভাঁজ। সঙ্গে ফেসবুকে দ্বিধাবিভক্ত আমরা বুড়োরা তো আছিই। 

কথা বলছিলাম নতুন শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে। কেউ বলছেন এটা লার্জ স্কেল বাসাবাড়ির কাজের লোক তৈরি করার ধান্দা, আবার কেউ বলছেন এটা সোনার জিওন কাঠি, মরণ কাঠি। একবার ইমপ্লিমেন্ট হলেই সব মুশকিল দূব হয়ে যাবে। কেউ আবার এ কথা বললেই চুপচুপ করে তেড়ে আসছেন, যেনো এটা নিয়ে কথা বলা অন্যায়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা আর সোশ্যাল মিডিয়া থেকে এই জ্ঞান হয়েছে যে, নীতিনির্ধারকরা আমাদের বহুল আলোচিত শিক্ষা পদ্ধতি সংস্কার করতে চাচ্ছেন। হাঁসের ডাক, ব্যাঙের লাফ, আলু ভর্তা বানানো বা লেপ ভাঁজ করা এই সংস্কারের অংশ। যতো হাস্যকরই লাগুক এই সব কাজ দিয়ে আসলেই কিছু শেখা সম্ভব। তাই, এই সংস্কারকে আমি ভালো মনে করি। এতোটুকু পড়েই আবার ক্ষান্ত দেবেন না আশা করি, আমি দুর্মুখ প্রজাতি, তাই আমায় নিয়ে ভয় নেই। 

আসেন, হাঁসের ডাক-ব্যাঙের ডাকের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এসব শ্রেণিকক্ষে আলুভর্তা বানানো বা লেপ ভাঁজ করা সব কিছুকে আসলে এক কথায় বলে ‘এক্টিভিটি’। এসব এক্টিভিটিতে আসলে কোনো দোষ নেই, যদি সেগুলো ভালোভাবে ‘অ্যালাইনমেন্ট’ করা হয়। গঠনমূলক ‘অ্যালাইনমেন্ট’ হলো আধুনিক শিক্ষা-পদ্ধতি, বিশেষ করে ওয়েস্টার্ন শিক্ষা-পদ্ধতির প্রাণ। গঠনমূলক ‘অ্যালাইনমেন্ট’ দাঁড়িয়ে আছে তিনটি পিলারের ওপর-কোর্স ইন্টেনডেড লার্নিং আউটকাম, এক্টিভিটি, আর ইভ্যালুয়েশন। মজার কথা হলো, আমাদের দেশে শুধুই আলোচনা দেখছি এক্টিভিটি নিয়ে। এক্ষেত্রে আমি কোনো লেখা দেখিনি কোর্স ইন্টেনডেড লার্নিং আউটকাম নিয়ে। অথচ, এটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নীতিনির্ধারকদের উচিত ছিলো এটা সবার আগে সর্বসাধারণের সঙ্গে কম্যুনিকেট করা। তাহলে আর এই বিভ্রান্তি হয়তো হতো না। কোর্স ইন্টেনডেড লার্নিং আউটকাম (সিআইএলও) হলো গঠনমূলক ‘অ্যালাইনমেন্ট’ এর প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। একজন বিষয়ভিত্তিক অভিজ্ঞ শিক্ষক, কোনো একটা বিষয়ের জন্য সুনির্দিষ্ট কতোগুলো লার্নিং আউটকাম তৈরি করেন। সিআইএলও বলবে একজন ছাত্র কোনো একটা ধাপ শেষ করে কি জ্ঞান অর্জন করবে। অর্থাৎ, অষ্টম গ্রেড এর গণিত  (উদাহরণ) বিষয়ের জন্য কিছু সুনির্দিষ্ট এই সিআইএলও থাকবে, যতোক্ষণ না একজন ছাত্র এই সিআইএলওগুলো কমপ্লিট করছে, সে ৮ম শ্রেণির গণিত বিষয় পাস করতে পারবে না।  তবে, আউটকমগুলো হবে খুব প্রিসাইজ যা পাঁচটার বেশি নয় এবং হরাইজন্টাল আর ভার্টিক্যালি অ্যালাইনমেন্ট। যেমন-কোনো একটি শ্রেণিতে যদি ছয়টা বিষয় থাকে তাহলে প্রতিটা বিষয়ের সিআইএলও সমাঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। এটা নিশ্চিত করবেন একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক। এটাকে বলবে হরাইজন্টাল অ্যালাইনমেন্ট। আবার, কোনো একটি শ্রেণির সামগ্রিক সিআইএলও হবে পূর্বের এবং পরের শ্রেণির সামগ্রিক সিআইএলও-র সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। এই ভার্টিক্যাল অ্যালাইনমে নিশ্চিত করবেন প্রধান শিক্ষক বা সহকারী প্রধান শিক্ষক। এইভাবে, নির্দিষ্ট একটা লেভেল শেষ করা একজন ছাত্রের অর্জিত জ্ঞান সম্পর্কে আমরা একটা ধারণা পাবো। ধরুন, কেউ বললেন, আমি দশম শ্রেণি পাস, সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝে যাবো তিনি কোন কোন লার্নিং গোল শেষ করে এসেছেন। গঠনমূলক ‘অ্যালাইনমেন্ট’ নিঃসন্দেহে একটা ভালো পদ্ধতি যদি ঠিকমতো ইমপ্লিমেন্ট করা যায়। 

