
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন মোট ৪৩৩টি প্রস্তাব বা সুপারিশ দিয়েছে। তার মধ্যে অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে সব ধর্মের নারীদের জন্য বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিত করা- এই সুপারিশ নিয়েই বড় আপত্তি ধর্মীয় গোষ্ঠীর। আরো আপত্তি আছে যৌনকর্মীদের শ্রমিক অধিকারের প্রস্তাব নিয়ে।
হেফাজতে ইসলাম বলছে, কমিশনের প্রস্তাবে আপত্তিকরভাবে ধর্মীয় বিধিবিধান, বিশেষ করে ইসলামী উত্তরাধিকার ও পারিবারিক আইনকে নারীর প্রতি বৈষম্যের কারণ বলে উল্লেখ করা হয়েছে; এই প্রস্তাবনা বাতিলের পাশাপাশি পুরো কমিশন বাতিল করতে হবে।
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হকের নেতৃত্ব কমিশনের সদস্যরা গত ১৯ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার কাছে তাদের প্রতিবেদন জমা দেন। প্রতিবেদনে নারীর প্রতি বৈষম্য দূর করতে মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিষ্টান পারিবারিক আইনের সংস্কার করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এসব আইনের পরিবর্তে অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে সব ধর্মের নারীর জন্য বিয়ে, তালাক ও সন্তানের ভরণপোষণে সমান অধিকার নিশ্চিত করার জন্য অধ্যাদেশ জারি করার সুপারিশের পাশাপাশি সব সম্প্রদায়ের জন্য আইনটিকে ঐচ্ছিক রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়া উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করে মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মীয় উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করে সম্পদে নারীর ৫০ শতাংশ নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে কমিশন।
এর অংশ হিসেবে সিডও সনদের ওপর অবশিষ্ট দুটি সংরক্ষণ প্রত্যাহার এবং আইএলও সনদ সি১৮৯ ও সি১৯০ অনুস্বাক্ষর ও পূর্ণ বাস্তবায়ন করার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি শ্রম আইনে যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশ করেছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন।
তবে কমিশনের এসব সুপারিশ নিয়ে পালটাপালটি অবস্থান তৈরি হয়েছে। এসব সুপারিশে আপত্তি জানিয়ে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিল চেয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। আগামী ২৩ মে বাদ জুমা নারী সংস্কার কমিশন অবিলম্বে বাতিলসহ চার দফা দাবিতে দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করার ঘোষণা দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। এছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশও নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনকে বাতিল করতে এবং তাদের প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করার দাবি জানিয়েছে। অন্যদিকে কমিশন ও নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন, নারীর প্রতি বৈষম্য নিরসন আমাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ, আর এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে তারা প্রস্তুত আছেন।
গত ১৯ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেওয়া শেষে ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে ব্রিফিংয়ে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক বলেন, ‘আমাদের অনেক সুপারিশ নিয়ে অনেক বাধা আসবে। আর এ বাধা মোকাবিলার জন্য আমরা প্রস্তুত আছি। আমরা বিশ্বাস করি, নারীর প্রতি চলে আসা যে বৈষম্য রয়েছে তা যদি কেউ বিলুপ্ত করতে পারে, যেটা এই অন্তর্বর্তী সরকারই পারবে।’
কমিশনের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদের আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ৬০০ করার সুপারিশ করা হয়েছে, যেখানে প্রতিটি নির্বাচনি এলাকায় একটি সাধারণ আসন এবং নারীদের জন্য একটি সংরক্ষিত আসন থাকবে। তবে উভয় আসনে সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই সুপারিশকে অনেকটা অবাস্তব বলা হলেও এ বিষয়ে শিরীন পারভীন হক বলেন, ‘দেশে জনসংখ্যার অনুপাতে জাতীয় সংসদে ৩০০ আসন পর্যাপ্ত নয়। ৬০০ আসন এই জনসংখ্যার তুলনায় খুব বেশি নয়। এটা নিয়ে অনেকে অনেক মন্তব্য করলেও আমাদের কাছে ৬০০ আসন উদ্ভট কিছু মনে হচ্ছে না। আমরা চাই, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হোক, বিতর্ক হোক। আসন বাড়ানোর বিরুদ্ধে কী কী যুক্তি আছে, তা উঠে আসুক।’ এছাড়া প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক দলের সর্বস্তরের কমিটিতে ৩৩ শতাংশ পদে নারীদের রাখার যে বিধান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) রয়েছে, তার বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান খাতে বৈষম্য নিরসনে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে করণীয় বিষয়ে সুপারিশে কমিশন বলেছে, সব খাতে ছয় মাস বা ২৪ সপ্তাহ পূর্ণ বেতনে প্রসূতি, প্রসব ও দত্তকজনিত ছুটি নিশ্চিত করা। শ্রম আইনে ‘প্রসূতি কল্যাণ’ পরিবর্তন করে ‘প্রসূতি অধিকার’ লেখা এবং গর্ভধারণ থেকে প্রসব-উত্তর ছুটিতে থাকাকালীন চাকরিচ্যুতি নিষিদ্ধ করাসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা অন্তর্ভুক্ত করা। সব খাতে ২ সপ্তাহ পূর্ণ বেতনে পিতৃত্বজনিত ছুটি নিশ্চিত করা এবং শ্রম আইনে গৃহকর্মী ও যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
সুপারিশ করা সার্বিক বিষয় তদারকিতে ‘একটি স্বতন্ত্র স্থায়ী নারী বিষয়ক কমিশন’ করাসহ ১৫টি বিষয়ে ৪২৩টি সুপারিশ জানিয়েছে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন। যে বিষয়গুলোতে সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে সেগুলো হলো—সংবিধান আইন ও নারীর অধিকার :সমতা ও সুরক্ষার ভিত্তি, সব বয়সী নারীর জন্য সুস্বাস্থ্য, নারীর অগ্রগতির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ও জাতীয় সংস্থাসমূহ, অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ ও সম্পদের অধিকার, নারীর স্বার্থ ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান, পর্যায়ের উন্নয়ন, নারী শ্রমিকের নিরাপদ অভিবাসন, নারী ও মেয়েশিশুর জন্য সহিংসতামুক্ত সমাজ, দারিদ্র্য হ্রাসে টেকসই সামাজিক সুরক্ষা, জনপরিসরে নারীর ভূমিকা :জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে, গণমাধ্যমে নারীর অংশগ্রহণ, চিত্রায়ণ ও প্রকাশ, জনপ্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণ, ক্রীড়া ও সংস্কৃতিতে নারীর অন্তর্ভুক্তি ও বিকাশ, নারীর অগ্রগতির জন্য শিক্ষা, প্রযুক্তি ও দক্ষতা বৃদ্ধি এবং দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনে নারী। এর মধ্যে যেসব সুপারিশ এখনই বাস্তবায়নযোগ্য, তা দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ ও এ নিয়ে বিতর্কের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের একজন অধ্যাপক গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, সমাজ যখন বহু দিন ধরে এক ধাঁচে চলতে থাকে তখন হঠাৎ যে কোনো পরিবর্তন মেনে নেওয়া সবার পক্ষে সম্ভব হয় না। এটি মানতে সময় লাগে। তার পাশাপাশি প্রস্তাবগুলো কতটা বাস্তবায়নযোগ্য তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু একবারে বড় পরিবর্তন না এনে পর্যায়ক্রমে যখন পরিবর্তনগুলো করা হয় তখন তার প্রতিক্রিয়া কম হয়।