
আজ ৩০ এপ্রিল ‘আন্তর্জাতিক শব্দ সচেতনতা দিবস’। প্রতিবছর এপ্রিল মাসের শেষ বুধবার দিবসটি পালিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ‘সেন্টার ফর হেয়ারিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন’ ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে উচ্চ শব্দ নিয়ে বৈশ্বিক প্রচারণা শুরু করে। এরপর থেকে দিবসটির সূচনা হয়। নীরব ঘাতকের আরেক নাম শব্দদূষণ। ঢাকা শহরের বিভিন্ন সড়কে নির্ধারিত গ্রণহযোগ্য মাত্রার চেয়ে প্রায় দুই থেকে তিনগুণ বেশি শব্দদূষণ হচ্ছে। শুধু ঢাকা শহর নয় বিভাগীয়, জেলা এমনকি উপজেলা শহরেও নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে শব্দের দূষণ হচ্ছে।
‘দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র’ (ক্যাপস)-এর গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে যেখানে দিনে ১০ ঘণ্টা জুড়ে বেশি শব্দের দূষণ ঘটত, ২০২৩-২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে সেখানে ১২-১৩ ঘণ্টা জুড়ে দূষণ ঘটছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা), বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনসহ (বাপা) বিভিন্ন পরিবেশবাদী বেসরকারি সংগঠন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভিন্ন সময়ের গবেষণায় ঢাকা শহরে মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণের চিত্র উঠে এসেছে। বিভাগীয় শহর তো বটেই দেশ জুড়ে শব্দদূষণের মাত্রা আগের থেকে বেড়েছে। এখন এ কথা বলার সময় হয়েছে, হাইড্রোলিক হর্ন বন্ধ করার চেয়ে বেশি জরুরি হাইড্রোলিক হর্ন আমদানি বন্ধ করা।
মাঝে মাঝে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে শব্দদূষণের বিরুদ্ধে দূষণকারী চালকের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয় সত্য। কিন্তু সেটা খুবই সীমিত পরিসর ও অনিয়মিতভাবে। সবার সম্মুখে প্রতিদিন শব্দদূষণ হচ্ছে। এটা যেনো অমোঘ নিয়তি বলে মেনে নেয়া! রাজধানীর বিভিন্ন মোড়ে চোখে মিলবে পরিবেশ অধিদপ্তরের সতর্কমূলক সাইনবোর্ড। তাতে লেখা-‘নীরব এলাকা, হাসপাতাল থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত হর্ন ও মাইক বাজানো দণ্ডণীয় অপরাধ।’ বিষয়টা কিছুটা দায়সারা গোছের। ঢাকার মতো ঘিঞ্জি শহরের বাস্তবতায় আসলে কী এই আইন মানা সম্ভব?
শব্দের সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৬০ ডেসিবেল, সেখানে ঢাকা শহরের বেশিরভাগ এলাকায় এখন শব্দের সার্বক্ষণিক গড় মাত্রা ১০০ ডেসিবেলের ওপরে।
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও এর সামনে তিন কিলোমিটার মহাসড়ক ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা। এ ছাড়া আরো একটি নীরব এলাকা হলো সচিবালয়। বিধিমালায় হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অফিস-আদালত বা এজাতীয় প্রতিষ্ঠান এবং এর চারপাশের ১০০ মিটার পর্যন্ত এলাকাকে ‘নীরব এলাকা’ বলা হয়েছে। এখানে যানবাহন চলাচলের সময় হর্ন বাজানো নিষেধ। কিন্তু সেসব তো কিছুই মানা হচ্ছে না। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের ‘শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা’ অনুযায়ী, নীরব এলাকায় দিনের বেলায় শব্দের মাত্রা থাকবে ৫০ ডিসেবেল এবং রাতের বেলায় ৪০ ডিসেবেল। বিধিমালায় হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নীরব এলাকা। সে হিসেবে ধরে ‘ক্যাপসে’র জরিপে সিটি কলেজ মোড় ও শিশু হাসপাতালের মোড়ে রাতে শব্দের গড় মাত্রা যথাক্রমে ৯৮ ডেসিবেল ও ৮৫ ডেসিবেল, যা মানমাত্রার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি শব্দের দূষণ ঘটছে বলে তথ্যে উঠে এসেছে।
শব্দদূষণের প্রধান উৎস যানবাহনের হর্ন। এ ছাড়া ইঞ্জিন, কলকারখানা, নির্মাণকাজ, বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানও শব্দদূষণের বড় উৎস। শব্দদূষণের প্রভাব ব্যাপক। শব্দদূষণের ফলে শ্রবণশক্তি হ্রাস, ঘুমের ব্যাঘাত, মানসিক ও শারীরিক সমস্যা, মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি, মনোযোগ নষ্ট, কর্মদক্ষতা হ্রাস, উচ্চ রক্তচাপ, হতাশা, অস্বাভাবিক মেজাজ ও বিরক্তি দেখা দেয়। সাধারণ মানুষ যে শব্দদূষণের শিকার; এটাও মানুষ অনেক সময় বুঝতে পারে না! শব্দদূষণের বিরুদ্ধে আইন ও শাস্তির বিধান আছে-এটা যানবাহনের অনেক চালকও জানেন না। আর জানলেও বেশিরভাগ চালক মানেন না। শব্দদূষণ ঘটালে যে শাস্তির বিধান আছে, শব্দদূষণের শিকার হতে হতে সাধারণ মানুষ যেনো এটাও ভুলে গেছে! শব্দদূষণের বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে শিশুরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য মতে, আবাসিক এলাকায় শব্দের মাত্রা দিনের বেলা ৫৫ ডেসিবেল, রাতে ৪৫ ডেসিবেল হওয়া উচিত; বাণিজ্যিক এলাকায় দিনে ও রাতে যথাক্রমে ৬৫ ও ৫৫ ডেসিবেল হওয়া উচিত; শিল্পাঞ্চলে দিনে ও রাতে যথাক্রমে ৭৫ ও ৬৫ ডেসিবেলের মধ্যে শব্দ মাত্রা থাকা উচিত। আর হাসপাতালে সাইলেন্স জোন বা নীরব এলাকায় দিনে ও রাতে যথাক্রমে ৫০ ও ৪০ ডেসিবেল শব্দ মাত্রা থাকা উচিত।