সিআইএলও এর পরের ধাপ হলো এক্টিভিটি। যেটা নিয়ে আমাদের দেশে খুব কথা হয়েছে। অথচ এটা আর কিছুই না, জাস্ট সিআইএলও এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিছু কার্যক্রম। অভিভাবকেরা যখন কোনো প্যারেন্টস মিটিংয়ে যাবেন, তখন জিজ্ঞেস করতে পারেন, এই এক্টিভিটি কোন সিআইএলও রিপ্রেজেন্ট করে? যদি আপনার বাচ্চার শিক্ষক এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেন, তাহলে চোখবন্ধ করে ভরসা করতে পারেন। আপনার বাচ্চা যে এক্টিভিটিই করুক না কেনো, বুঝবেন তিনি লাইনে আছেন। এক্টিভিটির মূল কথা হলো, এগুলো যেনো বাচ্চার শারীরিক ও মানসিক বিকাশের পথে প্রতিবন্ধক না হয়ে বরং সহায়ক হয়। 
তিন নম্বর ধাপ হলো ইভ্যালুয়েশন, যেটা এক্টিভিটিকে পরিমাপ করবে। হতে হবে মেথোডোলজিক্যাল, বৈষ্যম্যহীন, এবং স্বচ্ছ। কেউ ভালো আলু ভর্তা তৈরি করলো কি না, আপনি সেটা কীভাবে বুঝবেন? এই কীভাবে বুঝবেন জিনিসগুলো লেখা থাকবে একটা সিলেবাসে। অর্থাৎ প্রতিটা সাবজেক্ট এর জন্য একটা সিলেবাস থাকবে, সেটা ক্লাস ওয়ান হোক অথবা ক্লাস টেন হোক। সামনের দিনগুলোতে প্রতিটা স্কুলে একজন সিলেবাস এক্সপার্ট নিয়োগ দেয়া যেতে পারে, যে পুরো বিষয়গুলো সমন্বয় করবে। তবে তাৎক্ষণিকভাবে প্রধান শিক্ষক কয়েকজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের সমন্বয়ে একটা গঠনমূলক ‘অ্যালাইনমেন্ট’ টিম করতে পারেন, যেনো এই বিষয়টা ঠিকভাবে ইমপ্লিমেন্ট হয়। শিক্ষার এই নতুন পদ্ধতিকে আমরা সবাই পজেটিভ বলেই মনে করতে পারি। এটা হয়তো একটা ভালো সূচনা। আমাদের সবার জানা উচিত এডুকেশন বা লার্নিং এর বাংলা প্রতিশব্দ শিক্ষা নিজেই একটা সংজ্ঞা। আর কোনো ভাষায় হয়তো শুধু একটা শব্দ দিয়ে পুরো পঠন-পাঠন শিখন-শেখানো শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্যকে বোঝা যায় না।  ‘শিখিবার ইচ্ছা কে শিক্ষা বলে’ -কি অসাধারণ কথা! এর মধ্যে লুকিয়ে আছে গঠনমূলক ‘অ্যালাইনমেন্ট’ এর সব কথা। ধরা যাক, আমি একটা বাচ্চাকে ক্যালকুলাস শেখাচ্ছি। এখন সে যদি, আমি যেভাবে ক্যালকুলাসের অঙ্ক করছি, সেভাবে করতে পারে তাহলে শুধু ইনফরমেশন আদান-প্রদান হলো। সহজ কথায় বাচ্চাটা গলধকরণ আর বমি করা শিখলো কিন্তু ‘শিক্ষা’ হলো না। শিক্ষা হলো, যখন সেই বাচ্চাটা এই ক্যালকুলাসকে বিভিন্ন বাস্তব সমস্যার সঙ্গে সংযোগ করতে পারবে, যখন আমার এই শেখানো অঙ্ক তাকে আরো জটিল এক গাণিতিক সমস্যার মধ্যে নিয়ে যাবে তখনই হবে শিক্ষা। উচ্চতর কোনো অবস্থায় উত্তরণ করা না গেলে তাকে শিক্ষা বলা যাবে না। রচনা লেখা আর রিসার্চ আর্টিক্যাল লেখার মধ্যে পার্থক্য