ঢাকা বুধবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৫ , ১৬ বৈশাখ ১৪৩২ আর্কাইভস ই পেপার

bkash
bkash
udvash
udvash
uttoron
uttoron
Rocket
Rocket
bkash
bkash
udvash
udvash

ক্লাসরুম শিক্ষা আনন্দদায়ক হোক

মতামত

মো. নজরুল ইসলাম, আমাদের বার্তা

প্রকাশিত: ০৮:০০, ৩০ এপ্রিল ২০২৫

সর্বশেষ

ক্লাসরুম শিক্ষা আনন্দদায়ক হোক

ক্লাসরুম শিক্ষা কি কখনো আনন্দদায়ক হয়? আনন্দদায়ক হলে তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্কুল পালাতেন না, আইনস্টাইন ফেল করতেন না--এমন প্রশ্ন অনেকেই করে থাকেন, যা খুবই যৌক্তিক বলেই আপাতত মনে হয়। আবার এটাও সত্য শিক্ষক যতোই ভালো পড়ান না কেনো শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিক্ষা গ্রহণের উপযুক্ত মানসিকতা তৈরি না হলে ক্লাসরুম একটি বোরিং বা অত্যন্ত বিরক্তিকর জায়গা ছাড়া আর কিছু নয়। এগুলো হলো পুরনো ধারণা। এখন যুগ পাল্টে গেছে। পুরনো ক্লাসরুম বদলে এখন অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন বিভিন্ন উপকরণে সজ্জিত হয়েছে আধুনিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্লাসরুমসমূহ এবং শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে সেভাবে যাতে শিক্ষাদান এবং শিক্ষাগ্রহণ কষ্টের না হয়ে আনন্দের হয়, যাতে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষিত হয় ক্লাসরুমের প্রতি। কিন্তু বাস্তবে তা কী হচ্ছে? দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কথা না হয় বাদই দিলাম, রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ এবং আইডিয়াল কলেজের সামনে এবং পাশে প্রতিদিন যে দৃশ্য দেখা যায় তা একজন পথচারীকে ওই প্রতিষ্ঠানসমূহের শিক্ষার পরিবেশ সম্পর্কে বিরূপ ধারণা দেয়। প্রতিনিয়তই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে একদল শিক্ষার্থী কলেজ গেটের সামনে অথবা পাশে টং দোকানগুলোতে চা পান করছে, সিগারেট ফুঁকছে, খোশগল্প করছে অথবা, মোবাইলে পছন্দের সাইট ব্রাউজ করছে। কেনো তারা ক্লাস-ফাঁকি দিচ্ছে এমন প্রশ্নে প্রায় সবার কাছ থেকেই একইরকম জবাব মেলে ‘অমুক শিক্ষকের ক্লাস! ওই ক্লাস করা না করা সমান কথা। অর্থাৎ কিছু সংখ্যক শিক্ষক সম্পূর্ণ ব্যর্থ হচ্ছেন শিক্ষার্থীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে। আবার কোনো কোনো শিক্ষকের ক্লাসের সময় টং দোকানগুলো ফাঁকা থাকতে দেখা গেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের ক্লাস নিশ্চয় উপভোগ্য হচ্ছে বিধায় শিক্ষার্থীরা আর ক্লাসের বাইরে নেই। অবশ্য কিছু কিছু ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষার্থী সব প্রতিষ্ঠানেই থাকে যারা ক্লাসের চেয়ে বরং প্রাইভেটেই বেশি মনোযোগী। আবার কিছু কিছু প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসম্পন্ন পরিবারের সন্তানেরা নিজে গাড়ি হাঁকিয়ে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় ও ক্লাসের বাইরে খারাপ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেয় অথবা গার্লফ্রেন্ড নিয়ে ঘোরেন এবং বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে যুক্ত হন। এদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে শিক্ষক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উভয়েই অসহায়। এরা মা-বাবা, শিক্ষক কাওকেই পরোয়া করে না। অনেক সময় এরা নোংরা রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে পড়েন, বিভিন্ন দলের গডফাদারদের নেক নজরে পড়ে এবং বিভিন্ন অপকর্ম করে একসময় বিদেশে পাড়ি জমায়। অবশ্য সেখানে গিয়ে খুব একটা সুবিধে করতে না পেরে হোটেলে ধোয়া-মোছা বা ওই জাতীয় কাজ বেছে নিয়ে কোনোরকম জীবন কাটিয়ে দেন অথবা শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরে এসে বাবার ব্যবসায়ে হাল ধরে থিতু হয়।