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ক্ষমতাবলে শব্দ দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০০৬ সালে প্রণীত আইনে এলাকাভিত্তিক শব্দের মানমাত্রা যেমন ঠিক করে দেয়া আছে তেমনি শাস্তির বিধানও উল্লেখ আছে। আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান আছে। এ ছাড়া পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু ‘কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই’ অবস্থা।
শব্দদূষণ কমাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা দরকার। পৃথিবীর উন্নত দেশ যদি আইনের মাধ্যমে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাহলে আমরা কেনো পারবো না? বাংলাদেশের সংবিধানের ৩২ নং অনুচ্ছেদ জীবনের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে নিশ্চিত করেছে। যদি দূষণের কারণে কোনোভাবে মৌলিক অধিকার খর্ব হয় তাহলে সংবিধানের আলোকে বিদ্যামান আইনে তারও প্রতিকারের ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর ৪৬ ধারার ৩-এ পরিবেশ দূষণকারী যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ মোটরযানে ব্যবহার করা নিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। ত্রুটিপূর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণ, নিষিদ্ধ বা বিধিনিষেধ আরোপকৃত কোনো মোটরযান মহাসড়কে চালানোর বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। সবই ঠিকই আছে, সমস্যা হলো আইনের প্রয়োগ করা বিষয়টি। দূষণ যারা করছে বা ঘটাচ্ছে তারা সবার সামনে কাজটি করছে। সবার সামনে মেয়াদহীন গাড়ি ও ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছে চালকরা। ফিটনেসবিহীন গাড়ি হরহামেশাই চলছে। এই ফিটনেসবিহীন গাড়িই শব্দদূষণের বড় কারণ।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০০৬ অনুযায়ী, সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির ব্যবহার নিষিদ্ধ। কিন্তু কেউ কী এই আইন মানে? আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা হতে ৫০০ মিটারের মধ্যে ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন ব্যবহার নিষিদ্ধ। এটা মানার না কেউ আছে, না আছে দেখার কেউ! মাঝরাতে উচ্চ শব্দে মাইক বা সাউন্ড সিস্টেম বাজিয়ে অন্যদের বিরক্ত করা আইনগত অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। এটি সাধারণত শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা ২০০৬ এবং দণ্ডবিধি, ১৮৬০ এর আওতাভুক্ত। বিধিমালায় আরো বলা হয়েছে- রাত ৯টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত শব্দদূষণের বিষয়ে বিশেষ নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই সময় মাইকের ব্যবহার বা উচ্চ শব্দে গান বাজানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। নিয়ম ভঙ্গ করলে যথাযথ শাস্তির বিধান আছে। যদি কোনো ব্যক্তি মনে করে তিনি বা তার পরিবার শব্দদূষণের শিকার হচ্ছে তাহলে তিনি নিকটস্থ থানায় অভিযোগ জানাতে পারেন। পুলিশ এই পরিস্থিতিতে ব্যবস্থা নিতে পারে এবং শব্দের উৎস বন্ধ করতে পারে।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগের বিকল্প নেই। নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করলে সচেতনতা বাড়বে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। ব্যাপারটা হলো, চালক ও সাধারণ মানুষকে আইনটা জানানো। তাহলে সাধারণ মানুষ সচেতন হয়ে প্রতিকার চাইতে পারবে। ভুক্তভোগীকে আইনের প্রতিকার চাওয়ার পথটা তৈরি করে দিতে হবে। অনেকে হয়রানির ভয়ে প্রতিকার চাইতে ভয় পায়। তবে ঢাকা শহরে শব্দদূষণের আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিধিমালায় সীমাবদ্ধতা থাকলে সেটাও দূর করতে হবে। বাস্তবতা মেনে রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য বিভাগীয় শহর কিংবা ঢাকার সঙ্গে অন্যান্য বিভাগীয় শহরের জন্য এক আইন, জেলা ও উপজেলা শহরের জন্য কিছুটা ভিন্নতা রেখে যথাযথ ও বাস্তসম্মত আইনের কথা ভাবা যেতে পারে। নীরব, আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকার রাস্তায় বিভিন্ন রং দিয়ে চিহ্নিত করে জনসাধারণ ও চালকদের সচেতন করার মতো উদ্যোগ কাজে আসতে পারে। মনে রাখা দরকার, আইনের প্রয়োগ না করলে সে আইনের কোনো গুরুত্ব থাকে না। জনসচেতনতা ও যথাযথ আইনের প্রয়োগই পারে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে।
লেখক: শিক্ষক