এখানেই। রিসার্চে মানুষ জ্ঞানের বাউন্ডারিকে ধাক্কা মেরে প্রসার করে আর রচনাতে বিভিন্ন ইনফরমেশন একসঙ্গে সন্নিবেশ করা হয়। দেখতে এক কিন্তু ভিন্নতা আছে। নতুন এই কারিকুলাম হয়তো আরো বৃহত্তর এক সমস্যার সমাধানের দিকে নিয়ে যাবে। দেশে শিক্ষকদের বেতন কাঠামো নিয়ে কিছু কথা আছে। শিক্ষকদের বেতন কম এটা বৈশ্বিক সমস্যা। যেভাবেই হোক পৃথিবীবাসী একমত যে শিক্ষকদের বেশি টাকা-পয়সা দরকার লাগে না। পৃথিবীর এমন কোনো দেশ, এমন কোন শিক্ষা ব্যবস্থা জানি না, যেখানে শিক্ষকদের বেতন অন্যান্য পেশার তুলনায় বেশি। এমনো নয় যে শিক্ষকরা কম কাজ করে বা যারা জীবনে কিছু করতে পারে না তারা একটা ডিগ্রি বা পিএইচডি বাগিয়ে শিক্ষকতায় নেমে পরেন। যে দেশে আছি সেখানে একজন সহকারী শিক্ষক বা সহকারী অধ্যাপকের চেয়ে একজন ট্যাক্সিচালক চাইলে বেশি ইনকাম করতে পারবেন, একজন নাপিতের মাসিক ইনকাম বেশি হতে পারে, একজন প্লাম্বার এরচেয়ে বেশি ইনকাম করতে পারেন আর ব্যাংকার, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারদের কথা তো বলাই বাহুল্য। তাহলে কেনো মানুষ এখানে শিক্ষক হয়? যদিও ভাগ্যক্রমে আমি একজন শিক্ষক, তারপরেও যদি হাজারটা জীবন থাকে আর যদি হাজার বার জিগ্যেস করা হয়, তাহলে আমি হাজার বার শিক্ষকই হতে চাইবো। এইখানেই শুভঙ্করের ফাঁকি। কেউ বেতন দেখে শিক্ষক হন না। মানুষ এই পেশায় আসে প্যাসন থেকে। তাই বলে, শুধু প্যাসন দিয়ে কাজ চলে না, তাই কম বেতন হলেও বেশিরভাগ দেশে এই পেশায় একটা ন্যূনতম আর্থিক স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলা হয়। যা দিয়ে বেশ ভদ্রস্থ একটা জীবন চালিয়ে নেয়া যায়, বিজনেস ক্লাসে না চড়লেও ইকোনোমি ক্লাসে ঘোরাফেরা করা যায়। আমাদের দেশে সম্ভবত এই জায়গাটা নিয়ে কাজ করার অবকাশ আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, ভারতের এপিজে আব্দুল কালাম আর মনমোহন সিংএর সময়ের সংস্কারের কথা বলা যেতে পারে। তারা দুজনেই শিক্ষার বেতন কাঠামো ঢেলে সাজিয়েছিলেন, যার ফল তারা আজ ভোগ করছে। এ রকম অনেক উদাহরণ আছে।

তবে এরই মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নতুন কারিকুলাম এর বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ের শিক্ষক থেকে শুরু করে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবার কঠোর পরিশ্রমে আগামীর প্রজন্ম জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অবদান রাখবে এই আশা নিয়েই শুরু হোক আমাদের পথ চলা।   

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব স্কোভিদে, সুইডেন
 

জনপ্রিয়