হাসিমুখে শিক্ষকের ক্লাসরুমে প্রবেশ এবং প্রবেশ করেই ‘তোমরা কেমন আছো, বন্ধুরা’—এই ছোট্ট একটি জিজ্ঞাসাই শিক্ষার্থীদের মনোযোগ ক্লাসমুখী করার জন্য যথেষ্ট। সবার চোখমুখের দিকে এক ঝলক নজর বুলিয়ে নেয়া এবং দু’একজনকে জিজ্ঞেস করা, ‘তোমাকে শুকনো দেখাচ্ছে কেনো অথবা তোমার মন খারাপ কেনো’ ইত্যাদি দু-একটি প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণে আরো একধাপ এগিয়ে নিতে পারে। আজকে আমি তোমাদের অমুক বিষয়ে পড়াবো না বলে যদি বলা যায় আজকে আমি অমুক বিষয়ে তোমাদের সঙ্গে গল্প করবো অথবা শেয়ার করবো বললে শিক্ষার্থীরা বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। যে শিক্ষক ক্লাসে গিয়েই মুখস্থ করে আসা লেকচার শুরু করেন এবং পণ্ডিত পণ্ডিত ভাব নিয়ে নিজেকে সবজান্তা হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন, তার ক্লাসে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয় এবং ক্লাসের শিক্ষাদান ফলপ্রসূ হয় না। মনে রাখতে হবে, একক বক্তৃতা দানের চেয়ে অংশগ্রহণমূলক বক্তৃতা অধিক কার্যকরী। শিক্ষকের মুখের ভাষা, শুদ্ধ উচ্চারণ, বাচনভঙ্গি ও শারীরিক ভাষা এবং সহানুভূতিশীল আচরণ শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণের একটি অন্যতম হাতিয়ার। একজন শিক্ষক বক্তৃতামঞ্চে সিনেমা পর্দার নায়কের মতো আকর্ষণীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন কিন্তু সে নায়ক দর্শকদের চোখে চোখ রাখবেন, একই ডায়ালগ প্রয়োজনবোধে একাধিকবার উচ্চারণ করবেন এবং সামনে উপস্থিত শিক্ষার্থী নামক দর্শক তা হৃদয়ঙ্গম করতে পারলো কি না তা নিশ্চিত করবেন, তবেই তিনি সার্থক। শিক্ষক যদি শিক্ষার্থীদের মনের গভীরে প্রবেশ করতে না পারেন তবে তিনি ক্লাসরুমে যতো দীর্ঘক্ষণই থাকুন না কেনো, যতোই জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দান করুন না কেনো সে বক্তৃতা নিষ্ফল হতে বাধ্য। যে বিষয়ে শিক্ষক শিক্ষা দেবেন সে বিষয়ে অবশ্যই তার পাণ্ডিত্য থাকতে হবে, তবে একজন সফল শিক্ষক শুধু তার পাঠ্য বিষয়েই সীমিত থাকবেন না। তিনি ক্লাসটিকে উপভোগ্য করার জন্য মাঝে মাঝেই সিলেবাসের সীমা অতিক্রম করে প্রাসঙ্গিক কোনো গল্প, কাহিনি ও বিজ্ঞান বা বাস্তব কোনো ঘটনার উদাহরণ দিয়ে শিক্ষার্থীদের আনন্দ দেবেন, যা চলমান বক্তব্যে অনুঘটক হিসেবে কাজ করবে এবং একঘেয়েমি দূর করবে । বাস্তবে এমনো দেখা গেছে, একজন অতিশয় পণ্ডিত শিক্ষকের চেয়ে বরং অপেক্ষাকৃত কম জ্ঞানী শিক্ষকের ক্লাসে শিক্ষার্থীরা বেশি উপকৃত হয়ে থাকে। কারণ, পরের জন বিভিন্ন কৌশলে শিক্ষা দিয়ে থাকেন এবং শিক্ষার্থীদের নিকট প্রিয় ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেন।

আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে কিন্তু আজকাল ভিন্ন দৃশ্য চোখে পড়ে। ক্লাসরুম শিক্ষাকে আনন্দময় করবার জন্য সেখানে চলে শিক্ষকদের প্রাণান্তকর চেষ্টা। সেখানে শিশুমনের উপযোগী করে বিভিন্ন শিক্ষা উপকরণ তো রয়েছেই, উপরন্তু প্রাথমিক শিক্ষকরা নানান ভঙ্গিতে কথা বলে, অঙ্গভঙ্গি করে, বিভিন্ন শারীরিক কসরত দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেন এবং মজায় মজায় শিক্ষাদানের চেষ্টা করেন। কোনো কোনো শিক্ষিকাকে দেখা গেছে ক্লাসে নেচে-গেয়ে, ছন্দে ছন্দ মিলিয়ে, সবাই এক সঙ্গে গলা মিলিয়ে বাচ্চাদের শেখাচ্ছেন এবং বাচ্চারাও তা উপভোগ করছে। শিক্ষিকাদের এমন উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। অবশ্য এ পদ্ধতি উচ্চশ্রেণিতে শিক্ষা দেয়ার জন্য প্রযোজ্য নয়। শিক্ষার্থীদের বয়স অনুযায়ী শিক্ষাদানের পদ্ধতিও আলাদা হতে হবে।

ক্লাসরুম শিক্ষা আনন্দদায়ক করার জন্য শুধু শিক্ষকদের ভূমিকাই যথেষ্ট নয়। ক্লাসরুমে যথোপযুক্ত শিক্ষা-উপকরণ থাকতে হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক ভৌত-অবকাঠামো যথাযথ থাকতে হবে। প্রতিষ্ঠানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগের পাশাপাশি গবেষণাগার, লাইব্রেরি, কমনরুম, কম্পিউটর ল্যাব, খেলার মাঠ ইত্যাদির ব্যবস্থা থাকতে হবে এবং রুটিনমাফিক প্রতিযোগিতা (কবিতা আবৃতি, কোরআন তিলাওয়াত, উপস্থিত বক্তৃতা, নির্ধারিত বক্তৃতা, বানান প্রতিযোগিতা, সংগীত ইত্যাদি) এবং খেলাধুলার আয়োজন করতে হবে। বছরে অন্তত একবার হলেও শিক্ষাসফর ও পিকনিকের ব্যবস্থা থাকতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা একটানা ক্লাসরুম শিক্ষার একঘেয়েমি দূর করে সতেজ হতে পারেন। অন্যান্য ক্লাসের মতো লাইব্রেরি ক্লাসটিও নিয়মিত হতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা গাইডবইয়ের প্রতি নির্ভরশীলতা পরিহার করে বিভিন্ন বিষয়ে মূল বই থেকে বিশুদ্ধ জ্ঞানলাভের অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেন।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ত্রুটিযুক্ত হওয়ায় আমাদের শিক্ষার মান উন্নত দেশসমূহের শিক্ষার মান থেকে অনেক নিচে। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে আসা উচ্চশিক্ষার সনদধারী একজন নাগরিক যখন শুদ্ধ বাংলায় কথা বলতে পারেন না, দুলাইন ইংরেজি লিখতে পারেন না তখন আমাদের শিক্ষার মান কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে, তা ভেবে লজ্জা পেতে হয়। উপরন্তু, পরীক্ষায় নকল (এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও), গাইডবই নির্ভরশীল জ্ঞান এবং প্রাইভেট কোচিং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষার এহেন মুমূর্ষু অবস্থায় ক্লাসরুম শিক্ষাকে আকর্ষণীয় ও আনন্দময় করতে না পারলে আমাদের একটি আলোকিত জাতি গড়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।

লেখক: পরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

জনপ্রিয়